একাত্তরের পনের নভেম্বর সকালটা ছিল অন্য দশটা সকালের চেয়ে কিছুটা ভিন্নতর। আর সেটা অনুভব করেছিলেন তরুণ চিকিৎসক আজহারুল হক ও তাঁর অষ্টাদশী স্ত্রী সৈয়দা সালমা হক। মধ্য নভেম্বরের সেই ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সকালে সহকর্মী ডা. হুমায়ুন কবীরসহ ডা. আজহারুল হক ২২ ফ্রি স্কুল স্ট্রিট হাকিম হাউসের সামনে থেকে অপহৃত হন- সশস্ত্র আলবদরদের হাতে।
মানবতাবাদী চেতনায় বেড়ে ওঠা এই মেধাবী চিকিৎসকের কর্মজীবন ছিল খুবই সীমিত সময়ের। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই তিনি ঝুঁকি নিয়ে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাসহ আহত মানুষদের নিয়মিত চিকিৎসার দায়িত্ব পালন করেছেন। হাতিরপুল সংলগ্ন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ‘সাইদা ফার্মেসী’ নামের চেম্বারটি তখন যুদ্ধাহতদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ঠিকানা হয়ে উঠেছিল। সার্জারীতে মুন্সিয়ানা ছিল বলে যুদ্ধকালের যাবতীয় অস্ত্রোপচারের কাজটা তিনি সামলেছেন একাই। দূর-দূরান্ত থেকে আহত মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর কাছেই ছুটে আসতেন চিকিৎসার আশায়। চিকিৎসা করতে গিয়ে তিনি প্রায়ই মধ্যরাত অবধি বাইরে থাকতেন স্ত্রীর মতামত উপেক্ষা করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সেন্ট্রাল রোড আর হাতিরপুল এলাকায় তাঁর এই মুক্তিযুদ্ধবান্ধব চিকিৎসসেবার বিষয়টি প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। স্থানীয় অবাঙ্গালী বিহারী, রাজাকার ও আলবদররা তাঁকে হত্যার সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিল।
একাত্তরের পনের নভেম্বর সকালে তাদের সে অপেক্ষায় অবসান হয়। স্থানীয় ‘খান’ নামের এক বিহারীর সহায়তায় হাতিরপুল এলাকার সশস্ত্র আলবদরদের একটি গ্রুপ ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ও হাকিম হাউস এলাকা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে ডা. আজহার ও ডা. হুমায়ুন কবীরকে একত্রে ধরে ফেলে। আলবদরদের টর্চারসেলে আটকে রেখে শবে কদরের আগের রাতে তাঁদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। পৈশাচিক এ নির্যাতনে প্রাণ হারান ডা. আজহার ও ডা. হুমায়ুন কবীর। পরদিন ১৬ নভেম্বর ঢাকার নটরডেম কলেজের পাশের ডোবা থেকে উদ্ধার করা হয় এই মহৎ প্রাণ দুই চিকিৎসকের নীলাভ মৃতদেহ।
এক বছর ন’মাসের বৈবাহিক জীবনের পরিসমাপ্তির পর ডা. আজহারুল হকের স্ত্রী সৈয়দা সালমা হক এরপর ক্রমশ এগোতে শুরু করলেন- ‘ভবিষ্যৎহীন এক ভবিষতের দিকে’। অকাল বৈধব্য যন্ত্রণা তাড়িত এই তরুনী মায়ের একাত্তর পরবর্তী যাপীত জীবনের প্রতিটি দিন যেনো এক একটি দুঃসহ ‘একাত্তর’। শহীদ জায়া সৈয়দা সালমা হকের সাথে কথোপকথনের ভিত্তিতে এখানে তাঁর অকথিত সেই একাত্তরের চুম্বুকাংশের আঁচ তুলে ধরা হলো:
প্রশ্ন: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় আপনি ঊনিশশো একাত্তরের পঁচিশে মার্চের ভয়বহতা ও অসহায়তা সেখান থেকে কতটা উপলব্ধি করতে পেয়েছিলেন?
সালমা হক: ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ অসুস্থ হয়ে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হই। ২৫ মার্চ সন্ধায় তিন তলায় ৩১ নাম্বার কেবিনটা আমার নামে বরাদ্দ হয়। রাত আনুমানিক ৯টার দিকে আমার ভাই এসে জানালেন, রাস্তায় ছাত্ররা গাছ কেটে পলাশী পর্যন্ত ব্যারিকেট দিচ্ছে। আজকে রাতে কিছু একটা হবেই। আর ওদিকে বঙ্গবন্ধুর সাথে ভূট্টোর আলোচনাও চলছিলো। এ রকম একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভিতর দিয়েই সময় পার হচ্ছিল। রাতে আমার খাওয়ার পর সিস্টার এসে আমাকে পেথেডিন ইনজেকশন দিয়ে গেলেন। এটা দেয়ার পর আমি সাথে সাথে ঘুমিয়ে গেলাম। রাত সাড়ে ১১টা কি ১২টায় বিকট শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। এমন গর্জনে যে কি বলবো―আমি তো এর আগে কোনো যুদ্ধ দেখি নাই। আমার হাসবেন্ড বারান্দায় শুয়ে ছিলেন। আমি তাঁকে ডাকলাম। সে এসে তাড়াতাড়ি করে আমার বেডটা হাসপাতালের দেয়ালের কাছে সরিয়ে নিলেন। আমার বেডটা ছিলো জানালা বরাবর সে ঠেলে সেটা দেয়ালের সাথে দিলো যাতে কোনো গুলি না আসে। তখন অলরেডি যত রকমের গোলাগুলির শব্দ আছে- মেশিনগান, স্টেনগান সবগুলো থেকে খই ফুটতে শুরু করেছে। এর মধ্যে ট্যাঙ্কও চলে এসেছে। কামানের তোপ তো আগে বুঝি নাই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমি খাটের নিচে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। তারপর তাকিয়ে দেখি- সে যে কি বিভীষিকা! চতুর্দিকে আগুনের লেলিহান শিখা। পূবের দিকে তাকাচ্ছি আগুন। পশ্চিমের দিকে তাকাই সেদিকেও আগুন। ওদিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, শাখারিপট্টি, ইত্তেফাক অফিস, তৎকালীন ইপিআর, পলাশী এসব জায়গায় আগুন জ্বলছে। আমি ভয়ে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে মরে যাওয়ার মতো অবস্থায়। এরপর সারারাত ধরে এ রকম গুলি চলতেই থাকলো। আমি এরপরে বাথরুমে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। সব জায়গায়ই শুধু আলো চলে আসে আর ঝনঝন করে গ্লাসগুলো ভেঙে পড়ে। ঢাকা হাসপাতালের তিনতলার জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি- এমন একটা জিনিস আকাশের দিকে ছুঁড়ে ফেলতেছে যে আগুনের একটা গোলা টাইপের সেটা মূহূর্তে সব আলো করে ফেলে। পরে জেনেছি ওটা নাকি লোকেট করার জন্য ছুঁড়ে মারা হয়েছিল। সার্চলাইট জ্বালিয়ে ঘাতক পাকিস্তানীরা দেখছিল- কোনটা ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফ্ল্যাট, কোনটা জগন্নাথ হল আর কোনগুলো ইউনিভার্সিটির কোয়াটার। এভাবে সারাটা রাত ওরা নির্বিচারে গুলি চালায়। আর সারাটা রাত আমি থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। এরপর ভোরের দিকে আস্তে আস্তে গুলির শব্দটা একটু একটু করে কমে আসলো। সকাল সাড়ে ১০টায় একদম হন্তদন্ত হয়ে গায়ে সাদা অ্যাপ্রোনে রক্তের দাগ নিয়ে ফিরে এলেন ডা. আজহার। অ্যাপ্রোনে রক্তের দাগ দেখে আমি খুব ভয় পেলাম আর তাঁর তাকানোটাও ছিলো খুব উদ্ভ্রান্তের মতো। আমি তাঁকে বললাম ‘এ রকম করেন কেনো? এত অস্থির কি জন্য’। তখন প্রথমেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মদিরা খালার হাসবেন্ডের নাম কি?’ তখন আমি বললাম, ‘লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন’। নিষ্পলক চেয়ে থেকে তিনি নিচে চলে গেলেন। এ রকম ভাবে সারাটা দিন কেটে গেলো মাঝে দুপুর বেলা একবার শুধু এলেন। এরপর ২৭ মার্চ সীমিত সময়ের জন্য কারফিউ তুলে নেয়া হল। ২৮ মার্চ সকালে দেখলাম, মেডিকেল কলেজের প্রফেসররা যতগুলো কেবিন খালি ছিলো সবগুলো কেবিনে তাদের ফ্যামেলি নিয়ে ঢুকে পড়লো। তাদের সবার হাতে একটা করে করোসিনের চুলা, একটা সুটকেশ আর একটা চালের ব্যাগ ছিল।
প্রশ্ন: সেদিন কেনো ডা. আজহার ‘মদিরা খালার হাসবেন্ডের নাম’ জানতে চেয়েছিলেন?
সালমা হক: মদিরা খালার হাসবেন্ড শহীদ লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন সম্পর্কে আমার খালু ছিলেন। ওনার ওয়াইফ আমার মা’র আপন মামাতো বোন। ওনারা এলিফেন্ট রোডের দিকে থাকতেন। ক্রাকডাউনের রাতেই পাকিস্তানি আর্মি সরাসরি এসে তাঁর বাসায় হানা দেয় তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁর বাসায় ঢুকে ‘কমান্ডার মোয়াজ্জেম কাহা’ এসব জিজ্ঞাসা করলে আমার খালু বের হয়ে আসেন। তাঁকে রাইফেল দিয়ে আঘাত করতে করতে নিচে নামিয়ে গুলি করে বেওনেট চার্জ করে হত্যা করা হয়। আমার খালা ও তার বড় ছেলে সেটা দেখে ফেলে। এরপর মোয়াজ্জেম খালুর ডেডবডিটা সেনাবাহিনীর পিকাপের সাথে বেঁধে নিয়ে তারা এ শহরের রাস্তায় ঘুরায়। শুনেছি ওনার গায়ে কোনো মাংস তখন অবশিষ্ট ছিলো না।
প্রশ্ন: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে বায়ান্নোর ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনারটি ২৫ মার্চের কালোরাতের পর পাকিস্তানী বাহিনী ভেঙ্গে ফেলে। আপনি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এই ধ্বংসযজ্ঞের তাপ-উত্তাপ কতটা টের পেয়েছিলেন?
সালমা হক: ২৭ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী বায়ান্নোর ভাষা শহীদদের স্মৃতিস্মারক শহীদ মিনারটি ভাঙতে শুরু করে। হায়রে বিকট শব্দ। সারাটা রাত যখন শহীদ মিনার ভাঙছে সেটা একটা ভয়ংকর পরিস্থিতি। সেটা না দেখলে, না কানে শুনলে সেটা কল্পনা করাও যাবে না। সম্ভবত ওরা ডিনামাইট-মর্টার ব্যবহার করছিল এ কাজে। মনে হচ্ছিল এলাকাটায় ভূমিকম্প হচ্ছে। শহীদ মিনারটা শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে ফেললো। সকালে দেখলাম শহীদ মিনারটা একবারে মাটির সাথে মিশে আছে। শহীদ মিনারের পিলারগুলো নেই। শুধু সিড়িঁ কয়টা আছে। ঐখানে (সিড়িঁতে) দাঁড়িয়েই ঐ এতটুক মুহূর্তের মধ্যে আরেকটা গ্রুপ এসে হাজির হল। তাদের মধ্যে একজন শুকনা মতো মৌলভী ছিলেন সে বেলা ১০টা-১১টার সময়ই নামাজ পড়তে শুরু করে দিলো। আমি বুঝতে পারলাম মুহূর্তের মধ্যে শহীদ মিনারকে মসজিদ বানানো হচ্ছে আর সেখানে একপাশে বাংলায় মসজিদ আরেক পাশে উর্দূতে মসজিদ লেখা টাঙ্গানো হলো। আমি এটা নিজের চোখে দেখলাম। মৌলভীটা শুকনা মতো ছিলেন আমার এখনও মনে আছে। আমার খুবই অবাক লাগলো মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে শহীদ মিনারকে নামাজ পড়ার মসজিদে পরিণত করা হলো। এটা দেখে খুব খারাপ লাগলো, বিস্মিত হলাম। তারপর আজিমপুরে যেয়ে দেখলাম শ্মশানের মতো পুরো আজিমপুর কলোনীর সব জানলা-দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আনন্দ কোলাহলে ভরা সব শ্রেণির মানুষ থাকতেন যেখানে সেটা তখন মনে হলো এক প্রাণহীন মৃত জনপদ।
প্রশ্ন: ১৯৭১ এর পঁচিশে মার্চের কালোরাতের পর আপনি ও আপনার স্বামী ডা. আজহার কিভাবে এ শহরে থাকলেন ?
সালমা হক: ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ অসুস্থ হয়ে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। ২৫ মার্চের রাতে আক্রমণের পর জগন্নাথ হল থেকে অনেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজে এসে শেলটার নিয়েছিল। তাদের অনেকে গুলিবিদ্ধ ছিলেন। ডাক্তার আজহার ও অন্য ডাক্তাররা মিলে অস্ত্রোপচার করে তাদের গুলি বের করেন। ২৮ মার্চ ’৭১ আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছেড়ে ডা. আজহার নিয়ে পরীবাগে থাকা শুরু করলাম আমার ভাইয়ের বাসায়। ২৪ মে সেখান থেকে চলে আসলাম ২২ নম্বর ফ্রি স্কুল স্ট্রিট হাকিম হাউসে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ডা. আজহার কাজী আলাউদ্দিন রোডের শামীম ব্রাদার্স ফার্মেসীতে বিকেলে রোগী দেখতেন। যুদ্ধের সময়ে হাতিরপুলে নেয়া বাসার কাছেই ‘সাইদা ফার্মেসী’তে সন্ধ্যার পর বসা শুরু করলেন। এটা আমি পছন্দ করছিলাম না। আমি বারবার বলছিলাম, ‘চলো আমরা ইন্ডিয়াতে চলে যাই’। এর ভিতরে আমি প্রেগনেন্ট হয়েছি। এসব বলতে গেলে এখন বুক ভার হয়ে আসে। প্রথম দিকে আমার স্বামী সাইদা ফার্মেসীতে বেশিক্ষণ বসতেন না তাড়াতাড়িই চলে আসতেন। এরপরে আস্তে আস্তে সময় বাড়াতে থাকলেন। আমি বাধা দিলে সে বিরক্ত হতো। সে আমাকে কোনো দিন বলে নাই যে, হাতিরপুলের ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকগুলো গোপন ডেরায় (হাইড আউট) যেতেন। হাতিরপুল এলাকাটা ছিলো ভুতের গলির মতো খুব গিঞ্জি এলাকা। ওখানে মুক্তিবাহিনীর শেলটার বেশি ছিলো বলে অপারেশনও চলতো বেশি। প্রায় প্রায়ই পাকিস্তানি আর্মি এখানে এসে অপারেশন চালাতো। অক্টোবর মাসে এখানে মুক্তিযোদ্ধারা একটা আক্রমণ করে বসে। আমাদের বাসার সামনে সাইদা ফার্মেসীর অপজিটে আলী ফার্মেসীতে একজন নন-বেঙ্গলী রাজাকারকে ধরতে মুক্তিযোদ্ধারা এসেছিল। আমি খুব ভয় পেয়ে বললাম, ‘আপনার আর চেম্বারে বসতে হবে না’। তা কি শোনে আমার কথা। শুনলেন না।
প্রশ্ন: ঊনিশশো একাত্তর সালের পনের নভেম্বর সকালে ডা. আজহারুল হক তাঁর কর্মস্থল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পথে আলবদদের হাতে অপহৃত হন। ঘটনাটা কীভাবে ঘটে?
সালমা হক: একাত্তরের ১৫ নভেম্বর ছিলো সোমবার। ১৫ নভেম্বর ভোর রাত্র থেকেই পুরো এলাকাটা আলবদররা কর্ডন করে রেখে ছিলো সেটা তখন আমরা জানতাম না। সকালে আমি কাজের ছেলেটাকে লন্ড্রির দোকান থেকে ডাক্তার সাহেবের অ্যাপ্রোন আনার জন্য পাঠালে ছেলেটা কিছুক্ষণ পরে এসে বললো যে সেখানে কারফিউ দিয়ে রাখছে আর্মিরা। দোকান খুলতে দেই নাই। এরপরে আমার হাসবেন্ড তাড়াতাড়ি করে উঠে নাস্তা করলো। আমি বাধা দিলাম কিন্তু শুনলো না। বললো যে, ‘ঘরে থাকলেও তো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ফোন দেই যদি এ্যাম্বুলেন্স পাঠায় তাহলে আমি যাবো, না হলে যাবো না’। এ্যাম্বুলেন্স এসেছিলো এবং ওঁরা এ্যাম্বুলেন্সের জন্য গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। এসময় আলবদররা গলির মুখ থেকেই ওঁদের দেখতে পায়। এর কিছুক্ষণ পরই আলবদররা আমাদের বাসায় আসে। ‘ওরা’ ঘরে ঢুকেই একটা সুন্দর করে ‘স্লামালাইকুম’ দেয়। আমি মনে করলাম- এত স্মার্ট এত সুন্দর ছেলে এরা নিশ্চই ভালো মানুষ। এরা তো আর মানুষ মারতে পারে না। দলনেতার সানগ্লাস পরা ছিল যেন তার চেহারাটা চেনা না যায় আর তার মাথার চুল ব্যাক ব্রাশ করা ছিল। সঙ্গে যারা তাদের হাতে আর্মস ছিলো তারা সবাই ইউনিফর্ম পড়া। সেই ইউনিফর্মগুলো ‘আলবদর’ বাহিনীর ইউনিফর্ম। হালকা অলিভ কালারে অলিভ অ্যাস মেশানো। এরকম কালারের ক্যাপও মাথায় দেয়া। প্রত্যেকের বয়স আঠারো বছরের উপরে হবে না। একটু একটু হালকা হালকা গোঁফ উঠেছে। যখন আমাকে বললো, ‘আপনার হাসবেন্ড কোথায়’? আমি বললাম, ‘হসপিটালে চলে গেছে’। তখন ওরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে একটা ইঙ্গিত পূর্ণ হাসি দিলো- যে হাসিটা তখন আমাকে ঐ বয়সে খুব ভাবিত করলো। মনে মনে ভাবলাম ওরা এমন করে হাসছে কেন? এরপরে আলবদর বাহিনীর ছেলেরা আমাদের ঘর সার্চ করলো। আমার বেড রুমে ঢুকে আমার ঘরের সমস্ত কিছু তছনছ করলো। নতুন বিয়ে হইছিলো, চারটা বেতের চেয়ার তার চারটা গোদি ছিলো খালি সেগুলোও উল্টালো, তোষক-বালিশ উল্টালো। তারপর যাওয়ার সময় ‘ডোন্ট মাইন্ড’ বলে চলে গেলো। আমি তো মহা খুশি। আমি মনে করলাম, এরা মনে হয় খুব ভালো। অথচ গলির মুখ থেকে সকাল বেলাই এরা ডা. আজহার ও হুমায়ুন কবীরকে তুলে নিয়ে যায়। সেটা আমি পরে জানতে পারলাম। এরপর শুরু হলো খোঁজাখুজি। আমার ভাই-দুলাভাই রমনা থানায় আর ঢাকা মেডিকেলে গেলেন। রমনা থানা থেকে বলা হল- ১৫ তারিখ ভোর রাত্র থেকে আলবদর বাহিনী হাতিরপুল এলাকা, সেন্ট্রাল রোড ও ভুতের গলি কর্ডন করে রাখে এবং পাকিস্তান আর্মির মেজর আসলাম ও ক্যাপ্টেন তাহের ঐ আলবদর গ্রুপটির নেতৃত্ব দিচ্ছিল।
ডা. আজহারের লাশ পাওয়া গেলো ১৬ নভেম্বর নটরডেম কলেজের পাশের কালভার্টের নিচে। ওখানে কচুরিপানা আর কাঁদামাটির ভিতর তাঁর ডেডবডিটা হাত-পা-চোখ বাঁধা অবস্থায় দাবানো ছিলো। আমার হাসবেন্ড ডা. আজহারকে সেখানে আগে ফেলেছে আর ডা. হূমায়ন কবীর ছিলেন তাঁর উপরে। দু’জনেরই হাত মুঠ করা অবস্থায় ছিলো আর তাঁদের দু’জনেরই মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের ভিতরে ছিলো ‘মাটি’। মাটি ধরা হাত দুটো হয়তো শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত বাঁচতে চেষ্টা করেছিল এ মাটি আঁকরে ধরে থেকে।
প্রশ্ন: ডা. আজহারের দাফন-কাফন কিভাবে হল? স্বামীর মৃতদেহ দেখে সেদিন শোক প্রকাশ করতে পেরেছিলেন?
সালমা হক: ডা. আজহারের ডেডবডি নটরডেম কলেজের পাশের কালভার্টের নিচ থেকে পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর হাত-পা, চোখ ছিল বাধা। তাঁর পড়নে ছিল শুধু জাঙ্গিয়া। মৃতের প্রতি নূন্যতম শ্রদ্ধাবোধ সম্ভবত এদেশীয় ঘাতকদের ধর্মে নেই তাই তারা ডা. আজহার ও ডা. হুমায়ুন কবীরকে এভাবে অপমান, অশ্রদ্ধা আর অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে হত্যা করে ফেলে রেখেছিল। আমার স্বামীর মৃত্যুর পর আমি ভালো করে শোক প্রকাশ করতে পারিনি। আমাকে কাঁদতেও দেয়া হয়নি। ঐ সময় শাহবাগ রোডে সার্বক্ষনিক পাকিস্তানি মিলিটারির জিপ আসা-যাওয়া করতো তাই পরিবারের অন্য সদস্যদের নিরাপত্তা স্বার্থেই চুপ থাকতে হয়েছিল। চিৎকার করে যে কাঁদবো সে পরিস্থিতি ছিল না। একমাস পর যখন ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো তখন দূর থেকে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শুনতে পেলাম। আর তখনই বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত আমার ভেতরে আটকে থাকা বোবা কান্নার ঢেউ তোলপাড় করে বেরিয়ে এলো। সেদিন মন উজার করে কেঁদেছিলাম আর তখনই বেশি করে উপলব্ধি করেছিলাম ‘ডাক্তার’ নেই।
প্রশ্ন: ডাক্তার স্বামীর সঙ্গে স্বল্পতম সময়ের সংসার জীবন কে আপনি কি বিধিলিপি মনে করেন ?
সালমা হক: পাকিস্তানীদের থেকেও আমার বাঙালীদের উপর ক্ষোভটা বেশি। পাকিস্তান প্রীতি আমার নাই কারণ ওরা তো ওদের স্বার্থের কারণে এটা করেছে বা করছে কিন্তু আমরা বাঙালী হয়ে কেনো এত বড় ক্ষতি করলাম আমাদের? এজন্যই আমি টুপি দাড়িওলা লোক, হিজাব পড়া কাউকে দেখতে পারি না। মানুষ হয়তো মনে করবে আমি নাস্তিক। আমি সত্যি সত্যি মানসিক ভাবে এরকম হয়ে গেছি। এখন কেউ বেশি ধর্মের কথা বললে আমি একটু বিরক্ত হই। আমরা বাঙালীরাই তো বাঙালীদের এতবড় ক্ষতিটা করলাম। ‘স্লামালাইকুম’ দিয়েই সেদিন আলবদররা আমার বাসায় ঢুকেছিল।
প্রশ্ন: শহীদ ডা. আজহারের একমাত্র সন্তানকে কিভাবে বড় করলেন ? আপনার ও আপনার সন্তানের বেঁচে থাকার লড়াইটা কেমন ছিল ?
সালমা হক: ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ‘স্বাধীন’ হলো। ১৪ জানুয়ারি ’৭২ আমার একমাত্র সন্তান ‘নিশান’-এর জন্ম হলো। ডাক্তারের মৃত্যুর পর আমি আমার শিশু সন্তান নিয়ে অথৈ সাগরে পড়লাম। শুরু হল আমাদের অর্থনৈতিক নিদারুন কষ্ট। এটা বলা খুব কঠিন। আমার হাসবেন্ডকে যখন ওরা ধরে নিয়ে গেলো তখন তাঁর একাউন্ডে ছিল মাত্র একশত উনপঞ্চাশ টাকা আর আলবদররা বাসা সার্চ করে চলে যাওয়ার পর একটা অগোছালো খামের ভিতরে পেলাম তিনশ টাকা। এই ছিল আমার সম্বল। বাচ্চার জন্য দুধ কেনা প্রয়োজন। প্রথম দিকে ভাইরা দুই-একটা করে দুধের টিন কিনে দিতেন। তখন তো আমার নিয়মিত কোনো আয়ের ব্যবস্থা নাই। কি করবো―আমার সব কাজিনদের বাসায় নিয়ে আসলাম। ঠিক হলো ওদের সাথে আমি খাওয়া-দাওয়া করবো বিনিময়ে ওদের কোনো বাড়ি দেয়া ভাড়া লাগবে না এখানে। এভাবে আমি থাকা শুরু করলাম। আমি নিজের বাসায় নিজেই মেহমান হয়ে গেলাম। আমার ভাই আত্নীয়-স্বজনরা ৫টা রেশন কার্ড যোগাড় করে দিলেন। ঐ সময় রেশন কার্ড থেকে গম বেশি দিতো। গমের দামও ছিলো। তাই আমি ঐ রেশনের পুরো গমটা তোলার পর সব গম বিক্রি করতাম। যে টাকাটা হতো একশ টাকা হোক বা দেড়শো হোক ওইটা দিয়ে কিছু দিন চলতো। কোনো নিশ্চয়তা ছিল না আগামী কাল কীভাবে চলবে। কিছুদিন পর স্বামীর গ্রুপ ইনস্যুরেন্সের ৫ হাজার টাকা পেলাম সাথে বঙ্গবন্ধুর ত্রাণ তহবিল থেকে পেলাম আরও ২ হাজার টাকা। এই মোট ৭ হাজার টাকা বিভিন্ন লোকের কাছে তাদের ব্যবসায়ে খাটানো শুরু করলাম। কেউ ৫ হাজারে ২০০ টাকা দেয়। কেউ ১০০ টাকা দেয়। দেখা যায় যখন যার ব্যবসা চলছে না সে এসে সব টাকা ফেরত দিয়ে যায়। আবার মাথায় পাহাড় ভেঙে পড়ে। সেজন্য এটা বলাটা খুব-খুবই ডিফিকাল্ট। গ্রামে-গঞ্জে যারা ছিলেন তাঁদের কথা বলতে পারবো না তবে আমি শহরে মধ্যে একজন চিকিৎসকের ওয়াইফ হিসাবে খুবই কষ্ট করেছি, এখনো করছি। পরবর্তীতে আমার আব্বা কিছু জায়গা দিয়ে গেছিলেন সেগুলো পরে বিক্রি করে সামান্য কিছু টাকা পাই তা এমন বেশি কিছু ছিল না। কোনো রকমে ঢাকা শহরে টিকে থেকে ছেলেটাকে খুব কষ্ট করে মানুষ করেছি। বঙ্গবন্ধু নিজে গণভবনে আমাকে চাকরি দিয়েছিলেন। করতে পারলাম না। করা উচিত ছিলো। ঐ সময় ইমোশনটা কাজ করেছে বেশি। এখন ভাবি আমার ক্যারিয়ারটা ভালো থাকলে আমার নিজের পড়ালেখাটা চালাতে পারতাম আর আমার বাচ্চারও মন মানসিকতায় এর প্রভাব পড়তো।
প্রশ্ন: শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও আপনি একই পাড়ায় থাকতেন। তাঁর সাথে কিভাবে আপনার পরিচয় হয়েছিল ?
সালমা হক: জাহানারা ইমাম এ পাড়াতেই থাকতেন। ’৭৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসে আমি এলিফ্যান্ট রোডের এই বাসায় (বর্তমান) আসি। আমিই একদিন যেয়ে আলাপ-পরিচয় করলাম ওঁনার সাথে। বললাম- বিচিত্রায় আপনার লেখা পড়েছি। আমার হাসবেন্ড শহীদ ডা. আজহারুল হকের কথাও বললাম। উনি আমার হাত দুইটা ধরে চোখ বন্ধ করে থাকলেন যেমন এক মিনিট নিরবতা পালন করে ওই রকম। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি গড়ালো আমার। এইভাবে আমার পরিচয় তাঁর সাথে। এরপর মাঝে মধ্যেই যেতাম। টুকটাক আমার কোনো সমস্যা হলেই আলাপ করতাম। মুরব্বী হিসাবে তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন আর আমার ছেলে নিশানকে খুব ভালোবাসতেন। আমার ছেলে তাঁকে দাদী বলে ডাকতো। আমার ছেলেরই প্রথম দাদী সে। এরপরে প্রজন্ম ’৭১-এর সবাই তাঁকে দাদী বলা শুরু করলো। এরপরে তিনি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি করলেন। তখন আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম। ১৯৯২ সালে গণআদালতে গোলাম আযমের প্রতীকি বিচারের দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমি উপস্থিত ছিলাম। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ কোথা থেকে যে এসেছিল। আমরা দিক ঠিক করতে পারছিলাম এরকম অবস্থা হয়েছিল সেদিন।
এছাড়া এরশাদ বিরোধী আন্দোলন যখন চলছে তখন একদিন নিশানকে পুলিশ খুব মেরেছিলো। নিশান তখন ছোট। বাড়ির সামনে সে বেডমিন্টন খেলছিলো। আর প্রিকেটাররা সেখানে আগুন দেয় মিউনিসিপ্ল্যাটির গাড়িতে। আগুন দিয়ে প্রিকেটাররা সবাই দৌড়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ ভিতরে ঢুকে দেখতে পায় নিশানকে। নিশানকে তো তারা পিটাতে পিটাতে গাড়িতে তুলছে। আমি তাড়াতাড়ি নেমে এসে পুলিশের হাত থেকে নিশানকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য চিৎকার শুরু করলাম। সেদিন আমার এমন রাগ উঠে গেছিল যে, আমি চিৎকার করে বলেছিলাম- ‘যার বাবার রক্তের বিনিময়ে দেশ তার গায়ে হাত দেয়ার এত বড় সাহস, এত বড় স্পর্ধা আপনাদের’। তখন ঐ পুলিশগুলো বললো ‘বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হইছে তো কি হইছে। আপনি এতবড় কথা বলবেন না। এ রকম হলে আপনাকেও উঠায়ে নেয়া হবে’। তখন জাহানারা ইমাম এটা বারান্দা থেকে দেখে বললেন- ‘আল্লাহ, সালমা কি করছো! মাথা গরম করো না’। উনি সাথে সাথে নিচে নেমে এসে নিশানের হাতটা ধরলেন। নিশানের ঠোঁট দিয়ে তখন রক্ত বেরুচ্ছিল। উনি পুলিশের হাত থেকে নিশানের হাতটা নিয়ে আমাকে বললেন, ‘সালমা তুমি ওকে নিয়ে বাসায় চলে যাও। যেয়ে ওর ঠোঁটে বরফ দাও। আর আমাকে কথা বলতে দাও’। এরপর উনি পুলিশকে বলতে লাগলেন- ‘দেখো এই মেয়েটা আসছে ’৭৩ সালে ছোট একটা বাচ্চা কোলে করে। ও একটা ইনোসেন্ট বাচ্চা শহীদের ছেলে। ও কোনো ছেলে পেলের সাথে খুব একটা মেশেও না’। আমি চলে আসার পরই পুলিশ আবার আমার বাসায় আসলো। তারা এসে পুরো বাড়ি সার্চ করলো। ঐ সেই ’৭১ সালের মতো। আমার মেজাজ আবার গরম হয়ে গেলো। স্বাধীন দেশেও কি আমার ঘর আবার সার্চ করা হবে? আমার ছেলে কি এরশাদ বিরোধী ঐসব জায়গায় যায়? না আমি সেটা যেতে দেই! তার তো তখন অত বয়সও না। স্কুলে পড়ে। যাহোক- জাহানারা ইমাম আবার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করলেন। উনি ছিলেন বলেই আজকে আমরা একাত্তরের ঘাতক-যুদ্ধাপরাধীদের বিচারটা শুরু করতে পারলাম। অবশ্য শাহরিয়ার কবীররা এই আন্দোলনটাকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সে সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ছাপানো লিফলেটগুলো জাহানারা ইমাম আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ে বলতেন- ‘সালমা লিফলেট গুলো তুমি নিশানকে দিয়ো বিলি করো’। আমার ছেলে নিশান প্রথম দিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়েছিলো। ও মনে করতো ওর বাবার হত্যাকারীদের বিচার একদিন হবেই। সে আশাতেই সে উদ্বৃদ্ধু হয়ে এর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিল।
প্রশ্ন: ডা. আজহার কেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন ?
সালমা হক: ডা. আজহাররা যে ‘বাংলাদেশ’ দেখতে চেয়েছিলেন সে রকম বাংলাদেশ এখনো হয় নাই। এখন তো খালি হিজাবই দেখি। পাকিস্তান আমলেও আমরা এত হেজাবধারী দেখি নাই। এত বোরকা পড়া দেখি নাই। আমার মনে আছে তখন আমার টিনএজ। নিউমার্কেটে যেতাম সেখানে দু’একজন নন-বেঙ্গলীকে দেখতাম বোরকা পড়া- তাও অ্যাপ্রোনের মত বোরকা। আজকের মতো এ রকম নাক-চোখ বান্ধা ছিলো না। এখন এরা তো খুব বেশি মুসলমান হয়ে গেছে। একাত্তরে আলবদররা কি খালি খালি সানগ্লাস পড়ে আসতো? সানগ্লাস পড়ে আসতো যাতে মানুষ তার চোখ দেখতে না পায়। চোখ দিয়েই তো মানুষ মানুষকে চেনে।
প্রশ্ন: আপনি একাত্তরের ঘাতক-দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে স্বাক্ষ্য দিয়েছেন। বিচার চলাকলীন সময়ের অনুভূতি কেমন ছিল?
সালমা হক: যুদ্ধাপরাধীর পক্ষের উকিলরা এমন এমন সব জেরা করেছে যেগুলো অপ্রতাশিত ছিল। যেমন, প্রশ্ন করেছে- ‘আপনি তো এতদিন ইন্টরভিউ দিয়েছেন তার ভিতরে তো নিজামীর কথা বলেন নাই’। তখন আমি বলেছি- ‘এরা তো সবাই ঐ সময় ইসলামি ছাত্র সংঘ করতো এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একজন ডাক্তারই আমাদেরকে এই খবরটা জানিয়ে ছিলেন’। যাহোক, আমি মনে করি যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে এজলাশে দাঁড়িয়ে স্বাক্ষ্য দেয়াটা আমার জীবনের একটা পরম প্রশান্তির বিষয়। আমার স্বামীর আত্মা তাতে কিছুটা হলেও শান্তি পাবে। আমি একাত্তরে এ দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছি। এখনও আবার সেটা করলাম।
প্রশ্ন: আপনার স্বামী শহীদ ডা. আজহারুল হক একজন দক্ষ শৈল্য চিকিৎসক ছিলেন। আজ যখন কোনো চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসার জন্য যান তখন আপনার কেমন অনুভূতি হয় ?
সালমা হক: আমার হাসবেন্ড নতুন পাস করা ডাক্তার হলেও সার্জারিতে তাঁর সুনাম ছিলো। বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাবার ট্রিটমেন্ট- তাদের পরিবারের ট্রিটমেন্ট আমার হাসবেন্ড করতেন। সাংবাদিক আতাউস সামাদের ফ্যামেলির হাউস ফিজিসিয়ান ছিলেন ডা. আজহার। চিকিৎসার জন্য আমাকেও ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। হয়তো দীর্ঘ সিরিয়াল থাকে তখন বসে থাকি। তখন মনে হয় একজন ডাক্তার দিনে কত হাজার টাকা ইনকাম করে? যদি আমার হাসবেন্ড আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে কী সে ওরকম পর্যায়ে যেতেন? যদিও শহীদ পরিবারের সদস্য বলে এ শহরের অনেক চিকিৎসকই আমার কাছ থেকে ফি নেন না। সে জন্য আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। পাশাপাশি এটাও আমার মনে হয় আমার ডাক্তার স্বামী বেঁচে থাকলে আজ আমি কোথায় থাকতাম বা কেমন থাকতাম? আর আমার ছেলে নিশানই বা কেমন থাকতো? অনিশ্চয়তায় ভুগে ভুগে ছেলেটা অসহায় অবস্থার মধ্যেই বড় হল। পড়ালেখায় ওর খুব ভালো রেজাল্ট হয়নি। ওর বাবা থাকলে হয়তো এগুলো হতো না। ও এখন বড় হয়ে প্রায়ই আমাকে এসব বলে দূর থেকে। রাতের বেলা যখন ভাইবারে কানাডায় ওর সাথে কথা বলি তখন ও ছোট বেলার কথা খালি শুনতে চায়। ছোটোবেলায় আমি ওকে একদিন মেরেছিলাম। সে কথা মনে করে একদিন বললাম, ‘তোমারে না আমি মারি’। তখন ও বলে, ‘ওই মারাও ভালোবাসা’। ছোটবেলায় ‘র’ বলতে পারতো না, বলতো ‘মালাও ভালোবাসা’।
সাক্ষাৎকার অনুলিখন: নাফিসা হাসান প্রকৃতি