ফজিলাতুন নেছা মুজিব বহুগুণে গুণান্বিত একজন পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন। যার উপমা তিনি নিজেই, অনন্য বৈশিষ্ট্যে অতুলনীয়। তুখোড় ছাত্রনেতা, ভাষা সৈনিক ও রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর কট্টর সমালোচক অলি আহাদ ফজিলাতুন নেছা মুজিব সম্পর্কে বলেছেন, “মুজিব সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন নেছা আমাদের সম্মানিত ভাবী। তার ত্যাগ-তীতিক্ষা-প্রজ্ঞা আর কষ্ট সহিষ্ণুতা অতুলনীয়। রাজনৈতিক কারণে মুজিব ভাই বছরের পর বছর কারাগারে কাটিয়েছেন।
কারাগারের বাইরের জীবনও ছিল আন্দোলন সংগ্রাম আর সংগঠন দিয়ে ব্যাপৃত। অন্যদিকে ভাবী সংসার চালানো, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া থেকে শুরু করে দেশের রাজনৈতিক গতিবিধি আর দলের নেতাকর্মীদের খোঁজখবর রাখতেন। প্রয়োজনে উপদেশ দিতেন, বুদ্ধি দিতেন। দুর্যোগ দুর্বিপাকে কখনো তিনি মুষড়ে পড়তেন না। সাহস হারাতেন না। বুদ্ধিমতি ও সাহসী এই মহিয়সী নারী নেপথ্যে থেকে এদেশের রাজনীতিতে অনেক অবদান রেখেছেন। অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। অনেক দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন।
বিশেষ ক্ষেত্রে সংকটময় মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে মুজিব ভাইকে সহযোগিতা করেছেন। অনেক সময় তাঁকে প্রভাবিতও করেছেন।” অলি আহাদ বেশ কয়েকটি উক্তির মাধ্যমে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সামগ্রিকতাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। সংগ্রামী, পরিশ্রমী, মেধাবী, স্বামী ভক্ত, রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান, দেশপ্রেমিক, দায়িত্বশীল, সততা, নিষ্ঠাবান, পরোপকারিতা ইত্যাদি সকল গুণে গুণান্বিত ফজিলাতুন নেছা মুজিব।
একজন আদর্শ মানুষের প্রতিকৃতি হিসেবে ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে মূল্যায়ন করা যায়, তিনি একদিকে দায়িত্বশীল মা, সাংসারিক, স্বামীর প্রতি আনুগত্যশীল, প্রতিবেশি-আত্মীয়স্বজন এবং রাজনৈতিক কর্মীদের নিকট পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে পরিগণিত হয়েছিলেন নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ও অসাধারণ বুদ্ধিমত্তায়। বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ফজিলাতুন নেছাদের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত, অবশ্য ফজিলাতুন নেছারা কালের বিবর্তনে খুব সামান্য হারেই দুনিয়ায় সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় আবির্ভূত হয়ে থাকেন।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে, দেশ বিনির্মানে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে সবাই যেমন এক বাক্যে স্বীকার করেছেন ঠিক তেমনিভাবে ফজিলাতুন নেছার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আমাদের কোন ইতিহাসবেত্তা, রাজনীতিবিদ, প্রাবন্ধিক, কবি কিংবা প্রথিতযশা লেখক কোন মহাকাব্য রচনা করেননি। কিন্তু ফজিলাতুন নেছা মুজিব জীবনের শুরু থেকে মৃত্যু অবধি শেখ মুজিবকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন। শেখ মুজিবের প্রত্যেকটি কাজে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অনস্বীকার্য অবদান ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাঙালির মুক্তি আনয়নে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের রণকৌশল ও বুদ্ধিভিত্তিক সিদ্ধান্ত শেখ মুজিবের কাজটাকে অনেক সহজ করে দিয়েছিল। অধিকাংশ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো বিশেষ করে রাজনৈতিক সংকটে ফজিলাতুন নেছা মুজিব গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়ে সংকট উত্তরণে ভূমিকা রাখতেন।
এ কথা আজ স্পষ্টতই প্রমাণিত যে, ফজিলাতুন নেছা রেণুর মতো মমতাময়ী, চৌকস ও প্রজ্ঞাবান স্ত্রী না থাকলে শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা হতো না। নির্দিষ্ট প্রবন্ধে ফজিলাতুন নেছা মুজিব কর্তৃক বাঙালির আন্দোলন, সংগ্রাম ও স্বাধীকার আন্দোলনে ভূমিকার প্রসঙ্গ চুম্বক ভাবে তুলে আনা হয়েছে, আর এতেই প্রমাণিত হয় দেশ মাতৃকার টানে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অবদান তাৎপর্যপূর্ণভাবে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন, বিনির্মাণ ও সামাজিক কার্যক্রমকে সুসংহত করবার প্রয়াসে ফজিলাতুন নেছা রেণু দেশের মানুষকে ও তাঁর স্বামীকে যে অনুপ্রেরণা, সাহস ও প্রত্যয়ের যোগান দিয়েছেন তা রাজনৈতিক দৃষ্টান্ত হিসেবে ইতিহাসের কাঠগোড়ায় অমরত্ব লাভ করেছে। অসাধারণ প্রতিভাধর ফজিলাতুন নেছা তার দূরদর্শিতা, সাহস, মনোবল, বিচক্ষণতা দিয়ে সাংসারিক, পারিবারিক ও রাজনৈতিক ইস্যুগুলোকে মূল্যায়ন ও সমাধানের চেষ্টা করেছেন এবং সে ক্ষেত্রে তিনি সফলতার মাপকাঠিতে অনন্য মর্যাদায় আসিন। ফজিলাতুন নেছার নেপথ্যের রাজনৈতিক ভূমিকা, সিদ্ধান্ত, কর্মদক্ষতা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের অমূল্য সংযোজন। রেণুর রাজনৈতিক দর্শন ছিল মানুষের কল্যাণ, দেশের মুক্তি ও জনগণের উন্নয়ন। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তিনি তা প্রমাণ করে গিয়েছেন। মানুষকে মানবিক ও সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখার মোক্ষম বন্ধন ও সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করতেন তিনি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সৃষ্টির সহিত বঙ্গজননীর জীবন পরিক্রমার মূল্যায়ন গভীরতা ও ব্যাপকতায় সামাজিক বিন্যাসকে সুসংহত করার প্রয়াসে নিবিষ্ট মূল্যায়ন।
ফজিলাতুন নেছার সামগ্রিক জীবনকে মূল্যায়ন করতে হলে নিচের পঙতিটুকু উৎসর্গ করা যায়।
রেখেছো আগলে ধরে সারাটি জীবন
অথচ নিজে ছিলে নিশ্চুপ, নির্লোভ
প্রজ্জ্বলিত হয়েছিলে আপন মহিমায়
অকাতরে করে গেলে জীবন দান
বাঙালির মুক্তি কামনায়।
তুমিই বঙ্গজননী, বাঙালির নয়নের মণি
শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব।
বর্তমান সময়ের প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য ও আমির হোসেন আমু এমপি বঙ্গমাতার স্মৃতিচারণ করে বলেন ‘বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব জানতেন না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু হবেন। তবে বঙ্গমাতা বেগম মুজিব জানতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। বেগম মুজিব কখনো কোন কিছুর জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে কোন অনুযোগ করেননি। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’ রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রাক্তন জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের স্মৃতিচারণ করে উল্লেখ করেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব না থাকলে হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন হতো। এই পৃথিবীতে যত নেতা রাজনীতির মাঠে সফল হয়েছেন তার পেছনে ছিলেন একজন নারী। আর বঙ্গবন্ধুর পেছনে বঙ্গমাতা ছিলেন বলেই তিনি বঙ্গবন্ধু ও জাতির জনক হতে পেরেছিলেন।’
সমাপ্ত