চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

স্মার্ট ফোন, ডিএসএলআরের যুগে বিলুপ্তির পথে স্টুডিও ব্যবসা

রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে ২০ বছর ধরে ‘ফটো পয়েন্ট’ নামে একটি ফটো স্টুডিও চালান বিপ্লব আহমেদ। একসময় ছিল রমরমা ব্যবসা। সারাদিন স্টুডিও থাকত লোকে লোকারণ্য। কাজর চাপে কারও সাথে কারও কথা বলার ফুসরত ছিল না। বসার জায়গা দিতে পারতেন না। ১৫ জন কর্মচারী সকাল দশটা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতো। দিনে স্বাভাবিকভাবেই অন্তত বিশ হাজার টাকায় আয় করতেন বিপ্লব।

এখন চিত্র ভিন্ন। যেন পাশার দান উল্টে গেছে। আয়-রুজি কেমন হয় জানতে চাইলে ক্যাশবাক্স খুলে দেখান বিপ্লব। বলেন, ‘সারাদিনে আড়াইশ টাকা আয় হয়েছে। এমন দিন আছে একটা টাকাও আয় হয় না। স্টুডিওতে বসে থেকে দিন যায়।’

এমন দৃশ্য শুধু ‘ফটো পয়েন্ট’র না, রাজধানীর বেশকিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেল একই চিত্র। দু’একজন ছাড়া কারও হাতেই কাজ নেই। কিন্তু কেনো এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো?

জবাবে বিপ্লব আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘২০১২ সাল পর্যন্ত ব্যবসা ছিল। সারাদিন অফিসে কাস্টমার যাতায়াত করত। দলে দলে মানুষজন ছবি তুলতে আসত। নতুন জামাই-বউ ছবি তুলতে আসত। স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানের আগে ছেলে-মেয়েরা দলবেঁধে আসত ছবি তুলতে।বিশজন ছাত্র-ছাত্রী একসাথে ছবি তুলে সেই ছবি বিশ কপি বাঁধাই করে প্রত্যেকের ঘরে এক কপি করে রাখত। বিয়ে, গায়ে হলুদসহ যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে ফটোগ্রাফার নিয়ে যেত।’

“বিয়ে বাড়ির ভিডিও করত। স্টাডি ট্যুর, হানিমুনে ফিল্ম ক্যামেরা ভাড়া করে নিয়ে যেত। এরপর সব ছবি প্রিন্ট করে অ্যালবামে সাজিয়ে রাখত। এখন ডিজিটাল ক্যামেরা এসেছে। ডিসএলআর ক্যামেরা হাতে হাতে। স্মার্টফোনেই সব কাজ করা যায়। ছবি ফেসবুকে দিয়ে রাখলে সারাজীবন থাকে।”

আর এসব কারণে স্টুডিও, ক্যামেরা ম্যান, ডার্করুমসহ বেশ কিছু জায়গায় কর্মচারীরা কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ বেছে নিচ্ছে বিকল্প জীবিকা। কেউ গ্রামে গিয়ে হালচাষ করছে। কেউ বিদেশ চলে যাচ্ছে। কেউ পোশাক কারখানায় কাজ নিচ্ছে। ফলে স্টুডিও ব্যবসা দিন দিন বিলুপ্তির পথে, এমনটাই জানালেন বিপ্লব আহমেদ।

‘ফটো পয়েন্টে’র পাশেই ‘স্টুডিও ফটোওয়ার্ল্ড’। আশির দশক থেকে বিশাল দোকান ভাড়া নিয়ে স্টুডিওর ব্যবসা করছেন কয়েক বন্ধু মিলে। ফটোওয়ার্ল্ডের মোঃ আক্কাস চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘একসময় এই স্টুডিওতে একশ কর্মচারী খাটতো। এখন আমরা তিনজন বসে আছি। সারাদিনেও কাস্টমার পাই না। বেকার বসে থাকতে হয়। দোকান ভাড়া ওঠে না।’

তাহলে ব্যবসা চলছে কিভাবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্যবসা চলছে না। আমরা যারা জীবনের শুরুতে স্টুডিও ব্যবসার সাথে জড়িয়ে গেছি তারা ইচ্ছে করলেও ভালোবাসার এই পেশা ছাড়তে পারি না। তাই পড়ে থাকতে হয়।’

স্টুডিও পড়ে আছে। লোকজন নেই। রাজধানীর বেশির ভাগ ফটো স্টুডিওর চিত্রই এমন।
স্টুডিও পড়ে আছে। লোকজন নেই। রাজধানীর বেশির ভাগ ফটো স্টুডিওর চিত্রই এমন।

এখন তো ওয়েডিং ফটোগ্রাফি, মডেলিং ফটোগ্রাফিসহ আধুনিক সব ফটোগ্রাফি জনপ্রিয় হচ্ছে। সেদিকে নজর দিচ্ছেন কি না- জানতে চাইলে ফটো পয়েন্টের বিপ্লব আহমেদ বলেন, ‘বাইরে থেকে দেখা যায়। জনপ্রিয় হচ্ছে এটা সত্য। কিন্তু কাজগুলো করছে কারা এটা বাইরের মানুষ জানে না। সব কাজ চলে যাচ্ছে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টদের হাতে। তারা বাবুর্চি থেকে শুরু করে স্টেজ সাজানো, চেয়ার টেবিল ঠিক করে দেওয়া, ফটোগ্রাফির সব কাজ করে। স্টুডিওর কোনো সুযোগই নেই।’

প্রায় একই কথা বললেন, ফকিরাপুলের ‘মিতা স্টুডিও’র মালিক আব্দুল মতিন। তিনি বলেন, ২০১০ সালে আমার দোকানে পঁচিশজন কর্মচারী ছিল। এখন আমি আর আমার ছেলে বসি। পাসপোর্ট এর ছবি তুলি দিনে দুই চারটা। এই দিয়েই চলি। দোকানের অর্ধেক ভাড়া দিয়েছি। না হলে চলতে পারতাম না। মোবাইল এসে ব্যবসাটাকে ধসিয়ে দিল।’

মিরপুর সনি সিনেমা হলের গা ঘেঁসে গড়ে উঠেছে কয়েকটা স্টুডিওর দোকান। সেখানকার ‘প্রিয়াঙ্কা স্টুডিও’র মালিক বাতেন মণ্ডল বললেন, এককালে প্রচুর ব্যবসা ছিল। মাসের বেতন পেলে গার্মেন্টস এর ছেলে-মেয়েরা ছবি তুলতে আসতো। ফুল, লতা-পাতা, পাহাড়ের ছবির সামনে বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলত। সেটা লেমিনেটিং করে ঘরে রেখে দিত। অনেকে নেগেটিভ নিয়ে আসত ছবি প্রিন্ট করার জন্য। সব বন্ধ হয়ে গেছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও ডিএসএলআর কিনেছি। কিন্তু ছবি তোলার লোক নেই।’

ছেলে মেয়েদের হাতে হাতে ডিএসএলআর-স্মার্টফোন হওয়ায় এই অবস্থা বলে তিনি জানান। এই ব্যবসা ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই বলেও জানান বাতেন মণ্ডল।