মহামারির রূপ নিতে যাচ্ছে ডেঙ্গু। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। বাড়ছে মৃত্যু। সরকারি হিসাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ১৪ জন বলা হলেও এটা এখন প্রায় সত্তরের কাছাকাছি বলে বেসরকারি সূত্রগুলো বলছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই (ঢামেক) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১০ জন।
প্রতিদিন গড়ে প্রায় দেড় হাজার রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। মিনিটে একজন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নেই। ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ৬৪ জেলায়। ঈদুল আজহায় রাজধানী ছাড়বেন লাখো মানুষ। বেশিরভাগই যাবেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। অনেকেই নিজের শরীরে বহন করবেন ডেঙ্গুর ভাইরাস। তাদের মাধ্যমে ডেঙ্গু পৌঁছে যাবে দেশের আনাচে-কানাচে।
এ ছাড়া এখন আগস্ট মাস; ডেঙ্গু প্রজননের ভরা মৌসুম। চলবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। অনেকের আশঙ্কা, অতিদ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলে ঘটে যাবে ভয়াবহ বিপর্যয়। কিন্তু মশা নিধনের কার্যকর ওষুধ দেশে নেই। যে টুকু আছে, তাতে মশা মরে না। ওষুধ আনতে হবে বিদেশ থেকে। যখন পরিস্থিতি চরমে, তখন মাত্র ওষুধ আনার তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
সর্বশেষ যে ওষুধের নমুনা আনা হয়েছে, সেটা নাকি পানির সঙ্গে মিশিয়ে ছিটাতে হবে। কিন্তু তেমন যন্ত্র সিটি করপোরেশনের নেই। বর্তমানে সিটি করপোরেশন যেসব মেশিন ব্যবহার করছে, সেগুলো ডিজেল মিশ্রিত ওষুধ ব্যবহারের উপযোগী। এসব মেশিনে পানির মিশ্রণে তৈরি ওষুধ ব্যবহার করা যায় না। নতুন ওষুধ আনতে সময় লাগবে।
মেশিন যদি আনতে হয়, তাহলে মশা নিধনের সময় পার হয়ে যাবে। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র জানিয়েছেন, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ আগস্টজুড়ে রাজধানী থাকবে এডিসের দখলে। এই সময় দেশের মানুষ কি বসে বসে আল্লাহ আল্লাহ করবে?
ডেঙ্গু নিয়ে সরকার, প্রশাসন, সিটি করপোরেশন কেউই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেনি। গত বছর দুই সিটি করপোরেশনের অনুমতি নিয়ে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানীরা ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করেন। ওই বছরের ২২ মে ফলাফল প্রকাশ করা হয়। বলা হয় ওষুধ অকার্যকর। কিন্তু ওষুধ পরিবর্তনের উদ্যোগ না নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আবার তা পরীক্ষা করা হয়েছিল। আবারও সেই একই ফল আসে, ওষুধ অকার্যকর।
তারপরও সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়েনি। মশার ওষুধের ব্যাপারে সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরা কেবল পরস্পরবিরোধী মন্তব্য করেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মশা মারার যে ওষুধ আছে, তা অনেকটা অকার্যকর।
অন্যদিকে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, মশার ওষুধ পরীক্ষার পর দেখা গেছে, ওষুধে কোনো সমস্যা নেই। তাহলে কে সত্যি কথা বলছেন, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী নাকি স্থানীয় সরকারমন্ত্রী? সবচেয়ে বড় প্রহসন হচ্ছে, অকার্যকর জেনেও ওই মশার ওষুধই ব্যাপক আয়োজন করে ছিটানো হচ্ছে। উত্তর সিটি করপোরেশন যে ওষুধ অকার্যকর বলে বাতিল করেছে, তা ব্যবহৃত হচ্ছে দক্ষিণে। এমন হাস্যকর কাণ্ড ঘটাচ্ছেন দুই মেয়র।
মানুষের দুর্ভোগের দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখে দেশের উচ্চ আদালত দুই সিটি করপোরেশনের কাছে বেশ কিছু প্রশ্ন রেখেছেন।
১৭ জুলাই শুনানিতে সিটি করপোরেশনের আইনজীবীকে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। পদক্ষেপ নেননি। মেয়র বলেন কিছু হয়নি। ডেঙ্গুতে কয়েক হাজার মানুষ অসুস্থ। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেন। যার সন্তান মারা গেছে, সে বোঝে কষ্টটা কী’।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক মন্তব্য করে হাইকোর্ট আরও বলেছেন, ‘ঘরে ঘরে মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। অনেকে হাসপাতালে যান না, গেলে এ সংখ্যা বেশি হতো। মানুষের জীবন আগে বাঁচাতে হবে। আমরা চাই মশা মরুক।’ হাইকোর্টের প্রশ্ন—রাষ্ট্রের এত মেশিনারি থাকতে এটি (ডেঙ্গু) রিমুভ করা যাবে না কেন?’
আদালত যত কথাই বলুন কেন, বাস্তবতা হচ্ছে, রাষ্ট্রের মেশিনারিজ যথাযথভাবে কাজ করছে না। বর্ষা শুরুর আগে ডেঙ্গু নিয়ে গত মার্চ মাসেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডাক্তার সানিয়া তহমিনা সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানান। তিনি বলেছেন, ‘আমরা প্রিভেশন না করে ট্রিটমেন্টের দিকে নজর দিয়েছি। কিন্তু প্রিভেশনের ব্যাপারটায় হেলথ সেক্টর যেটা করতে পারে বা করছি আমরা, সেটা হচ্ছে, ডাক্তারদের ট্রেনিং দিচ্ছি। মানুষকে সচেতন করছি। কিন্তু মশা মারতে না পারলে সমাধান হবে না।
সিটি করপোরেশনের এটা দায়িত্ব ছিল। আমি বলবো এই ম্যানেজমেন্টে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।’ মশা মারার দায়িত্ব কার? অবশ্যই সিটি করপোরেশনের। সিটি করপোরেশন এই দায়িত্ব পালনে সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সিটি করপোরেশনের দুই মেয়র কেবলই বাহুল্য কথা দিয়ে সাধারণ মানুষের বিরক্তি আর ক্ষোভ বাড়িয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করতে পারেননি। বাহুল্য কথা বলার ক্ষেত্রে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন রেকর্ড গড়েছেন। তিনি প্রথমেই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাকে ‘গুজব’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন।
যখন বলা হচ্ছিল ‘ডেঙ্গু মহামারি’ আকার ধারণ করেছে, তিনি এটাও সংশোধন করে দিয়ে বলেছেন, “ডেঙ্গু ভাইরাসের বিস্তার এখনও মহামারি আকার নেয়নি। মহামারির একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে।” যদিও ‘মহামারি’র সংজ্ঞা তিনি বলেননি। অভিধানে মহামারির সংজ্ঞা ‘যে সংক্রামক রোগে বহু লোক মরে’। সাঈদ খোকনের সংজ্ঞায় ডেঙ্গু ‘মহামারি’ হতে কত লোকের মৃত্যু হতে হবে কে জানে!
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘মশক ও পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ঠিকমতো কাজ করছেন কি না তা দেখার জন্য আগামী সপ্তাহ থেকে সবাইকে জিপিআরএস পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসা হবে। এর মাধ্যমে আমরা দেখতে পারবো তার ঠিকভাবে কাজ করছে কি না।’ যদি কার্যকর ওষুধ না থাকে, ওষুধ ছিটানোর যন্ত্র না থাকে তাহলে তিনি পরিচ্ছন্ন কর্মীদের জিপিআরএস পদ্ধতির আওতায় এনে কী করবেন আল্লাহ মালুম!
সবচেয়ে বেশি বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেক। জাতির এই দুর্যাগ মোকাবিলায় যার নেতৃত্ব দেওয়ার কথা তিনি এক সম্মেলনে ঢাকা শহরের এডিস মশার বৃদ্ধিকে এ দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তুলনা করে হঠাৎ ‘গায়েব’ হয়ে গিয়েছিলেন। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী তিনি ‘ব্যক্তিগত’ সফরে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন।
ডেঙ্গু পরিস্থিতির মধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিদেশ সফর নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা শুরু হওয়ার পর প্রথমে বলা হয়, তিনি বন্যা ত্রাণের কাজে মানিকগঞ্জ গিয়েছেন। যাহোক, ব্যাপক সমালোচনার মুখে তিনি শেষ পর্যন্ত গোপনে দেশে ফিরে এসেছেন। ভালো ব্যাপার হচ্ছে, গায়েবি দশা থেকে ফিরে এসে এখনও কোনো বেফাঁস মন্তব্য করেননি!
দুই মেয়র, স্বাস্থ্যমন্ত্রী -প্রত্যেকেই ডেঙ্গু ইস্যু নিয়ে প্রতিনিয়ত খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত কথাবার্তা বলেছেন। মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে, মৃত্যু নিয়ে কোনো নিদান দেওয়ার পরিবর্তে তামাশা করেছেন। অথচ তাদের ব্যর্থতা, অব্যবস্থাপনা ও মশার ওষুধ ক্রয়ে দুর্নীতির কারণে ডেঙ্গু মহামারীর আকার ধারণ করেছে। অথচ তারা অবলীলায় সব অস্বীকার করছেন। এই ক্ষমাহীন ব্যর্থতা ও নির্লজ্জ বেফাঁস মন্তব্যের পরও তাদের মধ্যে কোনো বিকার নেই!
ডেঙ্গু দমনে মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট কারো কোনো আন্তরিক উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এডিস মশা প্রতিরোধের কোনো সর্বাত্মক উদ্যোগ নেই। হাসপাতালগুলোতে কোনো নজরদারি নেই। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কোলকাতায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি করপোরেশন সার্বক্ষণিক ডেঙ্গু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে থাকে। সেখানে সিটি করপোরেশনের ১৫ থেকে ২০ জন কর্মী দুটি দলে বিভক্ত হয়ে ১৪৪টি ওয়ার্ডে কাজ করেন।
একটি দলের কাজ রোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা, অন্যটির কাজ এলাকায় ডেঙ্গু মশার জন্ম নিতে পারে এমন জমানো পানি শনাক্ত করা। ৮ থেকে ১০ জনের আরেকটি দলকে প্রস্তুত রাখা হয় জরুরি সেবার জন্যে। খবর পেয়ে তারা গিয়ে এডিস মশার জন্মস্থল ধ্বংস করেন। যদি কোনো ভবনে জমানো পানি দেখতে পান যেখানে এডিস মশার জন্ম হতে পারে, তাহলে সেই ভবনের মালিককে ১ লাখ রুপি জরিমানা করা হয়। পানি সরানোর খরচও জুড়ে দেওয়া হয় করের টাকার সঙ্গে।
নগরীর ১৪৪টি ওয়ার্ডের সবগুলোতেই ডেঙ্গু পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো থেকে ডেঙ্গু বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করার জন্যে প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেসব তথ্য দ্রুত মশা নিধনকারী দলগুলোর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাই তারা ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে।
কিন্তু আমাদের দেশে পরিকল্পিত কোনো উদ্যোগ নেই। এলাকা বা মহল্লা-ভিত্তিক পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদার করা, বাসার ছাদ, বাড়ির আশপাশ, দুই বাড়ির সীমানায় নোংরা জায়গাসমূহ পরিস্কার করার কোনো কার্যক্রম নেই।
প্রশ্ন হলো, মশা মারা ছাড়া সিটি করপোরেশনের কাজটা কী? কেবল বেফাঁস মন্তব্য করা? জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পতাকা শোভিত গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো? শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অট্টালিকায় বসে বিভিন্ন নির্মাণ কাজের টাকার ভাগাভাগি করা? এদেশে কোথাও কারও কাজেরই কি কোনো জবাবদিহি থাকবে না?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)