চিকিৎসা সেবা গ্রহীতা, সেবা দাতা ও ব্যবস্থাপকের অধিকার সংরক্ষণ এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা-স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নিচ্ছিদ্র আইন বা ‘কমপ্যাক্ট ল’ এর প্রয়োজনের কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
শনিবার বিকেলে ‘মেডিকেল নেগলিজেন্স অ্যান্ড ইসপ্যাক্ট অন হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে বক্তারা স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও সহিংসতা প্রতিরোধে নতুন এ আইন প্রণয়নের তাগিদ জানান।
বিশ্ব ব্যাংকের সিনিয়র হেলথ স্পেশালিস্ট ডা. জিয়া হায়দারের সঞ্চালনায় স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্ট সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের নিয়মিত সাপ্তাহিক ওই ওয়েবিনারে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন: আমাদের একটি চিকিৎসা সুরক্ষা আইন হতে হবে। যে আইনটি তিন পক্ষের অধিকার সুরক্ষা করবে।
তিনি বলেন: করোনাভাইরাস, অদক্ষতা-অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি কোভিডের সময় আমরা এ চারটা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। আজকের পৃথিবীতে ব্যক্তির পক্ষে কোনো কিছুই করা সম্ভব না, নির্ভর করে সে যে ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে কাজ করবে তার ওপরে। রাষ্ট্র চাচ্ছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা বেসরকারি খাতে চলে যাক। এর ওপরে যে ধরনের নজরদারি করা দরকার সেটি করছে না। আমরা মুক্তবাজার অর্থনীতি বলতে মনে করি, যার যা ইচ্ছা তাই করবে। এটিকে যে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সেটি ভুলে গেছি।
তিনি বলেন: রিজেন্ট একটি প্রতারক প্রতিষ্ঠান। গত ছয় বছর যাবৎ লাইসেন্স নেই। তার সঙ্গে সরকারি একটি এমওইউ স্বাক্ষর করল। সেই অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি ছিলেন। সরকার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এমওইউ স্বাক্ষর করছে, সেই প্রতিষ্ঠানটি বৈধ না অবৈধ তারা এইটুকু দেখার প্রয়োজন বোধ করলেন না। তার মানে, যাদের ওপর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তারা জানেন না তাদের কাজ কী।
ডা. লেলিন চৌধুরী আরও বলেন: বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মেডিকেল নেগলিজেন্সি ঘটনা ঘটেছে কোভিড-১৯ আসার পরে। হাসপাতালে রোগী ভর্তি হতে পারছে না। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত হলো। এ ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারকরা ভুলে গেলেন, প্রজ্ঞাপন জারি করলে তার সঙ্গে আরও যে ঘটনা ঘটবে সেসব সমাধান করার জন্য অনেকগুলো বিধিবিধান থাকা দরকার। আমরা দ্বিতীয় পর্যায়ে বললাম, দেশের দুঃসময়, তিন মাসের জন্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে একত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালনা করা হোক।
‘আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর দেশের মানুষের কেন আস্থা থাকবে? আমার ডিজির করোনা হলো। তিনি তার আওতাধীন কোনো হাসপাতালে ভর্তি হলেন না। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। কারণ তিনি জানেন, তার সময় এবং এখন কী হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন। একটি ক্ষেত্রে না, সর্বত্র সুশাসন দরকার’, জানান ডা. লেলিন চৌধুরী।
সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন বলেন: আমাদের দেশে আইন আছে। আমি মনে করি সেসব আইন যেমন সংশোধন করা দরকার। একইসঙ্গে চিকিৎসা খাতের জন্য একটি কোডিফাই ল’ দরকার। একটি বড় দুর্বলতা হলো সুপ্রিম কোর্ট আইন বিভাগকে বলতে পারে না যে, এ রকম একটি আইন করো। কেবল বলতে পারে এ রকম একটি আইন হওয়া দরকার। আইনি জটিলতার কারণে এতো কিছুর পরেও সাহেদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। অথচ তার রিপোর্টের কারণে কারো মৃত্যু হলে সম্পূর্ণ দায় তার।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ব্রি. জেনারেল আমিনুল ইসলাম বলেন: আমাদের আইনি সীমাবদ্ধতা দূর করতে হবে। নেগলিজেন্সি করে অনেকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ২৫ শতাংশ চিকিৎসক সময় মতো অফিসে আসেন না এবং সময়ের আগেই বের হয়ে যান। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের হাসপাতাল পরিদর্শন বাড়াতে হবে। চিকিৎসকদের কাছ থেকে তাদের সমস্যা শুনতে হবে এবং পোস্টিং, বদলি ও পদোন্নতি জটিলতা দূর করতে হবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজ বলেন: শিক্ষিত পরিবারেও এক ধরনের স্টিগমা আছে, আমরা পোস্টমর্টেম করতে দিতে চাই না। যে কারণে অনেক সময় নেগলিজেন্স প্রমাণ করা যায় না। মেডিকেল নেগলিজেন্স প্রমাণ করার জন্য দুজন চিকিৎসকের সমর্থন দরকার হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি কিংবা তার ক্ষমতায়নে কোনো ব্যক্তি ছাড়া মামলা করা যায় না। এসব মিলিয়ে আমরা একটি বলয় তৈরি করেছি যাতে কোনোভাবেই কেউ অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেতে না পারে।