চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

স্বাভাবিক পথ বদলে বাংলাদেশের নদীতে অভিবাসী ইলিশ

হুগলি নদীর মুখে অতিরিক্ত মাছ ধরার জাল এবং পলি জমে স্বাভাবিক গভীরতা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি কারণে মাছের রাজা ইলিশ তার প্রাকৃতিক পথ বদলে বাংলাদেশের জলে অভিবাসী।

ভারতীয় মৎস্য বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া এক প্রতিবেদনে বলেছে, হুগলি নদীর এই নেতিবাচক প্রভাবের বিপরীতে বাংলাদেশের নদীতে ইলিশ ধরায় কড়া নিষেধাজ্ঞা এবং তাতে গুরুত্ব প্রদানের ফলে সেখানে ইলিশ ছুটছে। ২০০২-০৩ সালের দিকে হুগলিতে নদীতে ইলিশ ধরা হয়েছিলো মোট ৬২,৬০০ টন। কিন্তু দেড় দশকের মধ্যে (২০১৭-১৮), এই অবস্থা হ্রাস পেয়ে ২৭,৫৩৯ টনে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে বাংলাদেশে ইলিশ ধরা পড়ার হার ১,৯৯,০৩২ টন থেকে ৫,১৭,০০০ টনে দাঁড়িয়েছে, যা ১৬০% বৃদ্ধি পেয়েছে।

ভারতের কেন্দ্রী মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান উৎপল ভৌমিক জানান,  বঙ্গোপসাগরে সমবেত হওয়া ইলিশগুলো তাদের ডিম ছাড়ার মৌসুমে উজানের পথে তিনটি রুট নিয়ে চলে-হুগলি মোহনা, বাংলাদেশের মেঘনা এবং মিয়ানমারের ইরাবতি নদীর মোহনা। কিন্তু হুগলিতে উচ্চ পলি জমা এবং মাছ ধরার ক্ষেত্রে কোনো রকমের নিয়মতান্ত্রিকতা না থাকায় ইলিশ তার অভিবাসনের পথ পরিবর্তন করছে এবং বেশিরভাগ মেঘনার দিকে ছুটছে।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৭৫ % ইলিশ ধরা পড়ছে, মিয়ানমারে ১৫%, ভারতের মাত্র ৫% এবং অন্যান্য দেশে ইলিশ ধরা পড়ছে ৫%।

‘সাধারণত নদীতে ৩০-৪০ ফুট গভীরতা না থাকলে ইলিশের ঝাঁক প্রবেশ করতে পারে না। ফারাক্কা বাঁধের কারণে হুগলির মোহনা দ্রুত গভীরতা হারাচ্ছে’-বলেন উৎপল ভৌমিক।

উত্তর মেদিনীপুরের ইলিশ জেলে দেবব্রত খুটিয়া বলেছেন, হুগলির মোহনায় মাত্র কয়েক বছর আগে যেখানে ৩০০০ টি নৌকা ছিলো, এখন তার সংখ্যা বেড়ে ৬,০০০ টি হয়েছে।

ন্যাশনাল প্লাটফর্ম ফর স্মল স্কেল ফিশ ওয়ার্কার্স (ইনল্যান্ড) প্রদীপ চ্যাটার্জী বলেন, ‘শত শত জাল দ্বারা নদীর মোহনার মুখ অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। কাজেই কীভাবে মাছ নদীতে প্রবেশ করবে’?

‘তাই বেঁচে থাকার জন্য ইলিশ মেঘনার মোহনার দিকে যাত্রা করছে, যেখানে গভীরতা ৫০-৬০ ফুট’-বলেছেন ভৌমিক।

ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ডেনমার্কে বছরের পর বছর ধরে ইলিশ নিয়ে গবেষণা করা দেওয়ান আহসান বলেছেন, আমি লক্ষ্য করেছি যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইলিশের অভিবাসন পথ পরিবর্তিত হচ্ছে। মাছ ধরা জাল এবং নদীর মোহনায় পলি জমে গিয়ে নদীর গভীরতা হ্রাস পাওয়ায় স্বাভাবিক রুটগুলি অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। তাই ইলিশ তার রুট পরিবর্তন করছে।

‘মূলত ফারাক্কা বাঁধের কারণে পলি জমে যাওয়া, নিয়ন্ত্রণহীন মাছ ধরা এবং নৃবিজ্ঞানৈতিক কারণে ইলিশের প্রাকৃতিক রুট আক্রান্ত হচ্ছে। এর আগে ইলিশের ঝাঁক এলাহাবাদে যাতায়াত করতে পারতো। তবে এখন ফারাক্কা বাঁধ পার হতে পারে না’- বলছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের ইশা দাস।

‘২০০৩ সালে বঙ্গ সরকার হুগলি, মতলা, রায়মঙ্গল ও ঠাকুরান-সহ পাঁচটি অঞ্চলকে ইলিশের অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছিলো। ২৩ সেন্টিমিটার নীচের দৈর্ঘের মধ্যে ইলিশ ধরা, পরিবহণ এবং বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। প্রতিবছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪ অক্টোবর সময়কালের পুর্ণিমার পাঁদিন আগে ও পরে ইলিশ ধরা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ছিলো। কিন্তু এসব নিষেধাজ্ঞা কেবল কাগজেই থেকে গেছে। কার্যকর করা হয়নি। ফলে এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব কাজে আসেনি’-বলেছেন যাদপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের সুজাতা হাজরা।

উৎপল ভৌমিক বলছেন, কোনো রকম শাস্তির বিধান না থাকলে নিষেধাজ্ঞা কীভাবে কার্যকর হবে? নিষেধাজ্ঞার পেছনে কাউকে কি কখনও শাস্তি দেওয়া হয়েছে? এবং সরকার নিষেধাজ্ঞার সময়কালে জেলেদের সহায়তা করার জন্য কি কিছু করেছে? সুতরাং, অবৈধ জাল এখনও বছরব্যাপী মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে, এমনকি নিষিদ্ধ অঞ্চলগুলিতেও, এবং কিশোর ইলিশ ধরা পড়ছে’।

রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহা অবশ্য বলেছেন, কেউ এই নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। জেলেরা যথেষ্ট সচেতন। তবে হ্যাঁ, আমরা শাস্তির বিধান অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছু অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে সম্ভব হয়নি। তবে আমরা এসময় ইলিশ ধরা বন্ধ রাখলে জেলেদের জন্য আর্থিক পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছি। কোথাও কোথাও শাস্তিরও।

কিন্তু সেক্রেটারি অব দ্য ন্যাশনাল ফিশাওয়ার্কার্স ফোরাম দেবাশিস শ্যামল এর মতে, সরকারি এসব পুরস্কার কিংবা গ্রেপ্তার ও শাস্তি পেয়েছে এমন কাউকে তিনি দেখতে পাননি।

দেওয়ান আহসান এর মতে, বঙ্গোপাসাগর ছাড়াও ইলিশ এখন আরব সাগর, চীন, ভিয়েতনাম, রেড সি, পার্সিয়ান উপসাগরেও পাওয়া যাচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশকে যৌথভাবে অতিরিক্ত মাছ শিকার, নদীর মোহনায় পলিজমা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক অনুসন্ধান বন্ধ করে সমস্যার সমাধান করতে হবে। অন্যথায় উভয় দেশ দীর্ঘমেয়াদী ইলিশ সংকটে পড়তে পারে এবং ইলিশ তার স্বাভাবিক রুট পরিবর্তন করে অন্যত্র অভিবাসি হতে পারে।