‘হুব্বুল ওয়া তানেমিনাল ইমান’ অর্থাৎ দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ এ অনিবার্য নীতিবাক্যের আওতায় আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও রয়েছে। হাজার বছরের ইতিহাসে এদেশীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসএবং স্বাতন্ত্র্যবোধ নির্মাণে যারা অবদান রেখেছেন, তাদের সকলের প্রতি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার এই মাসে বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। বিশেষ করে কবির ভাষায় ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ দেশের মুক্তি সংগ্রামকে যারা সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে গেছেন, যাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, আলাদাভূখণ্ড, ভিন্ন মানচিত্র, পৃথক জাতি সত্ত্বা, লাল-সবুজের পতাকা ও স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী পেয়েছি তাদের সকলের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ নামকরণ রাষ্ট্রের অবিসংবাদিত নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, কিংবদন্তির মহানায়ক ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫ খ্রি.) মহান স্মৃতির প্রতি অজস্র শ্রদ্ধা নিবেদন করি। তার সুযোগ্য নেতৃত্বেই অবহেলিত, বঞ্চিত ও উপেক্ষিত বাঙ্গালি জাতি তার বহুল প্রত্যাশিত স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে পেরেছে। আমরা জাতি হিসেবে স্বাধীন পরিচয় লাভ করেছি এবং বিশ্বসভায় বাঙালি জাতি তার আত্মমর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমরা ঋণী এ কারণেও যে, সমগ্র বিশ্বে তিনি গর্বভরে পরিচয় দিয়ে বলতেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মুসলমান’। বঙ্গবন্ধুসহ অসংখ্য শহীদের রক্তে গড়া সেই স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশে আজ বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্ব দুটিই বড় অসহায়ত্ব বরণ করে আছে। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত খাঁটি বাঙালির ললাটে আজ নাস্তিক্যবাদের তিলক পরানো হচ্ছে আর মুসলমানিত্ব ধর্মীয় আলখেল্লাধারী তথাকথিত লেবাসধারীদের পার্থিব মোহ ও লালসার প্রকোষ্ঠে জিম্মি দশায় নিপতিত হয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে বিশ্বজনীন, সর্বজনীন ও কালজয়ী মতাদর্শ এবং শান্তি, উদার ও মানবতাবাদী ধর্ম ইসলামের প্রকৃত অনুসারী মাত্রই সকলে ব্যথি তহবে, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটবে। এমতাবস্থা হতে উত্তরণের জন্য ইসলামের আলোকে স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়া এবং ইসলামে দেশপ্রেমের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্বন্ধে অবহিত থাকা একান্ত প্রয়োজন।
ইসলামের মহান নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর কাছে তার জন্মভূমির গুরুত্ব ও মর্যাদা ছিলো অপরিসীম। ইতিহাসের আলোকে আমরা দেখি, তিনি যখন আরবের অবিশ্বাসীদের ষড়যন্ত্রের মুখে মক্কা হতে মদিনায় হিজরত করতে উদ্যত হলেন তখন মদিনা পানে যাত্রার প্রাক্কালে জন্মভুমি মক্কার জন্য তার হৃদয় বিগলিত হচ্ছিল। বারবার তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে যাচ্ছিলেন এবং কাবার দিকে দৃষ্টিপাত করছিলেন। মক্কার পাহাড়-পর্বত আর বৃক্ষলতার পানে বার বার তাকাচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, হে কাবা, তুমি কতো সুন্দর, তুমি কতো মর্যাদাবান; ওহে মক্কা শহর, তোমায় আমি অনেক ভালোবাসি, কিন্তু আমার জন্মভূমির লোকেরা তোমায় ছেড়ে যেতে আমায় বাধ্য করেছে। জন্মভূমির জন্য হৃদয়ের এই টান ছিলো রাসুলের (সা.) স্বভাবজাত।
এমনকি মদিনায় যাবার পরেও কখন বা কতদিনে তিনি আবারো বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করবেন, সেজন্যে সর্বদাই ব্যাকুল থেকেছেন। প্রচণ্ড ক্ষমতা হাতে পেয়েও মক্কা বিজয়ের পর মাতৃভূমিতে অবস্থানরত ইসলাম ধর্মের বাইরের কাউকে অত্যাচার করেননি, কাউকে কষ্ট দেননি, বাড়ি থেকে বের করে দেননি এবং ইসলাম বিরোধী কাউকে কোনো শাস্তি দেননি।
এমনকি বড় বড় অপরাধীকেও তিনি কোনো প্রকার শাস্তির আওতায় আনেননি বরং সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। গোটা মক্কা জুড়ে যে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল রহমতের আঁধার নবীর মহত্তম এক ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে শান্তি-সস্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে। রাসুল (সা.) বললেন ‘আজ তোমাদের কারো বিরুদ্ধেই আমার কোনো অভিযোগ নেই, ক্ষোভ নেই, দুঃখবোধ নেই, তোমাদের সবাইকে মাফ করে দিলাম। ’মানবতার ইতিহাসে এমন নিঃশর্ত ক্ষমার ঘোষণা খুবইবিরল। এটি সম্ভব হয়েছিলো উদার ও পরমত সহিষ্ণুতার মূর্ত প্রতীক মহানবী (সা.) এর প্রকৃত দেশপ্রেম আর মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসার কারণে।
যারা দেশকে ভালোবাসবে, দেশের জন্যে কাজ করবে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখার প্রত্যয়ে ব্রতী হবে ইসলামে তাদের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে যারা নিজেদের নিয়োজিত রাখবে তাদের জন্য হাদিসে বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণা রয়েছে। যারা অকাতরে দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দেবে ইসলাম তাদেরকে শাহাদতের মর্যাদা দান করেছে।
ইসলামে দেশপ্রেমের তাৎপর্য একটুভিন্ন ও ব্যতিক্রম। এখানে দেশপ্রেমের অর্থ শুধু দেশকে ভালোবাসার মধ্যে ইসীমাবদ্ধ নয়। বরং দেশ থেকে সকল অন্যায়, দুর্নীতি আর পাপাচারের মূলোৎপাটন করে একটি আদর্শ স্থানীয় দেশে রূপান্তরের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে যার যার জায়গা থেকে সাধ্যমতো প্রয়াস অব্যাহত রাখা। দেশের উন্নয়ন, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জাতি গঠনএবং দেশের সামগ্রিক সমৃদ্ধি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করাই একজন ঈমানদার নাগরিকের মূল কাজ। দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও দেশকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়া কোনো ক্রমেই দেশপ্রেমিকের কাজ হতে পারে না। দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয় এমন কোনো পদক্ষেপও কোনো দেশপ্রেমিক নিতে পারেনা। এসব ইসলামের মৌলিক শিক্ষার পরিপন্থী। ধর্মের নামে দেশের নাগরিকদের মাঝে বিভাজনের সৃষ্টিকরাও ইসলামের শিক্ষা নয়। বরং একটি দেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমান নাগরিকঅধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করবে এটাই ইসলামের মহান শিক্ষা। সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘু হিসেবে নয় বরং দেশের নাগরিক হিসেবেএবং স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ হিসেবে সবাইকে মূল্যায়ন করাই একজন দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব।
ঐক্য, সংহতি, সহনশীলতা, পরমত সহিষ্ণুতা, উদারতা,ন্যায়পরায়ণতা, সংযম, শান্তিকামীতা এগুলো হচ্ছেএকজন দেশপ্রেমিক নাগরিকের অনিবার্য গুণ। দেশের ক্রমবর্ধমান উন্নতি ও সমৃদ্ধির স্বার্থে সবাইকে এসব গুণের ধারক হয়ে দেশমাতৃকার কল্যাণে কাজ করতে হবে। স্বদেশের প্রতি শাশ্বত ও চিরন্তন ভালোবাসার দিকনির্দেশনা রয়েছে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে।মহান আল্লাহ বলেন ‘তোমরা আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের ন্যায়পরায়ণ শাসকের আদেশাবলি মেনে চলো (সুরা নিসা-৫৯)।’
রাসুল (সা.) বলেছেন ‘যে চোখ দেশের সীমান্ত রক্ষার জন্যে জাগ্রত থেকে পাহারা দেয় সে চোখ জাহান্নামের অগ্নি স্পর্শ করবেনা।’ ‘দেশের সুরক্ষার জন্য এক দিন ও রাতের পাহারা লাগাতার এক মাস সিয়াম ব্রত পালন এবং দিবারাত্রি এবাদতের চাইতেও উত্তম।’
ইসলামের ইতিহাসে ধর্মীয় অনুশাসন পালন ও স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য যেমন মদিনা নামক স্বাধীন ও নিরাপদ ভূখণ্ডের প্রয়োজন ছিলো ঠিক তেমনি মহানবী (সা.) এর নেতৃত্বে মদিনার সকল অধিবাসী মিলে সেই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বিধানও করেছেন।
সুতরাং দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি এমন দায়বদ্ধতার শিক্ষা দেয় ইসলাম। ইসলামের পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসুলই তাদের নিজ নিজ অঞ্চল, এলাকা, প্রতিবেশ, সমাজ আর দেশের প্রতি ভালোবাসায় বিমূর্ত ছিলেন। শুধু ইসলাম ধর্মই না প্রায় সব ধর্মই দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা দেয়।
বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও আত্মমর্যাদাশীল দেশ। প্রাণাধিকপ্রিয় এ দেশকে আমরা মমতাময়ী মায়ের সাথে তুলনা করি। মায়ের স্থান সবার ঊর্ধ্বে। ইসলামে মায়ের মর্যাদা ও অবস্থান সবার ও সবকিছুর উপরে। তাই মায়ের সাথে সাথে মাতৃভূমি, মায়ের ভাষা ও মায়ের দেশের সকল কিছুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা পোষণ করাই আমাদের জন্য অবধারিত। মায়ের প্রতি প্রতিটি সন্তানের ভালোবাসা যেমন স্বতস্ফূর্ত, ঠিক তেমনি দেশের প্রতিও প্রতিটি নাগরিকের ভালোবাসা হোক অকৃত্রিম।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্যও প্রয়োজন আমাদের সকলের অংশগ্রহণে দেশটিকে ক্ষুধা-দারিদ্র মুক্ত করে উন্নত-সমৃদ্ধ এবং আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে একে গড়ে তোলা; স্বাধীনতার এই মহান মাসে এটিই হোক আমাদের দৃপ্ত অঙ্গীকার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)