চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

স্বরশ্রুতি’র আবৃত্তি প্রযোজনা ‘সবুজ করুণ ডাঙায়’: স্বাধীনতার জন্য সব হারানোদের স্মরণ

রেজাউল হক: দেশের স্বাধীনতার জন্য যাঁরা নিজের প্রাণকে তুচ্ছ করেছিলেন, যাঁরা হারিয়েছিলেন সন্তান-স্বজন কিংবা সর্বস্ব, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভিন্ন মাত্রিক উচ্চারণে তাঁদের কথা বলেছে আবৃত্তি সংগঠন ‘স্বরশ্রুতি’। মীর মাসরুর জামান রনির গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় তাদের নতুন পূর্ণাঙ্গ আবৃত্তি প্রযোজনা ‘সবুজ করুণ ডাঙায়’ প্রথমবার মঞ্চে এসেছে ৬ অক্টোবর, শিল্পকলা একাডেমির ‘জাতীয় সঙ্গীত, নৃত্যকলা ও আবৃত্তি মিলনায়তনে। গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসবে প্রায় এক ঘণ্টার টান টান সেই পরিবেশনায় বিমোহিত হন দর্শক-শ্রোতারা।

ইতিহাসের কোনো অংশ যেমন জাতির জন্য চির গর্ব ও গৌরবের, তেমনই কোনোটি আবার দুঃখ ও গ্লানির। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গৌরবের অধ্যায়। একটি শোষিত-বঞ্চিত জাতির প্রায় সবাই সে সময় একেকজন অদম্য যোদ্ধা হয়ে ওঠেন। কেউ বিজয়ী বীর, কেউবা অকাতরে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন, কেউ আবার প্রাণের চেয়ে প্রিয় সন্তানকে যুদ্ধের মাঠে পাঠিয়ে দেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এভাবেই এক জনযুদ্ধ। দেশের মানুষ নিজের আত্মা দিয়ে সেই যুদ্ধ করেন। কেউ যুদ্ধ করেন ময়দানে, কেউ রান্নাঘর-জায়নামাজ-তুলসিতলায়। শহীদ রুমী-আজাদ-বদি-মিরাশের মা হয়ে ওঠেন দেশের মা। যুদ্ধের সেই ছোট-বড়ো গল্পগুলো আমাদের শিল্প-সাহিত্য-আলাপ-আলোচনার অবারিত উৎসভূমি।
আবৃত্তি প্রযোজনা ‘সবুজ করুণ ডাঙায়’ এ খণ্ড খণ্ড গল্প বিবৃত হয়ছে বঙ্গবন্ধুর আহবান ও জনতার সংগ্রামের প্রস্তুতি থেকে নির্বিচার গণহত্যা, ধর্ষণ আর বীর বাঙালির ঘুরে দাঁড়ানো। সুদূর অতীত থেকে জীবন্ত হয়ে উঠে আসে মুজিবের অপ্রতিরোধ্য বজ্রকণ্ঠ, আক্রান্ত মানুষের বুকভাঙা বিলাপ, রুমি-আজাদদের সপ্রতিভ সংলাপ অথবা স্বল্পশ্রুত কোনো বীরযোদ্ধা বা বীরাঙ্গনার অবিশ্বাস্যরকমের প্রতিরোধ। শহরের বা দূরের কোনো গাঁয়ের ছড়ানো-ছিটানো প্রতিরোধের গল্পগুলো বিবৃত হয় কখনো বয়ানে, কখনো কবিতায়, কখনো দৃশ্যের অভূতপূর্ব নাটকীয়তায়। যুদ্ধ চলে ছুটে ছুটে: ঢাকা-মেথিকান্দা-খালিয়াজুরি-খেপুপাড়া-ঝালকাঠি বা আরো অনেক অনামা জনপদে। ঢাকার মেধাবী তরুণ, গ্রামের কিষাণ, বিপ্লবী, আদিবাসী তরুণীরা বিচরণ করেন যুদ্ধে ময়দানে। যুদ্ধের অশেষ কষ্ট নিয়ে আসেন প্রত্যক্ষদর্শী জাহানারা ইমাম, শহিদ আজাদের মা, কোনো এক অচেনা বৃদ্ধা। গভীর বেদনার আর অসামান্য সংগ্রামের মুহূর্তগুলো বয়ে চলে যুগপৎ।
আবার আগামী প্রজন্মের উদ্দেশে মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘জিততেই হবে তাদের, কেন না এ যুদ্ধে রানার-আপ নেই, পরাজিত হলে এই পশুরা আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতার ইতিহাস কলঙ্কিত করে ফেলবে।’ যেদিন আমাদের মৃত্যুঘণ্টা বাজবে, সেদিন আমাদের যেন চোখে পানি নিয়ে চোখ বন্ধ করতে না হয়। আমরা তাকিয়ে আছি সেই অবিমিশ্র দিগন্তের দিকে।’ আহবানের পর শিশুদের সম্মিলিত কণ্ঠে ‘আবার আসিব ফিরে’ দিয়ে শেষ হয় ‘সবুজ করুণ ডাঙায়’।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গদ্য সাহিত্য আর ইতিহাস থেকেই মূলত সবুজ করুণ ডাঙার গ্রন্থণা করা হয়েছে। তবে তার সাথে কিছু কবিতার ব্যবহার প্রযোজনাটিকে ভিন্নতর ব্যঞ্জনা দিয়েছে।
‘স্বরশ্রুতি’র এ প্রযোজনায় আবৃত্তি পরিবেশনায় অংশ নিয়েছেন মো. আহ্কাম উল্লাহ্, মীর মাসরুর জামান রনি, আশরাফুল আলম রাসেল, শেগুফতা ফারহাৎ সেঁজুতি, শাহ আলী জয়, জোবায়ের মিলন, জিনিয়া ফেরদৌস, ফাতেমাতুজ জোহরা তিথি, সৈয়দা সালমা নাছরীন, সৈয়দা সালমা শিরীন, মনিরুল ইসলাম প্রিন্স, শামীম শেখ, পিওনা আফরোজ, তসলিমা শিমু, অন্বেষা অর্থী এবং সুরাইয়া আফরিন উপমা। সঙ্গীত ব্যবস্থাপনায় ছিলেন আশরাফুল আলম রাসেল। প্রযোজনা ব্যবস্থায় ছিলেন মনিরুল ইসলাম প্রিন্স।