‘সত্যিকার অর্থেই একজন স্বপ্নবাজ মানুষ ছিলেন ফাহিম সালেহ’ বলছিলেন রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ‘পাঠাও’ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হুসেইন মোহাম্মদ ইলিয়াস।
‘ফাহিম সালেহ প্রযুক্তি বিষয়ক চিন্তা ভাবনা নিয়েই থাকতেন। তিনি খুব উদ্যোমী ও পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের অনুপ্রেরণা ছিলেন এবং থাকবেন।’
ফাহিমের মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না উল্লেখ করে নিজের ফেসবুক পোস্টে ইলিয়াস বলেন, ‘একজন সত্যিকারের কারিগর ছিলেন ফাহিম। পাঠাও যখন আমাদের মধ্যে কেবল মাত্র ধারণা ছিল ফাহিম সেখানে সম্ভাবনা দেখেছিল।’
নিজের ব্লগে ‘স্মৃতিতে ফাহিম সালেহ’ নামে এক পোস্টে ইলিয়াস উল্লেখ করেন, ‘পাঠাও আর ফাহিম এক সুতোয় গাঁথা। পাঠাও কখনোও ফাহিম ছাড়া অস্তিত্ব লাভ করতে পারত না।’
তিনি বলেন, ‘ফাহিম আমাদের সাহসী করেছিলেন স্বপ্ন দেখতে, সাহসী হতে, প্রগাঢ় হওয়ার এবং কখনও চলা না থামানোর। দেশে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং ছিল না, ই-কমার্স বলতে কিছু ছিল না, তখন তিনি পাঠাওয়ে বিনিয়োগ করার ঝুঁকি নিয়েছিলেন’।
দেশের প্রতি নাড়ির টান থেকে ছুটে এসেছিলেন, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ, তথ্য প্রযুক্তি বিশ্বে এগিয়ে নিতেই ঢাকায় এসেছিলেন।
রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাও ছাড়াও হ্যাকহাউজ (ঢাকা-ভিত্তিক উদ্যোগ) নামের একটি প্রতিষ্ঠান ছিল তার। দেশে পাঠাওয়ের শেয়ার বিক্রি করে দিলেও অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জোবাইক ও যাত্রীতে বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি। বিনিয়োগ ছিল আলফাপটেটো নামের আরেকটি উদ্যোগেও।
যুক্তরাষ্ট্রের বেন্টলি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনফরমেশন সিস্টেম নিয়ে পড়াশোনা করা ফাহিম পেশায় ছিলেন ওয়েবসাইট ডেভেলপার। ওয়েবসাইটে নিজের সম্পর্কে লিখেছিলেন উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী, স্বপ্নবাজ।
গত মঙ্গলবার নিউইয়র্ক সিটির লোয়ার ইস্ট ম্যানহাটনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ফাহিমের টুকরো করা লাশ উদ্ধার করে নিউইয়র্ক পুলিশ।
সহ-প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুতে ‘পাঠাও’ এর শোক
শোক বার্তায় পাঠাও’ বলছে, ‘এক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ফাহিম সালেহের মৃত্যুতে আমরা হতভম্ব এবং গভীরভাবে দুঃখিত। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বাইরেও মানুষের জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তনে প্রযুক্তির সক্ষমতার প্রতি ফাহিমের গভীর বিশ্বাস ছিল। সে সবসময় পাঠাও এবং এই ইন্ডাস্ট্রির সবার জন্য এক অনুপ্রেরণা ছিল এবং অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।’
একজন পথ প্রদর্শককে হারালো তরুণ উদ্যোক্তারা
ফাহিম সালেহ’র মৃত্যুতে দেশের আইটি ইন্ডাস্ট্রি কেবল একজন সফল উদ্যোক্তাকে হারায়নি, বরং দেশের তরুণ স্টার্টআপ উদ্যোক্তারা হারালো তাদের একজন অন্যতম অনুপ্রেরণাদাতা ও পথপ্রদর্শককে; এমনটাই জানিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)।
বিবৃতিতে সংগঠনটি বলছে, তরুণদের মধ্যে স্টার্টআপস কমিউনিটি গড়ে তোলার যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে, তাতে ফাহিম সালেহর এমন মৃত্যু নিঃসন্দেহে একটি বড় রকমের ধাক্কা হিসেবে প্রতিফলিত হবে।
কাঁদছে নাইজেরিয়াও!
ফাহিম সালেহ নাইজেরিয়াভিত্তিক রাইড শেয়ারিং অ্যাপ গোকাডারও মালিক। নাইজেরিয়ার সর্ববৃহৎ শহর লাগোসে এই অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবাটি চালু আছে। বাংলাদেশি এই তরুণের মৃত্যুতে কাঁদছে নাইজেরিয়াও।
ফাহিমের মৃত্যুর খবর জানিয়ে গোকাডা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আমাদের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম সালেহের আকস্মিক মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে দুঃখিত। ফাহিম দুর্দান্ত নেতা, অনুপ্রেরণামূলক এবং ইতিবাচক ব্যক্তি ছিলেন। ফাহিম সবসময়ই আমাদের হৃদয়ে থাকবেন।
তরুণ এই বাংলাদেশির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছেন নাইজেরিয়ার বাসিন্দরাও। অনেকেই এই হত্যাকাণ্ডকে হৃদয়হীন ও ঘৃণ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। অনেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীই তার মৃত্যু নিয়ে নিন্দাও জানিয়েছেন।
সহকারী হাসপিলের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ‘পাঠাও’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহকে হত্যার দায়ে তার ব্যক্তিগত সহকারী টাইরেস ডেভেন হাসপিলের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ফাহিম সালেহ হত্যায় অভিযুক্ত তার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী টাইরেস ডেভেন হাসপিলের বিরুদ্ধে সেকেন্ড ডিগ্রী মার্ডারের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
পুলিশ বলছে, ফাহিম সালেহের কাছ থেকে প্রায় ৮৫ লাখ টাকা হাসপিল ধার করেছিলেন। টাকাগুলো ফেরত দেয়নি হাসপিল। তবে টাকা ফেরত না দেয়ায় পুলিশকে অবহিত করেননি ফাহিম। তিনি টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য হাসপিলকে একটি পরিকল্পনা দেন। তবে তার সহকারী টাকা ফেরত না দিয়ে তাকে হত্যা করার পথ বেছে নেন।
এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে নিউ ইয়র্ক পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান রোডনি হ্যারিসন বলেন, ফাহিমের অর্থনৈতিক এবং ব্যক্তিগত বিষয়গুলো তদারকি করতো সন্দেহভাজন হাসপিল।
যা ঘটেছিল মঙ্গলবার
নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে প্রথমে জানতে পারে ফাহিম সালেহ’র বোন। মঙ্গলবার সারাদিন ভাইয়ের সঙ্গে কোন যোগাযোগ না হওয়ায় বিকেল সাড়ে তিনটায় ম্যানহাটনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের সপ্তম তলায় তার সাথে কথা বলতে যান। সেখানে গিয়ে ফাহিম সালেহ’র খণ্ড-বিখণ্ড মরদেহ দেখতে পান তিনি।
অ্যাপার্টমেন্টের সিসি ক্যামেরার বরাতে সেসময় পুলিশ জানিয়েছিল, দেখা গেছে কালো স্যুট এবং কালো মাস্ক পরা একজন ব্যক্তির সাথে একই লিফটে প্রবেশ করেন ফাহিম সালেহ। লিফট ফাহিম সালেহ’র অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়ালে দুজনেই সেখান থেকে বের হয়ে যান। এরপর ফাহিম সালেহ তার অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করেন। তখন সেই ব্যক্তি ফাহিম সালেহকে অনুসরণ করে। পুলিশ বলছে, এরপর দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়।