দেশের স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকরা বরাবরই ভয়ংকর রকম বেতন বৈষম্যের শিকার। সরকারের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে তারা মাদ্রাসা পরিচালনা করলেও বেতন যা পান তা দিয়ে কোনোভাবেই একজন শিক্ষকের পক্ষে সংসার চালানো সম্ভব নয়। এখানেই শেষ নয় স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের বড় অংশ আবার কোনো ধরনের বেতন বা অনুদান কিছুই পান না।
বাংলাদশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের হিসাব অনুযায়ী মাত্র এক হাজার ৫১৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকগণের মধ্যে প্রধান শিক্ষকরা আড়াই হাজার টাকা এবং সহকারী শিক্ষকরা দুই হাজার ৩০০ টাকা ভাতা হিসেবে পান। এর বাইরে ৮ হাজার ৫০০টি মাদ্রাসার শিক্ষকগণ গত ৩৪ বছর ধরে বেতন-ভাতা থেকে সম্পূর্ণরুপে বঞ্চিত।
নিজেদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে তাই ১ জানুয়ারি থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করে বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতি। এরপর ৯ জানুয়ারি থেকে তারা আমরণ অনশন শুরু করেন। শেষমেশ ১৬ জানুয়ারি শিক্ষা সচিবের আশ্বাস পেয়ে তারা অনশন ভেঙ্গে বাড়ি ফিরে যান। অনশন করতে গিযে প্রায় দুই শতাধিত শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেতন-ভাতা বঞ্চিত অসহায় স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকরা বাড়ি ফিরে গেলেও কবে নাগাদ তারা প্রাপ্য অধিকারটুকু পাবেন তা আসলে কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয়।
১৯৮৪ সালে সারাদেশের ১৮ হাজার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসাকে নিবন্ধন দেয় সরকার। এরমধ্যে ১৯৯৪ সালে এক হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসাকে এমপিওভুক্ত করা হয়। এই মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকদের প্রথমবারের মতো মাসিক ৫০০ টাকা করে অনুদান বা ভাতা দেওয়ারও ব্যবস্থা করা হয়। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে তা বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হয়। ২০১৪ সাল থেকে মহার্ঘ্যভাতা হিসেবে ২৫০ টাকা বাড়িয়ে মোট সাড়ে ১২শ টাকা দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালে অনুদান বাড়িয়ে এমপিওভুক্ত ইবতেদায়ী মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকদের দুই হাজার ৫০০ টাকা এবং সহকারী শিক্ষকদের দুই হাজার ৩০০ টাকা অনুদান প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়।
এদিকে প্রাথমিক সমমানের প্রতিষ্ঠান স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকরা যেখানে মাত্র ১২শ টাকা অনুদান পান, সেখানে দাখিল মাদ্রাসার সঙ্গে সংযুক্ত ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকরা বেতন পান ৯ হাজার ৯১৮ টাকা। আবার একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শুরুতেই ১৫ হাজার টাকার বেশি বেতন পান। ১৯৯৪ সালে এক পরিপত্রে রেজিস্ট্রার বেসরকারি প্রাইমারি ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
পরবর্তীতে বিগত সরকারের আমলে ধাপে ধাপে বেতন বৃদ্ধি হতে থাকে। ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি বর্তমান মহাজোট সরকার ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলকে জাতীয়করণ করে। কিন্তু স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় না। অথচ পাঠদানের ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার মধ্যে খুব একটা ফারাক ছিল না। মূলত সেসময় থেকেই তারা জাতীয় স্কেলে বেতন দাবি করতে থকেন। বর্তমানে মাত্র এক হাজার ৫১৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা প্রধান শিক্ষক প্রতিমাসে আড়াই হাজার টাকা এবং সহকারী শিক্ষক দুই হাজার ৩০০ টাকা ভাতা হিসেবে পান। বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির মতে সাড়ে ৮ হাজার মাদ্রাসার শিক্ষকরা গত ৩৪ বছরে কোনো বেতন ভাতা পাননি।
রাজবাড়ী জেলার কালুখালি উপজেলার একটি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক শওকত আলী। প্রতিমাসে সরকার থেকে অনুদান হিসেবে পান আড়াই হাজার টাকা। এই টাকার বাইরে তার আর কোনো আয় নেই। এই অল্প টাকা দিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চলে তার। গত মাসে বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির ডাকা আন্দোলনে তিনিও জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এসেছিলেন। প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়েছিলেন। অনশনেও অংশ নিয়েছিলেন। অনশন ভেঙে তিনি যেদিন নিঃস্ব রিক্ত হাতে বাড়ির পথে রওয়ানা হন তখন তার চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত।
প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলছিলেন, ‘আমরা কতোটা অসহায় বুঝাতে পারবো না। কোনো উৎসবে ছেলেমেয়ের একটা ভালো পোশাক কিনে দিতে পারি না। বাড়িতে একবেলা ভালো খাবার রান্না করতে পারিনা। কিন্তু এতো কষ্টের পরেও এই পেশায় আছি মনের টানে।’ শওকতের মতে, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে। পাশের হারও ভালো। অথচ সরকার শিক্ষকদের সামান্য অধিকারটুকুর দিকে নজরই দিচ্ছে না। প্রধান শিক্ষক শওকত আলী তাও আড়াই হাজার টাকা বেতনভাতা পান। কিন্তু হাজার হাজার শিক্ষক আছেন যাদের কপালে এক টাকা জুটে না। তারা চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন বঞ্চনা দুর করতে ২০১৬ সালের নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার শহীদুল্লাহ বালিকা ইবতেদায়ী মাদ্রাসার চার শিক্ষক। সেখানে প্রতিকার না পেয়ে একপর্যায়ে তারা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন। এ বিষয়ে হাইকোর্ট নির্দেশনা দিলেও মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন তারা। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানিতে আদালত বৈষম্য দূর করতে নির্দেশ দেন।
আমার মতে, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের যে বেতন বঞ্চনা সেটা নিরসনে সরকারের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। একইসাথে এই মাদ্রাসাগুলোকে যুগোপযোগী করার প্রতিও সরকারের যথেষ্ট নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এই সব মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন সুবিধাদি অবশ্যই বাড়াতে হবে। আমরা জানি প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নেই এ ধরনের মাদ্রাসা রয়েছে। যেখানে মূলত গরীব ও অসহায় দুঃস্থ পরিবারের শিশুসন্তানেরা লেখাপড়া করে থাকে। সামাজিকভাবে এসব মাদ্রাসার শিক্ষকরাও দারুণভাবে উপেক্ষার শিকার।
ফলে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলোকে মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আনার সুউদ্যোগ ও কৌশল এখনই নিতে হবে। বৈষম্য ও তীব্র বঞ্চনার বৃত্ত থেকে তাদেরকে বের করে আনতে না পারলে তা ভবিষ্যতে বড় ধরনের ক্ষতির কারণ যে হবে না এমন আশংকা অমূলক নয়। বৈষম্য-বঞ্চনার সামাজিক ফলাফল খারাপ হতে সময় লাগে না। নীতি নির্ধারকদের এ বিষয়ে অবশ্যই আন্তরিক হতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)