একুশ নিয়ে যে কবিতাটি আমার বারবার পড়তে ভালো লাগে, সেটা হচ্ছে কবি আল মাহমুদের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি।’ কবি নিজের কবিতায় খুব ছন্দবদ্ধভাবে অথচ স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন একুশের ছবি। জাতির বেদনার ও শক্তির প্রতীক এই একুশকে পালন করতে হয় হৃদয় দিয়ে, অনুধাবণ করতে হয় ইতিহাস থেকে। কবির ভাষায়,
“ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়
বরকতের রক্ত।
হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে !
প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে
ছড়াও ফুলের বন্যা
বিষাদগীতি গাইছে পথে
তিতুমীরের কন্যা।”
একুশকে ঘিরে, একুশের চেতনাকে নিয়ে আমাদের চারপাশে যা হচ্ছে, তাতে রাগ করবো? হাসবো? নাকি কাঁদবো? ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে এটা ঠিক যে আমাদের ক্ষমা চাওয়া উচিৎ ভাষা আন্দোলনে শহীদদের কাছে, তাঁদের পরিবারের কাছে। তাঁরা যদি সেদিন ঘুনাক্ষরেও একবার আঁচ করতে পারতেন যে বাংলা ভাষার জন্য তাঁদের আত্মদানের ৬০বা ৬৫ বছর পর, বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন জগৎ তাদের নিয়ে এইভাবে টানা-হেঁচড়া করবে , তাহলে হয়তো ওনারা তখনই একটা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যেতেন।অথবা তাদের পরিবার কোন একটা উদ্যোগ নিতেন। ইতিহাস না জেনে শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনী ঝোঁকের বসে চারিদিকে ভাষা সৈনিকদের নিয়ে যা চলছে, যেভাবে তাঁদের ব্যবসায় ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে একজন বাঙালি হিসেবে আমি লজ্জিতবোধ করছি, অপমানিতবোধ করছি ।
যে যেভাবে পারছে ব্যবহার করছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে, একুশের চেতনাকে, ভাষা সৈনিকদের। এই দিবসটির প্রতি তাদের পক্ষ থেকে নূন্যতম কোন ভালবাসা, শ্রদ্ধা লক্ষ করা যাচ্ছেনা। এরা হয়তো অনেকে জানেই না ভাষা আন্দোলনটি কেন হয়েছিল, আমাদের জাতীয় জীবনে এর অবদান কী? ভাষা শহীদদের অবস্থানটা আসলে আমাদের জীবনে কোথায়? এরা সবকিছুকে উৎসবে পরিণত করতে গিয়ে, বিষয়টিকে একধরণের ফাইজলামিতে পরিণত করছে। এদের বাঁধা দেয়ার কেউ নেই, ভুল ধরিয়ে দেয়ার মত নেই কোন কর্তৃপক্ষ। এ ধরণের সস্তা বিজ্ঞাপণী প্রচারণা ঠেকানোর বা থামানোর কোন উদ্যোগ নেই। তাই তারা যা খুশি তাই প্রচার করছে।
কেক, বিস্কুট থেকে শুরু করে কাপড়-চোপড়, জুতা সবখানেই ব্যবহৃত হচ্ছেন ভাষা সৈনিক ও ভাষা শহীদেরা। ভাষা দিবস উপলক্ষে কেন হোটেল-রেস্তোরাকে ছাড় দিতে হবে? এটা কি ঈদ বা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখের মত কোন অনুষ্ঠান বা উৎসব? আমরা হয়তো ভুলেই গেছি একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের শোক ও শক্তির প্রতীক। ভাষার জন্য পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে শুধু এই বাংলা মায়েরই সন্তান। ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছে শুধু এদেশের সন্তানরাই। বিশ্বের আর কোন দেশের মানুষ জানেনা নিজের মায়ের ভাষার জন্য যুদ্ধ করতে হয়। আর তাই আমি যখন কোন বিদেশিকে আমাদের ভাষা আন্দোলনের কথা বলেছি, ওরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে। এই দিবসটি বিশ্বের আর কোন দিবসের সাথেই এক কাতারের নয়। আর তাই একে স্মরণ করা হয় ভিন্নভাবে। একুশের প্রথম প্রহর মানে আমাদের কাছে অনেককিছু ।
একুশ মানে রক্তের রং মাখিয়ে কেক কাটা নয়, একুশ মানে জুতার বা জামার উপর ছাড় দেয়া নয়, একুশ মানে মোবাইল ফোনের নতুন এ্যাপ নামানো বা অফার দেয়া নয়, পাঁচতারকা হোটেলে কম টাকায় খাওয়া নয়, এনজিও’র ইনে বা গেস্ট হাউসে কম টাকায় সেমিনার কক্ষ ভাড়া পাওয়া নয়। সারা মাস জুড়ে একুশকে ঘিরে নানা ধরণের পোশাক, শাড়ি-কাপড়, ফতুয়া-পাঞ্জাবীর নকশাদার বিজ্ঞাপণ চলছে, তা চলুক কিন্তু সাদা-কালো রংকে নামমাত্র ব্যবহার করে কি যে সব অদ্ভূত ডিজাইনের ছড়াছড়ি ঘটেছে, যা দেখলেও অস্থির লাগে । একুশের নাম ভাঙিয়ে যারা এসব উদ্ভট ডিজাইন করছে, সেইসব সামগ্রী যারা দোকানে বিক্রি করছে, যারা বিজ্ঞাপন বানাচ্ছে এবং আমরা যারা কিনছি ও পরছি সবাই দলবদ্ধভাবে ধ্বংস করছি একুশের প্রতি আমাদের ভালবাসা ও আবেগকে।
একুশকে সামনে রেখে দোকানিরা শাড়ি কাপড়, জামা-পাঞ্জাবী তৈরি করে আসছে বহুদিন ধরেই। খুব ব্যাপকভাবে না হলেও অনেকেই সাদা-কালো পোশাক কিনে থাকে একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে পরবার জন্য । এতবছর ধরে দেখে আসছি একুশের দিনে মেয়েরা কালো পেড়ে সাদা শাড়ি পরে, আর ছেলেরা সাদা বা কালো পাঞ্জাবী পরে পায়জামা ও প্যান্টের সাথে । কিন্তু এখন একুশে ফেব্রুয়ারিটাও যেন পণ্য হয়ে উঠেছে । মনের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ব্যবসা। এমনকী একটি ক্যাফেতে দেখলাম শহীদ দিবস উপলক্ষে আলোকসজ্জাও করা হয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে পড়লাম একটি তেলের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, “সময়টা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। মায়ের ভাষার জন্য লড়াই করতে গিয়ে বীর শহীদদের বুকে বেঁধেছিল বুলেট। প্রাণ দিয়েছিল প্রিয় বর্ণমালার জন্য। তবুও তারা পিছপা হয়নি। ভাষার দাবিতে ছাড় দেয়নি একচুলও। তাদের এই আত্মত্যাগ আমাদের অনুপ্রাণিত করে এক চুলও ছাড় না দিতে।” কীসের সাথে কীসের তুলনা ভাবতেও অসহ্য লাগছে। মানুষের অনুভূতিবোধ কোন পর্যায়ে থাকলে এরকম একটি অনুভূতি নিয়ে এভাবে বিজ্ঞাপন তৈরি করতে পারে?
শুধু কি পণ্যের বিজ্ঞাপন? বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শোক আয়োজনেও একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে নানাধরণের ভুল-ভ্রান্তি চোখে পড়ল। ফেইসবুকে বিভিন্নজন এর বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরেছে। ভাষা শহীদদের জায়গায় কেউ হয়তো ব্যবহার করেছে বীরশ্রেষ্ঠদের ছবি। কেউ হয়তো লিখেছে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছো তোমরা। বিজ্ঞাপন ও প্রচারণার ভীড়ে যদি ইতিহাস হারিয়ে যায়, তাহলে কিন্তু বিপদ। এমনিতেই আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস, স্বাধীনতার ঘোষণা, এমনকী শহীদদের সংখ্যা নিয়েও বিভিন্ন ধরণের মতামত পাওয়া যায়। এরপর যদি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়েও যে যা খুশি লিখে ফেলে, তাহলে হয়তো কোন একদিন দেখবো এই ভুলগুলোই হয়ে গেছে ইতিহাস। তাহলে কি সেটা অপরাধ হবেনা?
এখন আমাদের জাতীয় দিবসগুলোকে ঘিরে উৎসবের আয়োজন বেশি। অনেক মানুষের অংশগ্রহণ ও সমাগম থাকে। রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় পর্যায়েও নানাধরণের অনুষ্ঠানসূচি থাকে। অথচ আমরা যারা সেই ১৯৭২ বা ১৯৭৩ সাল থেকে মানে আট-নয় বছর বয়স থেকে শহীদ মিনারে যাচ্ছি, তারা খুব ভাল করে বুঝতে পারছি আজকের দিনের গলদটা কোথায়? এত আয়োজন, এত উচ্ছ্বাস, এত জৌলুস থাকার পরও আমাদের কী হারিয়ে যাচ্ছে?
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই করতাম খেলাঘর। সেই সুবাদে কলোনি থেকে প্রতিবছর একুশের সকালে প্রভাতফেরীতে অংশ নেয়াটা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল। সময়টাই ছিল অন্যরকম। আমরা ছোটরা কলোনির বড় ভাই বোনদের সাথে আসাদগেট থেকে আজিমপুর গোরস্থান হয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যেতাম। পায়ে হেঁটে, গান গেয়ে, আবৃত্তি করতে করতে আমরা পৌঁছে যেতাম শহীদ স্বপ্নের কাছাকাছি ।
তারপর থেকে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কখনও বাদ পড়েনি একুশের প্রভাতফেরী। মা, খালা কারো কাছ থেকে একটা সাদা শাড়ি যোগাড় করে দলেবলে চলে আসতাম শহীদ মিনারে, বইমেলাতে। সারাটা মাস জুড়ে এই ২১ ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে ছিল আমাদের কত তোড়জোড়, কত অনুষ্ঠান। আমাদের ছিল অফুরান প্রাণশক্তি, চেতনা, ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং কিছু একটা করার তাগিদ। আমার মেয়েকে কোলে নিয়েও সবাই মিলে গিয়েছি একুশের প্রথম প্রহরে ।
এখন নানাভাবে, অনেক বড় করে, সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে একুশকে স্মরণ করা হয় এটা খুব ভাল। শুধু একটিই আবেদন আয়োজনের ভারে ইতিহাস যেন চাপা পড়ে না যায়। দেশের সচেতন বুদ্ধিজীবি সমাজ, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সর্বোপরি সরকারকে জোরালোভাবে এদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে ইতিহাস নষ্টের যেকোন অপতৎপরতাকে। আমাদের কাছে একুশ মানে প্রথম প্রহর, প্রভাতফেরী, ফুলের বন্যা, শহীদ মিনার, শোক-শক্তি, সাদা-কালো রং, বাংলাকে ভালবাসা এবং মা কে ভালবাসা। বারবার বলতে চাই —-
“প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, আমি
জন্মেছি এই বঙ্গে।”
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)