সদ্য প্রয়াত ময়মনসিংহের সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রাণ পুরুষ স্নেহাশীষ চৌধুরীকে (৮১) স্মরণ করে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ।
‘স্নেহাশীষ চৌধুরী স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি’ এমন শিরোনামে রোববার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছেন;
‘‘ময়মনসিংহের সংস্কৃতিজগতের অন্যতম অভিভাবক স্নেহাশীষ চৌধুরী গত শুক্রবার ৩ এপ্রিল তাঁর ময়নসিংহ শহরের মহারাজা রোডের বাড়িতে শেষ-নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮৩ বছর। তাঁর মৃত্যুতে আমি আমার একজন প্রিয় অগ্রজপ্রতিম অভিভাবককে হারালাম।
তাঁর মতো বুদ্ধিদীপ্ত রসিক মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। আমরা পরস্পরের সঙ্গে ময়নসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতাম। এবং তাতে প্রভূত আনন্দ হতো। তাঁর আঞ্চলিক শব্দের ভান্ডারটি ছিলো আমার চেয়ে সমৃদ্ধ। তাই শেষতক আমাকেই হার মানতে হতো।
তিনি আমার প্রতিটি কাজের প্রসংশা করতেন বলে আমি তাঁর সঙ্গে সর্বদা ফোনে যোগাযোগ রাখতাম, মত বিনিময় করতাম এবং তাঁর অকৃপণ প্রসংশায় নিজেকে সমৃদ্ধ করতাম।’’
কবি নির্মলেন্দু গুণ আরও লিখেছেন, ‘‘তিনি একবার রবীন্দ্রজয়ন্তীতে কাশবনে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি কবিতাকুঞ্জে গিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিলো মগরা নদীর তীরে, কবিতাকুঞ্জ কিছুদিন থাকবেন, সেখানকাী নিরিবিলি পরিবেশে বই পড়ে কাটাবেন। সেই লক্ষ্যে পুত্র পলাশকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েওছিলেন কবিতাকুেঞ্জ। কিন্তু বিধি বাম, তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর পুত্র পলাশ তাঁকে কবিতাকুঞ্জে রাখাটা নিরাপদ নয় মনে করে তাঁকে ময়মনসিংহের মহারাজা রোডের বাসায় নিয়ে যায়।
তখন তাঁর সঙ্গে ফোনে আমার কথা হলে, তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, এবার আর কবিতাকুঞ্জে থাকা হলো না– কিন্তু আমি একটু সুস্থ হলে পরে আপনার কবিতাকুঞ্জে আবার যাবো। কী চমৎকার পরিবেশ, কবিতাকুঞ্জের গ্রন্থ-সংগ্রহ দেখে আমি যাপরনাই আনন্দ পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন সোভিয়েত রাশিয়া ভ্রমণ না করলে তাঁর একটি তীর্থ দর্শন অসমাপ্ত থেকে যেতো– আমিও তাঁর কথা ধার করে বলি– কবিতাকুঞ্জ দর্শনে আমি তীর্থদর্শনের আনন্দ পেয়েছি।
আমার নিজের হাতের লেখা চিঠি /কোনো রচনা/কবিতার পান্ডুলিপি খুব সহজলভ্য নয়। আমার বিখ্যাত কবিতা “স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো” ময়মনসিংহের ধোপাখোলার ভাড়া-বাড়িতে লিখেছিলাম। সেই কবিতার পান্ডুলপি সংরক্ষণ করা হয়নি। মনে হয় আমি আমার রচনাকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলে মনে করিনি।
পলাশ চৌধুরী আমার ১৯৭৮ সালে লেখা একটি সংশাপত্র আমাকে ইনবক্সে পাঠিয়েছে। ৪২ বছর আগে আমার হাতের লেখা কেমন ছিলো, আমার লেখার ভাষা কেমন ছিলো, আমার বিষয়বক্তব্য উপস্থাপনের কৌশল এবং আমার স্বাক্ষরটি কীরকম ছিলো– তা জানা গেলো ঐ ছোট্ট চিরকুটপত্র থেকে।
করোনার মরণআতঙ্কের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হওয়াতে, তাঁর অন্তেষ্টিক্রিয়ায় কেওয়াটখালী শ্মশানে তাঁর অনুরাগী বন্ধুবান্ধব এবং ভক্তদের ভিড় ছিলো না। জীবনের চারপাশকে নির্মল আনন্দে মুখরিত করে রাখা মানুষটি — নিঃশব্দে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলেন।
তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে নিবেদন করি আমার গভীর গভীরতর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।’’
ভূমিদস্যুদের ষড়যন্ত্রে নিজ বাড়ির বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর কয়েকদিন অন্ধকারে থেকে, শেষ পর্যন্ত সেই আলো-বাতাস বিহীন বাড়িতেই পরলোকগমন করেন স্নেহাশীষ চৌধুরী।
জীবদ্দশায় ন্যায়বিচার চেয়ে অসংখ্য মানুষের কাছে গিয়েও নিজের পারিবারিক সম্পত্তির সমস্যা সমাধান করতে পারেননি তিনি।