মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া কয়েক লাখ রোহিঙ্গা এখন বিষফোঁড়ার মতো হয়ে উঠেছে। এক সময় মানবিক কারণে যারা রোহিঙ্গাদের সাহায্যার্থে দুই হাত বাড়িয়েছিলেন, সেই টেকনাফবাসীই এখন রোহিঙ্গাদের ‘গলার কাঁটা’ মনে করছেন। সম্প্রতি টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজার সদরের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে স্থানীয় মানুষের এখন আর কোনো সহানুভূতিই আর অবশিষ্ট নেই। অথচ এই মানুষগুলোই একসময় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ছিলেন। নিজেরাও যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের সহযোগিতা করেছেন। এক বছরের ব্যবধানে কক্সবাজারের মানুষেরা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ক্ষোভ ও নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে যে সব সমস্যা বা সম্ভাব্য বিপদের কথা উঠে এসেছে সেগুলো হলো:
পরিবেশ বিপর্যয়
আবাসন বানাতে গিয়ে মাইলের পর মাইল পাহাড়কাটা, জ্বালানির জন্য বন উজাড়, আসবাবের জন্য বড় বড় গাছগুলো কাটার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হতে চলেছে। ইতিমধ্যেই গরম বেড়ে যাওয়া, বৃষ্টি কমে যাওয়া, অক্সিজেনের ঘাটতি, কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে যাওয়ার কারণে নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়া এবং পাহাড় ধ্বংসের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন অনেকে।
যোগাযোগ বিপর্যয়
রাস্তাঘাটে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় গন্তব্যে পৌঁছতে বেশি সময় লাগছে এই অভিযোগ সবার। আগে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার যেতে সময় লাগত ২ ঘণ্টা এখন ৪ ঘন্টাও লাগে।’ রাস্তায় দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে, বাচ্চাদেরকে নিয়ে শঙ্কায় অনেকে একা স্কুলে পাঠাচ্ছেন না, দুর্ঘটনার ভয়ে একজন বাচ্চার স্কুল বন্ধ করে দিয়েছেন বলেও জানান।
কৃষিজমি কমে যাওয়া
আশ্রয় শিবির এবং আশ্রয় শিবিরে যাবার পথঘাট নির্মাণ করায় কৃষিজমি কমে এসেছে। ফলে এখানে শস্য ও সবজি সরবরাহও এখন অনেক কম। পশুচারণের ভূমিও এখন অনেক কমে গেছে। স্থানীয় শ্রমবাজারকে পুরো ধসিয়ে দিয়েছে উদ্বাস্তুরা। স্থানীয়রা তাদের জীবিকার উপায় হারিয়ে ফেলেছে। ওদিকে অনেকে বেশি লাভের আশায় কৃষিজমিতে ঘর-বাড়ি তৈরি করে ভাড়া দিচ্ছে জমির মালিকরা। কারণ এখানে এখন অসংখ্য জাতীয়-আন্তর্জাতিক এনজিও কাজ করছে। তাদের অফিস, কর্মচারীদের থাকার জায়গার জন্য নতুন নতুন স্থাপনার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে।
শ্রমবাজার দখল
রোহিঙ্গারা স্থানীয় শ্রমবাজারে ঢুকে পড়েছে। রোহিঙ্গারা সস্তায় শ্রম বিক্রি করায় স্থানীয় শ্রমজীবীদের কাজের অভাব দেখা দিয়েছে। এতে করে স্থানীয় শ্রমজীবীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। ‘যে কাজে আগে ৫০০ টাকা মজুরি পাওয়া যাইত, তা রোহিঙ্গারা করে ২০০ টাকায়। ওরা ফ্রি খাবার পায়, রেশন পায়। নগদ যা পায় তাই লাভ। আর আমাদের পেটে লাথি পড়ছে।’
জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি
স্থানীয় শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষের আয় কমেছে, কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০ টাকার মাছ ১০০ টাকা, ২০ টাকার সবজি ৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। বাড়ি ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন অনেক চাকরিজীবী এবং উপজেলা সদরগুলোতে থাকা ভাড়াটিয়া। ‘আমার এই দোকানের সালামি ছিল ১০ হাজার টাকা, গত মাসে দেড় লাখ টাকা সালামি চাইছে। বলছে না দিতে পারলে দোকান ছেড়ে দাও। ‘একজন বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা জানালেন, ‘আমার পরিবার ঢাকায় থাকে। আমি ঢাকায় গুলশানের দুই রুমের বাসায় ভাড়া দেই ১৮ হাজার টাকা, আর এখানে ২ রুমের বাসা ভাড়া করেছি ২৩ হাজার টাকায়, কিছু করার নাই।‘
মাদক এবং অপরাধ বেড়ে যাওয়া
মাদক ব্যবসা (ইয়াবার কথা বলেছেন অনেকে), চোরাচালান ও মাদক ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ওদেরকে ব্যবহার করে অনেকে মাদক ব্যবসা করে রমরমা অবস্থায় চলে যাচ্ছে এমনটাও মনে করছেন অনেকে। রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে ক্যাম্পে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাচ্ছে। তারা ক্রমেই নৃশংসতার দিকে যাচ্ছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা কথা প্রসঙ্গে জানালেন, গত এক বছরে রোহিঙ্গাদের হাতে ২২ জন রোহিঙ্গা খুন হয়েছে। এতে ক্যাম্পের নিরীহ রোহিঙ্গাসহ স্থানীয়দের মনে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ আগ্নেয়াস্ত্র নতুবা ধারালো অস্ত্র ব্যবহার বা প্রদর্শনের মাধ্যমে ভীতি সঞ্চার করে কতিপয় রোহিঙ্গা কোনো না কোনো ক্যাম্পে নিয়মিত ডাকাতি, মাদকবিক্রি, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা রকম সহিংস অপরাধ করে আসছে।
হেনস্থা
স্থানীয়দের এলাকায় চলাফেরা করতে গিয়ে নিজেদেরকে ‘রোহিঙ্গা নয়’ সে পরিচয় প্রমাণ দেখাতে হয়। এটি তাদের জন্য পীড়নের কারণ হয়েছে। এক ব্যবসায়ী জানালেন, ‘এখানে (টেকনাফে) ন্যাশনাল আইডি এবং জন্ম নিবন্ধন সনদ দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে- রোহিঙ্গারা ভুয়া কার্ড করে বাংলাদেশিদের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে এই ভয়ে। ওরা ৩০০০০ টাকা দিয়ে কার্ড করায়ে ফেলে কিন্তু আমরা কার্ড করাইতে পারিনা।’
নিজের এলাকায় সংখ্যালঘু
রোহিঙ্গাদের আগমনে স্থানীয় জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু হয়ে পড়া, অনেকের চাষের জমি দখল হয়ে গেছে। রোহিঙ্গা সংকট ধীরে ধীরে স্থানীয়দের জীবনযাত্রাকেও তছনছ করে দিচ্ছে। আগে কক্সবাজার থেকে অন্যান্য স্থানে প্রচুর পরিমাণে পান ও তরমুজ বিক্রি হতো। কিন্তু এখানে এখন চাহিদা ও দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা অন্যস্থান থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করছেন। ‘আমরা আছি ৬ লাখ মানুষ আর ওরা ১০ লাখ, ওরাইতো বেশি। বুঝেন কেমন আতংকে আছি।’
আশঙ্কা
যদি বিদেশি সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়, তখন রোহিঙ্গারা যদি খুন-ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ে-এই আশঙ্কা। ‘সেনাবাহিনী সরে গেলেই এরা গ্রামে ঢুকে পড়বে।’ সামাজিক স্থিতিশীলতা কমে যাওয়া, সবসময় এক ধরনের ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছেন। অনেকে আশঙ্কা করেছেন এরা জঙ্গি হিসেবে যোগ দেবে অচিরেই। এরা ছড়িয়ে পড়ছে কক্সবাজারে, তারপর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে।
বিশেষায়িত শ্রমিকের অভাব
রাজমিস্ত্রিসহ বিশেষায়িত শ্রমিকরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজে যুক্ত হওয়ায় স্থানীয় মানুষদের প্রয়োজনের সময় বিশেষায়িত শ্রমিক পাওয়া যায় না। গেলেও অতিরিক্ত মজুরি দাবি করে।
পারিবারিক সংকট
কোনো কোনো পুরুষের রোহিঙ্গা নারী বিয়ে কারণে পারিবারিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এক গৃহবধূ ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, আমার স্বামীর আগে শুঁটকির দোকান ছিল, এখন এইটা বেচে দিছে, সারাদিন ক্যাম্পে থাকে, কখন আসে কখন যায় জানিনা। কিন্তু বাড়িতে টাকা দেয়না ঠিকমত।
শিক্ষা ক্ষেত্রে ফলাফল বিপর্যয়
একজন স্কুল শিক্ষকের মতে, এখানে এখন কর্মসংস্থানের লোভে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার চাকরিতে যোগদান করছে। এতে করে তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ অনিশ্চিত, ড্রপআউটের হার বৃদ্ধি, সরকারি চাকরিতে প্রবেশ বা বড় কিছু হওয়ার পথ থেকে সরে আসায় ভবিষ্যৎ সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক ফল ফলতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
মনস্তাত্বিক সংকট বনাম রোহিঙ্গাদের মনোভাব
দুই দেশের মানুষ এক দেশে থাকার কারণে মনস্তাত্বিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অন্যায্যভাবে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা করা, পক্ষান্তরে স্থানীয়দের কাজের অভাবে না-খেয়ে থাকার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় নিজেদেরকে বঞ্চিত ভাবছেন স্থানীয়রা। স্থানীয় হাসপাতালে রোহিঙ্গাদের অগ্রাধিকার দেওয়া স্থানীয়দের চিকিৎসা সেবা পাবার ক্ষেত্রে সংকট আছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন নারী। “রোহিঙ্গারা অশিক্ষিত, বর্বর। উগ্র আচরণ করে। আগে তারা কথা শুনত। যত দিন যাচ্ছে ততই তারা একরোখা হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন বঞ্চনা এবং নির্যাতনমূলক পরিবেশের মধ্যে থাকার কারণে তাদের মধ্যে মানবিক অনুভূতিগুলো লোপ পেয়েছে। তারা কারও কথা শোনেনা। ঔদ্ধত্যমূলক আচরণ করে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দায়িত্ব তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা। ক্যাম্পে থাকা-খাওয়া, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া তাদের অধিকার বলে তারা মনে করে। তারা কারও শুনতে রাজি নয়।’ রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে স্থানীয় অনেক উন্নয়নকর্মী এমন দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব পোষণ করেছেন। একজন তো ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, “রোহিঙ্গারা এমন কথাও বলে যে ‘আমরা আছি বলেই আপনাদের চাকরি আছে’। ‘আমাদেরকে জাতিসংঘ খাওয়ায়, হাসিনা খাওয়ায় না’। এসব শুনে মনে হয়, কষে একটা থাপ্পর লাগাই!
প্রশ্ন হলো, যাদের অন্তকরণ জুড়ে এত ক্ষোভ আর অসন্তোষ, তাদের সঙ্গে কোনো রকম ঝগড়া-ফ্যাসাদ ছাড়া রোহিঙ্গারা কতদিন টিকতে পারবে? আর স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিরোধ যদি সত্যি সত্যি চরমে পৌঁছে, তখন সেই পরিস্থিতিই বা কীভাবে সামাল দেওয়া যাবে?
সরকার, বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠনসহ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষকে বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে।
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)