চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

স্টার হওয়া বা কোটি টাকা কামানোর জন্য অভিনয় করি না: চঞ্চল

মুখোমুখি ‘তাকদির’ এর চঞ্চল চৌধুরী…

সফল অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই নিজের ক্যারিশমা দেখিয়েছেন! মঞ্চ, নাটক আর সিনেমার মতো এবার নিজেকে প্রমাণ করলেন হাল সময়ের ‘ওয়েব সিরিজ’ এ! ভারতীয় ওটিটি প্লাটফর্ম ‘হইচই’তে রিলিজ পেয়েছে তার অভিনীত আট পর্বের ওয়েব সিরিজ ‘তাকদির’। সৈয়দ আহমেদ শাওকীর পরিচালনায় লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ির ড্রাইভারের চরিত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে চঞ্চল চৌধুরী বাজিমাৎ করেছেন। কাজটি এতোটাই আলোচিত হয়েছে যে, এমএক্স প্লেয়ারেও সিরিজটি হিন্দিতে ডাবিং করে উন্মুক্ত করা হয়েছে। নেটদুনিয়ায় অনেকেই সিরিজটি দেখে গত কয়েক বছরের অন্যতম সেরা বাংলা ওয়েব সিরিজ বলে উল্লেখ করছেন। ‘তাকদির’ ও দেশীয় নাটক, ওটিটি প্রসঙ্গ নিয়ে চঞ্চল চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয় চ্যানেল আই অনলাইনের.. 

দাদা, কেমন আছেন? ‘তাকদির’ তো ব্যাপক সাড়া ফেললো। দাপুটে চঞ্চল চৌধুরীকে দেখলাম!

ধন্যবাদ ভাই। সারাবছর চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকি কখন একটা ভালো চরিত্র, গল্প, নির্মাণ ও পরিচালক পাব। এটার উদ্দেশ্য একটাই, দর্শক যেন ভালো কিছু পায়। আমরাই আমাদের কাজ দিয়ে দর্শকের মান নিচে নামিয়েছি। কিন্তু উপরে উঠানোর চিন্তা খুব বেশি মানুষ করিনি। শিল্পীরা এখন আদর্শ ও নীতিগত জায়গা থেকে সংখ্যালঘু হয়ে গেছে। আমি যখন উচিত কথাগুলো বলি কাউকে পাশে পাই না। হয়তো অনেকেই বলার চিন্তা করছেন কিন্তু সাহস পাচ্ছেন না। ইন্ডাস্ট্রির এমন অধঃপতনের সময়ে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ইন্টারভিউ বা ফেসবুক স্ট্যাটাসে প্রতিবাদ করলে কাউকে সাথে পাই না। এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। ওয়েব সিরিজ করলে সমালোচিত হতে হয়, ওয়েব সিরিজ মানেই খারাপ এমন একটা ধারণা ছিল দর্শকদের মধ্যে। সেসব দর্শকই আজকে ‘তাকদির’ দেখে বাহবা দিচ্ছেন। গত দুই বছর বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আমাকে ওয়েব সিরিজ করার জন্য বলা হলেও করিনি। কারণ আমি চেয়েছিলাম, যেটা করবো সেটা যেন ওয়েব সিরিজের মানদণ্ড হয়।

‘তাকদির’ এর পেছনের দৃশ্য…

বাংলাদেশের পাশাপাশি ওপার বাংলা থেকে কেমন ফিডব্যাক পাচ্ছেন? 

ট্রেলার প্রকাশের পর থেকে ফিডব্যাক আসা শুরু করেছে। কলকাতার মীরের উপস্থাপনায় একটি ইন্টারভিউতে অংশ নিয়েছি। সেখানে অনেকের মন্তব্য পেয়েছি। এছাড়া ওপার বাংলার ইউটিউবভিত্তিক প্রচুর ফিল্ম সম্পর্কিত মাধ্যম থেকে পজিটিভ রিভিউ দিচ্ছে। কয়েকদিনেই কলকাতার অনেকে দর্শক দেখেছেন এবং রেসপন্স দুটোই সন্তোষজনক। এক কথায় খুব খুবই ভালো।

‘তাকদির’ একজন লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ির ড্রাইভার, যেটি আপনি করেছেন। এমন চরিত্র ও ব্যক্তির সঙ্গে পূর্ব পরিচিত ছিলেন? চরিত্রটির জন্য আপনার প্রস্তুতি কেমন ছিল?  

আমি কখনই ভাবিনি এই ধরনের চরিত্র নিয়ে পর্দায় হাজির হবো। আমি গ্রামের সাধারণ ছেলে। আমার জন্ম যেখানে সেখানে কৃষক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষদের বসবাস। তাদের জীবনটা আমাকে টানে। এদের প্রতি আমার আলাদা দায়বদ্ধতা অথবা ভালো লাগা অনুভব করি। একসময় নাটক সিনেমাতে তাদের চরিত্র নিয়ে কাজ হতো, কিন্তু এখন আর হয় না। এখন গল্প হয় ঢাকাকেন্দ্রিক। তথাকথিত অনেক স্টার রয়েছেন যারা ব্র্যান্ডের পোশাক রেখে খোলসের বাইরে যেতে চান না বা যাওয়ার ক্ষমতা নেই। ‘তাকদির’ চরিত্রের জন্য আমার কমপক্ষে ছ’ মাসের প্রস্তুতি ছিল। তারপর সেপ্টেম্বরে গিয়ে শুটিং করলাম।

যে কটা সিনেমায় কাজ করেছেন সবগুলো মাইলফলক। গল্প, চরিত্র থেকে সবকিছু নির্বাচনে আপনি প্রত্যেকবার দক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকেন…  

একেক মানুষ একেক উদ্দেশ্যে কাজ করতে আসেন। অভিনয় আমার ভালো লাগা ও ভালোবাসার জায়গা। শিল্পচর্চার জায়গা থেকে কাজ করি। আমি চারুকলায় পড়ালেখা করেছি, থিয়েটার করেছি তবে পেশাদার অভিনেতা হবো চিন্তা করিনি। আমি স্টার হওয়ার জন্য কিংবা কোটি কোটি টাকা কামানোর জন্য অভিনয় করি না। প্রতিদিন শুটিংয়ে মোটা বান্ডেলের টাকা থাকে, কিন্তু আমি যাই না। অনেক শিল্পী আছেন যারা হাজিরা দিয়ে মোটা অংকের বান্ডেল আনেন। কিন্তু কী কাজ করলো সেটা দেখেন না। ভালো কাজ পেলে পাঁচ দিন শুটিং করি, কোয়ালিটি কাজ না পেলে কোনো মাসে কাজে যাই না। এই যে বসে থেকে একমাসে মোটা বান্ডেল ঘরে আনি না তার কারণ হচ্ছে যে কাজটি করবো সেটা যেন মানসম্মত হয়। শুধু টাকার জন্য কাজ করে লাভ নেই। এ কারণে ১০ বছরে আমার মাত্র সিনেমার সংখ্যা মাত্র ৬টি। সবকিছুর মূলে হচ্ছে কাজটি মানসম্মত কিনা বাছাই করা এবং নিজের দায়বদ্ধতা ও সততা দিয়ে কাজ করা। তাহলেই ভালো কাজ হয়। এটা আহামরি জাদুবিদ্যা না। তবে কষ্ট হচ্ছে, ছাড় দিতে হয়। লোভ কম রাখতে হয়। দর্শকদের মানসম্মত কাজ দেয়ার জন্য দায়িত্ববোধ থাকতে হয়। যেটা একজন শিল্পীর দায়। শিল্পীর যদি দায়বদ্ধতা না থাকে, অন্য পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে তার কোনো পার্থক্য থাকে না। শিল্পীর সম্মানটা আমরা নিচু করে ফেলছি নিজেদের অ্যাটিচিউড দিয়ে। আর দশটা পেশাজীবীর মতো আমার অ্যাটিচিউড হলে আমি শিল্পী কেন?

‘তাকদির’র গল্প আমাদের, শুটিং লোকেশন, শিল্পী, পরিচালক সবই আমাদের; অথচ লগ্নি করলো ইন্ডিয়ার ওটিটি প্লাটফর্ম। সবই আমাদের থাকা সত্বেও এতো চমৎকার কাজের উদ্যোগ বাংলাদেশ থেকে কেন নেয়া হচ্ছে না? 

আমাদের ইন্ডাস্ট্রি প্রফেশনাল ইন্ডাস্ট্রি না। ভালো কাজের জন্য প্রফেশনাল হতে হয়। হঠাৎ অ্যামেচার অ্যাটিচিউডে একটা ‘মনপুরা’ অথবা একটা ‘আয়নাবাজি’ হতে পারে। কিন্তু এটার ধারাবাহিকতা রাখতে চাইলে সবার আগে দরকার প্রফেশনালিজম। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি সেই অবস্থানে যেতে পারে নাই। কারণ, এখানে ব্যক্তিগত ইস্যুতে কাজ চলে। একজন অন্যজনে নাক গলাই, সুবিধা নেই; এই চলছে। নতুন যেসব প্লাটফর্মগুলো আসছে আমার জানা নেই তারা কেমন চিন্তা নিয়ে আগাচ্ছে। হয়তো আগামীতে এমন কাজ আমাদের উদ্যোগের লগ্নিতে হতে পারে। আমিও চাই এমন কাজ আরও হোক।

‘তাকদির’ এর একটি দৃশ্যে চঞ্চল চৌধুরী

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলুন বাংলাদেশের কনটেন্ট দিয়ে ওটিটিতে কাজের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে? 

আমাদের সবসময় যোগ্য অভিনেতা, পরিচালক ছিল; কিন্তু ক্ষেত্রটা তৈরি না। আমাদের দৃষ্টিসীমা সীমিত। ম্যাক্সিমাম ক্ষেত্রে আমরা টাকা ও ব্যবসাকে চিনি। নাটক সিনেমা হচ্ছে পারফর্মিং আর্ট। এসব দিয়ে যখন ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়াতে যায় যোগ্য মানুষগুলো থাকার দরকার। যারা টিভি, এজেন্সি চালান বা এর সঙ্গে নিয়োজিত তাদের শুধু ব্যবসায়ী হলে হবে না। শিল্পটাও বুঝতে হবে। এই শিল্প বোঝার লোক খুব কম রয়েছে। এই সংখ্যাটা বাড়লে বাংলাদেশে অনেক ভালো কাজ করা অবশ্যই সম্ভব। ‘তাকদির’ যদি ভালো লেগে থাকে, এর গল্প, শিল্পী, পরিচালক, ক্যামেরাম্যান পুরোটাই আমাদের দেশের। শুধু অর্থনৈতিক সাপোর্ট এবং প্রচারণা করেছে ‘হইচই’। এই কাজটি করার যোগ্যতা আমার দেশের অবশ্যই আছে। আরও আগে তো আমাদের এখানে ওটিটি এসেছে, কই তারা তো এমন চিন্তা করে নাই! বরং তারা ইউটিউব থেকে লাখ, কোটি ভিউস পাওয়া নাটকগুলো তাদের নিজস্ব ওটিটিতে তুলে রেখেছে।

একটা কোয়ালিটি কাজের যা যা করা দরকার ‘হইচই’ তাই করেছে। এজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তাদের কোনো ধরনের প্রেসার ছিল না। তারা শিল্পী নির্বাচনে পরিচালককে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। কোনো কর্তৃত্ব দেখায় নাই। সেই প্রসিডিং অনুযায়ী আমাদের ওটিটি প্লাটফর্মগুলো যদি যায়, অবশ্যই আরও বেটার কাজ করা সম্ভব। পরিচালক শাওকীর কথা বলতে হয়। সে মানসিকভাবে সৎ এবং একেবারে পরিস্কার। নিজের মতো করে কাজ করেছে। শুধু ভালো কাজের তাড়না ছাড়া ওর মধ্যে কিছুই দেখিনি। সে চাইলে পাঁচ লাখ টাকা নিজের পকেটে রাখতে পারতো। গত ২০ বছরে আমি বহু মানুষের সঙ্গে কাজ করেছি। এই লোভের বাইরে গিয়ে কাজ করা পরিচালকের সংখ্যা আমি খুব কম দেখেছি। সরি টু সে… অনেকের সঙ্গে আমার প্রথম সিনেমায় কাজ হয়েছে। প্রথম সিনেমাতে তাদের যে মানুষ হিসেবে পেয়েছি, পরের বছরগুলোতে সেই আগের জায়গায় পাই নাই। নাটক বা সিনেমা দুই মাধ্যমেই দেখেছি। দুই দশকের ক্যারিয়ারে প্রথম পাঁচ বছর সততার সঙ্গে কাজ করবো পরের ১৫ বছর নেম ফেম বিক্রি করে অসৎ হয়ে টাকা কামাবো ওই অ্যাটিচিউড পরিবর্তন করতে হবে। আবারও বলছি, যোগ্যতার সঙ্গে সৎ থাকার মানসিকতা থাকতে হবে।

‘তাকদির’ এর একটি দৃশ্যে…

এসব কারণে তুলনামূলক আপনি কাজ করা একেবারেই কমিয়ে দিয়েছেন? 

আমার কাজ নিয়ে একদমই স্বপ্ন নেই। টিভি নিয়ে নেই, সিনেমা নিয়েও তেমন নেই। কারণ, সিনেমা করা মানে আমার ছয়মাসের রুটি রুজি শেষ! তবে এখন ওটিটির দিকে তাকিয়ে আছি। ওয়েব ফিল্ম বা সিরিজে যদি কোয়ালিটি বজায় রেখে কাজ করা যায়। সেই সুযোগটা এখানে রয়েছে যেটা টিভিতে নেই। আমার ছেলেটা বড় হচ্ছে। ঘরে থাকি, ওকে সময় দেই। তবে সামনে অমিতাভ রেজা, ফারুকী ভাই, শঙ্খ দাস গুপ্তসহ আরও কয়েকটা কাজের আলোচনা চলছে। আগামী চারমাসে হয়তো এ কাজগুলো করবো।