মূল লক্ষ্য অর্থনৈতিক সংস্কার হলেও সৌদি যুবরাজের ঘোষণায় কট্টর ওয়াহাবি মতবাদ থেকে পিছিয়ে আসার একটা সম্ভাবনা দেখছেন অনেকে। তাদের মতে, বিশ্ব বাস্তবতায় সৌদি আরব যে কট্টরপন্থা থেকে কিছুটা সরে আসছে এটা তারই প্রমাণ। তবে, এখনই চূড়ান্ত কিছু বলতে চান না তারা।
সৌদি আরবের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমান গত মঙ্গলবার এক ঘোষণায় বলেছেন, ‘এতদিন আমরা যা করেছি এখন তার উল্টোটা করবো। অর্থাৎ আমরা মধ্যপন্থী ইসলাম গ্রহণ করব, যার দ্বার সমগ্র পৃথিবী ও সব ধর্মের জন্য খোলা থাকবে।’
ইসলাম বিষয়ক গবেষকরা মনে করছেন, ‘মধ্যপন্থী ইসলাম’ থেকে সরে আসা বলতে বর্তমান যে সালাফিজম বা ওয়াহাবি মতবাদের নামে কট্টর ধর্মীয় রীতি চালু আছে সেখান থেকে সরে উদার ও আধুনিক ইসলামের দিকে ঝোঁকার ইঙ্গিত দিয়েছেন যুবরাজ। এই পদক্ষেপ সৌদি আরবের জন্য খুব একটা সহজ হবে না বলেও মনে করছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ কে এম খাদেমুল হক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘সৌদি আরবের রাজপরিবার পৃথিবীজুরে কট্টরপন্থী মতবাদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। রাষ্ট্রটাই গঠিত হয়েছিল ওয়াহাবি মতবাদের ভিত্তিতে। এখন তারা কট্টরপন্থী মতবাদ থেকে কিছুটা সরে আসবে। একটু মডারেট হবে। সারা পৃথিবীতে তারা কট্টর মতবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করত। সম্ভত এখন আর তা করবে না।’
এটাকে ইসলামের জন্য ভালো বলে মনে করেন তিনি: এর ফলে সারা বিশ্বে মুসলমানদের ভাবমূর্তির উন্নতি হবে। তবে বিষয়টা তারা সহজে বাস্তবায়ন করতে পারবে বলে মনে হয় না।
খুব দ্রুতই তাদের কূটনৈতিক চিন্তাধারারও কোনো পরিবর্তন হবে না বলে মনে করেন এ কে এম খাদেমুল হক।
সৌদি আরবের কট্টরপন্থা থেকে সরে আসা নিয়ে আরো বেশি সন্দেহপ্রবণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘সৌদি আরব রাষ্ট্রটাই প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় মতবাদের উপর। ওয়াহাবিজমকে ভিত্তি করে। সুতরাং এমন ঘোষণা হতে পারে বিশ্বকে কিছু একটা বুঝ দেওয়ার জন্য। এতে সে দেশের ওয়াহাবি মতাদর্শের কট্টর ওলামাদের সাথে মতাদর্শিক সংঘর্ষ বাঁধবে। কেননা, রাষ্ট্রকে যখন নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে ছাড় দিতে হবে, মানবাধিকারের বিষয়ে ছাড় দিতে হবে, তা তাদের বর্তমান নীতির সাথে যাবে না।’
সৌদি সরকার সে দ্বন্দ্বে যাবে না বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন: সৌদি আরব গোঁড়াপন্থি মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামে মধ্যপন্থী হলো হানাফিরা। আমরা যেই মতবাদে চলি। ওরা নিশ্চয় আমাদের মতবাদে আসবে না। আমরা যারা লিবারেল ইসলামে বিশ্বাস করি তাদেরকে ওরা কাফের মনে করে।
‘মধ্যপন্থী বলতে কী বোঝাচ্ছে সেটা পরিষ্কার না। তবে মনে হয় কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল করতে পারে। তাই বলে হানাফি, শিয়াদের বিষয়ে ওদের অবস্থান পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না,’ বলে চ্যানেল আই অনলোইনের কাছে তার মতামত তুলে ধরেন অধ্যাপক মো. মাহফুজুল ইসলাম।
বিশ্লেষকরা সন্দেহের মধ্যে থাকেলেও সৌদি আরবে কিছুটা পরিবর্তন যে আসছে না এমনও না।
পাঁচশ বিলিয়ন ডলারে যে অত্যাধুনিক শহর গড়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন সৌদি আরবের সংস্কারপন্থী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তার বিজ্ঞাপনে স্পোর্টস ব্রা পরা নারীদেরও দৌড়াতে দেখা যায়। সেখানে নারীরা পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। এই নারীদের অনেকের মাথায় নেই হিজাব।
রক্ষণশীল প্রাচীনপন্থী মানুষের স্থান হবে না ওই শহরে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে সমন্বিতভাবে কাজ করবে চালকবিহীন গাড়ি, ড্রোন এবং রোবট। শহরে বিনিয়োগকারীরা নিশ্চিতভাবে লাভবান হবেন বলে যুবরাজ সালমান আশ্বাস দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে, যুবরাজের স্বপ্ন বাস্তব হলে আমূল পরিবর্তন আসবে সৌদি নারীদের জীবনে। এক মাস আগেও সেখানে নারীদের গাড়ী চালানোর অনুমতি ছিল না। এমনকি এখনো সৌদি নারীদের লেখাপড়া, বেড়ানো, বিয়ের সিদ্ধান্ত নির্ভর করে পরিবারের কর্তার মর্জির উপর।
কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে বাস করে গুহাবাসীর মতো জীবনযাপন পদ্ধতি টিকিয়ে রাখতে চান না সংস্কারবাদী যুবরাজ। সম্প্রতি সৌদি আরবকে সব দেশের সব ধর্মের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
সৌদি আরবের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থার সমালোচনা করে যুবরাজ বিন সালমান ঘোষণা দেন, সৌদি আরব ‘মধ্যপন্থি’ ইসলামে ফিরে যাচ্ছে এবং উগ্রপন্থা ‘নিশ্চিহ্ন’ করার পরিকল্পনা করছে।
সৌদি আরব বহু বছর ধরে তার কট্টরপন্থি ইসলামি শাসন ও জীবনব্যবস্থার জন্য পরিচিত। সেই দেশের রাজধানীতে সেখানকারই দ্বিতীয় শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তির মুখে এমন বক্তব্য ছিল অতি রক্ষণশীল ধার্মিকদের উদ্দেশ্য করে, যাদেরকে ক্ষমতাসীন সৌদি রাজপরিবার সহ্য করছে শুধুই তাদের সমর্থনের বিনিময়ে।
যুবরাজ মনে করেন, সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠা থেকে চলে আসা কর্মপদ্ধতি এখন আর কাজ চালানোর মতো নয়।