কূটনীতির ইতিহাসে বিশেষভাবে আকষণীয় একটি সপ্তাহ অতিক্রম করলো পাকিস্তান। বিরল নিদর্শন উপস্থাপন করে একই সঙ্গে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ও সেনাপ্রধান রাহেল শরীফ (তাদের মধ্যে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই) সৌদি আরব ও ইরান সফর করেছেন। তাদের এই সফরকে মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশের মধ্যেকার সংঘাত প্রশমনের প্রয়াস হিসেবে দেখা হচ্ছে। দ্য ডিপ্লোম্যাট জার্নালে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও গত ২ জানুয়ারি প্রভাবশালী শিয়া নেতা নিমর আল-নিমরের ফাঁসি কার্যকর করেছে সৌদি আরব। ফাঁসি কার্যকরের পর প্রতিবাদী ইরানি জনতা তেহরানের সৌদি দূতাবাস তছনছ করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। যার জের ধরে ইরানের সঙ্গে কূটনীতিসহ সব ধরনের সম্পর্ক স্থগিত করে সৌদি আরব। দুই পরাশক্তির তিক্ততা মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক বিভক্তি আরো তীব্র করে তুলেছে।
সৌদি-ইরান বিভক্তিতে পাকিস্তানের ভূমিকা সম্পূর্ণভাবে সুস্পষ্ট নয়। ইরান বাদে বিশ্বের সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিয়া মুসলিমের বসবাস পাকিস্তানে। সৌদির সাথে পাকিস্তানের যেমন ঐতিহাসিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের শরিকানা আছে, তেমনি ইরানের সঙ্গে রয়েছে বিশাল সীমান্তের শরিকানা। তাই অন্য যেকোনো দিক বিবেচনার আগে রিয়াদ-তেহরান উভয়ের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখা ইসলামাবাদের কাছে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
ভূ-রাজনীতির যৌক্তিক কারণেই সৌদি আরব কিংবা তেহরান কারো দিকেই নির্দিষ্ট পক্ষ নেবে না এটা বিবেচিত ছিল। তবুও দুই শরীফের সফরের আগে পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সৌদি আরব এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মধ্যেকার সাম্প্রতিক উত্তেজনায় পাকিস্তান গভীরভাবে চিন্তিত।’
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার একই সাথে রিয়াদ ও তেহরান সফর করেন নওয়াজ শরীফ ও রাহেল শরীফ। প্রথমে সৌদি আরব এবং পরে ইরানে যান তারা। যদিও নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর থেকেই উভয়পক্ষের সাথে কথাবার্তা অব্যাহত রেখেছিলো পাকিস্তান।
দুই শরীফের সফরের আগেই পাকিস্তান সফর করে সে দেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী। পাকিস্তান রিয়াদের পাশেই আছে বলে এ সময় তাদের আশ্বস্ত করেন জেনারেল রাহেল শরীফ। তিনি এও বলেন, যে কোনো প্রয়োজনে পাকিস্তান তাদের পাশে দাঁড়াবে। আর রিয়াদে সৌদি কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময়ের সময় আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে কথা বলেন নওয়াজ শরীফ। এ সময় তিনি দুই দেশের মধ্যেকার বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানে উৎসাহিত করেন।
সৌদি আরবের পরের দিন তেহরান পৌঁছান দুই শরীফ। সেখানে তার প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সাথে বৈঠক করেন। নওয়াজ ও রাহেল শরীফ এমন একটি দিনে তেহরান পৌঁছান যার আগের দিনই ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করতে আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়। উপরন্তু তার আগের দিনই স্থানীয় কর্মকর্তারা দুই দেশের কৌশলগত বন্দর (পাকিস্তানের গোয়াধর, ইরানের চাবাহার) উদ্বোধন করে বলেন, ‘এই বন্দর দুটি, দুই বোনে পরিণত হতে পারে।’ রিয়াদের মতো তেহরানের উদ্বেগের কথা শোনার পর আঞ্চলিক বিষয়ে আলাপ করেন দুই শরীফ।
এটা আসলেই মজার ব্যাপার যে, পাকিস্তান ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে নিজেকে একজন সৎ মধ্যস্থতাকারী হিসাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে। ইরান ও সৌদি আরবের বিভক্ত ভূ-রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক প্রতিযোগিতার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেকে টেনে আনা নওয়াজ শরিফের সরকারের জন্য একটি ঝুঁকি গ্রহণই বলা চলে। তবে এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তান অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যে তার দ্বিপাক্ষিক কূটনীতি পরীক্ষা করে নিচ্ছে। রুহানির সঙ্গে বৈঠকের পর নওয়াজ শরীফ মিডিয়াকে বলেন, ‘পাকিস্তান সৌদি আরবের উদ্বেগের কথা তেহরানকে এবং তেহরানের উদ্বেগের কথা রিয়াদকে জানাবে।’
পর্দার আড়ালে রিয়াদ বা তেহরানে কী আলাপ হয়েছে সেটা অবশ্য জানা যায়নি। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে রিয়াদ ও তেহরান প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানের সাথে কাজ করতে আগ্রহী। ইরান ও সৌদি আরব উভয়ই মধ্যস্থতার বিষয়ে পাকিস্তানের নিজের কোনো ‘ব্যক্তির’ সঙ্গে দেখা করতে বিশেষ দূত নিয়োগ করবে।
নওয়াজ শরীফ তার ‘মধ্যস্থতাকারী কূটনীতির’ ভিত্তি হিসেবে বেছে নিয়েছেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ঘোষণাকে। তিনি বলেন, ‘আমরা একই রকম শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। সেটা হলো সন্ত্রাসবাদ। একসাথে যুদ্ধ করলে আমরা এই হুমকিকে পরাজিত করতে পারবো। এর বিরুদ্ধে আলাদাভাবে লড়াই করা সম্ভব না।’
কিন্তু বিভিন্ন কারণেই এই বিবৃতি বেমানান। নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিশ্বের সব গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সৌদি আরব ও ইরান একে অপরকে দোষারোপ করছে। আবার পাকিস্তান নিজেই যেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসে আক্রান্ত এবং প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। পাকিস্তান ‘মুসলিম ঐক্য’র কথা বলে এবং এ সম্পর্কে আলোচনা করে। কিন্তু এটা সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত সেতু মেরামতে একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করবে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
সম্ভবত এবং সর্বোপরি, সৌদি-ইরান বিভক্তির সম্পর্কে ইসলামাবাদের বড় উদ্বেগ এটা যে, এর ফলে নিজস্ব সাম্প্রদায়িক সমস্যার সঙ্গে তাদের সংগ্রাম করতে হবে। পাকিস্তানের শিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতায় ওয়াহাবি মতবাদ হিসেবে পরিচিত সুন্নি ইসলামপন্থীরা সৌদি আরবের আচারনিষ্ঠ হয়ে এবং তাদের অনুপ্রেরণা নিয়ে দেওবন্দী চরমপন্থী গ্রুপের মতো আরো গ্রুপের উত্থান করতে পারে।
এরই মধ্যে পাকিস্তানের স্থানীয় এবং জাতীয় থেকে শুরু করে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিও পাকিস্তানি শিয়াদের বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্যে ইরানের অযৌক্তিক প্রভাবের কথা বলতে শুরু করেছেন। এর মধ্য দিয়ে ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লব পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে অাধিপত্য প্রতিযোগিতার সৌদি-ইরান খেলা থেকে পাকিস্তান নিজ বাড়িতে কোনো অতিরিক্ত সাম্প্রদায়িক উদ্দীপনা এড়াতে আগ্রহী হয়েছে।
পাকিস্তানের উদ্বেগের বিপরীতে ভরসাজনক একটি লক্ষণ নওয়াজ এবং রাহেল শরীফের সফরের মধ্য দিয়ে দেখা দিয়েছে। নওয়াজের সফরে জেনারেল রাহেলের অংশগ্রহণ এটা প্রমাণ করলো যে, সে দেশের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে এবং এই ইস্যুতে সেনাবাহিনী এবং বেসামরিক সরকার এক অবস্থানে রয়েছে। সেটা বুঝতে রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে যেন কোনো পার্থক্য না থাকে।
সেই সঙ্গে এটা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, সম্পর্কের সেতু বিনির্মাণে সাহায্যের ক্ষেত্রে দৃষ্টি যেন শুধু প্রধানমন্ত্রী নওয়াজের মধ্যেই আটকে না থাকে। এছাড়া কিছুটা নিরপেক্ষতা প্রমাণেরও ব্যাপার আছে। কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঐতিহাসিক এবং আর্থিকভাবে সরাসরি সৌদি আরবের উপকারভোগী। তবু আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দেশের সরকার এবং সেনাবাহিনী যে একই বিন্দুতে সেটা বোঝাতে জেনারেল শরীফের তেহরান সফর।
২০১৪ সালে সৌদি আরব থেকে ‘শর্তহীনভাবে’ দেড় বিলিয়ন ডলার পেয়েছে পাকিস্তান। যা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অসুবিধার সময় দেশের সেবায় সাহায্য করেছে। এছাড়া ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হয়ে সৌদি আরবেই নির্বাসিত ছিলেন নওয়াজ শরীফ। সৌদি-পাক সামরিক সহযোগিতা খুবই উন্নত। এমনকি প্রথমে পাকিস্তান বিস্ময় জানালেও রিয়াদ তাকে ‘ইসলামি সামরিক জোটে’ অন্তর্ভুক্ত করে।
তারপরও যদি কোনো ধরনের ধাক্কা সেভাবে আসে, তাহলে পাকিস্তান এবং তার সেনাবাহিনী ইরানকে বাদ দিয়ে যে সৌদি আরবের পাশে দাঁড়াবে সে ব্যাপারে খুব কমই সন্দেহ রয়েছে। তবে তার মানে এই নয় যে, গত সপ্তাহে পাকিস্তানের দুই শক্তিধর ব্যক্তির সফরটা শুধুই সিনেমা। নওয়াজ শরীফ নিজেও এই সফরকে সিনেমা ইস্যু বানাতে আগ্রহী নন। কারণ ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক খুবই জটিল। এর মধ্যে তৃতীয় কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে নিশ্চয়ই বিবাদে জড়াতে চাইবে না তারা।