সৌদি আরবের সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ডে দৃঢ় ভূমিকা রাখা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা অভিজ্ঞ যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নাইফকে সরিয়ে ৩১ বছর বয়সী উপ-যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে সৌদি আরবের যুবরাজ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এই দু’জনের আরও একটি পরিচয় আছে: পুরনো যুবরাজ বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের ভাতিজা। আর নবনিযুক্ত যুবরাজ বাদশাহর নিজের ছেলে।
যুবরাজই দেশটির রাজতন্ত্রের সর্বোচ্চ শাসক ‘বাদশাহ’র উত্তরসূরী হওয়ায় অভিজ্ঞতার আগে বাদশাহর সঙ্গে সম্পর্ককে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
ছেলেকে যুবরাজ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকার নির্বাচনের পথটি পরিষ্কার করে দিলেন বাদশাহ সালমান। ডজনের বেশি উত্তরাধিকারীকে পেছনে ফেলে তাকে ‘ক্রাউন প্রিন্স’ এর মর্যাদা দেয়া হয়।
সৌদি প্রেস এজেন্সি (এসপিএ) জানায়, সৌদি সাম্রাজ্যের উত্তরসূরী নির্বাচক কমিটির ৪৩ সদস্যের মধ্যে ৩১ জনের ভোটে মোহাম্মদ বিন সালমান যুবরাজ হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপর বাদশাহ সালমানের জারি করা এক রাজকীয় ফরমানের মাধ্যমে এ পরিবর্তন আনা হয়।
বাদশাহর ফরমান জারির সঙ্গে সঙ্গে একদিকে যেমন মোহাম্মদ বিন নাইফকে সিংহাসন লাভের আগের ধাপে এসে লাইন থেকে বের করে দেয়া হলো, অন্যদিকে আরব সাম্রাজ্যের শক্তিমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদটাও হারাতে হলো তাকে।
বিন নাইফ বহু বছর ধরে সৌদি রাজতন্ত্রের সন্ত্রাসবিরোধী কর্মসূচির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার অনেকগুলো বোমা হামলা ঠেকিয়েছেন তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পাশাপাশি মূলত নিজেকে পরবর্তী বাদশাহ ভেবেই দেশের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন।
কিন্তু বাদশাহর ভাতিজা হওয়ার কারণে বাদশাহর তরুণ পুত্রের কাছে পদ হারাতে হলো তাকে। বিন নাইফ নতুন যুবরাজের আনুগত্যও স্বীকার করে নিয়েছেন বলে জানিয়েছে এসপিএ। অবশ্য আনুগত্য স্বীকার না করার কোনো সুযোগ নেই সৌদি শাসনব্যবস্থায়।
রাজপুত্র থাকা অবস্থা থেকে শুরু করে উপ-যুবরাজ হওয়া পর্যন্ত শুধু সৌদি নয়, পুরো বিশ্বেই যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে মোহাম্মদ বিন সালমানকে নিয়ে। গত বছর ইকোনমিক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিন সালমানের আপাত সীমাহীন উচ্চাকাঙ্খা এবং দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলা দেখে বহু দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার সন্দেহ, তার চূড়ান্ত লক্ষ্য শুধু সৌদি সাম্রাজ্যকে পাল্টে দেয়া নয়, বরং নিজে বাদশাহ হওয়ার জন্য ৫৭ বছর বয়সী তার চাচাতো ভাই মোহাম্মদ বিন নাইফকে যুবরাজ পদ থেকেও সরিয়ে দেয়া।
বিন নাইফের সঙ্গে রাজপরিবারের বাকি বেশিরভাগ সদস্যেরই সম্পর্ক খুব ভালো। তাই বিন সালমানের এহেন পদক্ষেপ শুধু সেই আত্মীয়দেরকেই অসন্তুষ্ট করবে না, চেষ্টা সফল হলে সৌদি প্রথমবারের মতো এমন একজন তরুণ বাদশাহ পাবে যিনি বছরের পর বছর ধরে সৌদি শাসন করবেন।
অবশ্য সৌদি রাজতন্ত্রের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কোনো বাদশাহ নিজ ছেলেকে যুবরাজ বানালেন। এতদিন ধরে ভিন্ন প্রথা প্রচলিত থাকলেও তা ভেঙ্গে ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে নতুন উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন বাদশাহ। যুবরাজ নির্বাচনে উত্তরসূরী নির্বাচক কমিটির ভোটের কথা বলা হলেও সেটাও মূলত শাসক-নির্ভর। কেননা এই কাউন্সিলের প্রত্যেক সদস্যকে বাদশাহর প্রতি সর্বাত্মক আনুগত্য প্রকাশ করতে হয়।
রাজপুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানকে যুবরাজ পদের জন্য অযোগ্য না বললেও বিশ্লেষকদের দাবি, বহু বছরের অভিজ্ঞ এবং ২০১৫ সাল থেকে যুবরাজ হিসেবে দায়িত্বরত বিন নাইফকে এভাবে হুট করে সরিয়ে দেয়াটা একজন মাত্র ব্যক্তির ইচ্ছার বাস্তবায়ন।
এর আগেও ২০১৫ সালে বাদশাহ হওয়ার পর সালমান তার সৎভাই মুকরিন বিন আবদুল আজিজকে মাত্র তিনমাস সৌদি আরবের যুবরাজ পদে থাকার পর সরিয়ে আপন ভাতিজা মোহাম্মদ বিন নাইফকে নতুন যুবরাজের মর্যাদা দিয়েছিলেন। এখন আবার তাকে সরিয়ে সিংহাসনের লাইনে প্রথমে চলে এলেন বাদশাহর আরও কাছের ব্যক্তি।
যুবরাজ নির্বাচন ছাড়াও একই সঙ্গে ফরমান জারি করে রাজতন্ত্রের রয়্যাল কোর্টের উপদেষ্টা এবং ইটালি ও জার্মানিতে সৌদির রাষ্ট্রদূত পদেও বিশাল পরিবর্তন এনেছেন বাদশাহ সালমান। পুরো সরকারের এই সবগুলো রদবদল হয়েছে একজন ব্যক্তি – বাদশাহর সিদ্ধান্তে। আর এর অন্যতম প্রমাণ হলো, যুবরাজ পদে এত বড় পরিবর্তন আনা হলেও তার পেছনের কারণটা স্পষ্ট করা হয়নি।