২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সাহিত্যের জন্য ঐতিহাসিক একটি দিন। ১৯৩৫ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান দুই লেখক সৈয়দ শামসুল হক ও রাবেয়া খাতুন। দুই বরেণ্য লেখকের জন্মদিনে অর্ঘ্য।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১— আমরা দুটো সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছি। একটা সংগ্রাম প্রত্যক্ষ— ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধিকার আন্দোলনের লড়াই সেটা। দ্বিতীয় সংগ্রামটা ছিল আত্মপরিচয় নির্মাণের। একটি ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে, স্বাভাবিকভাবেই সেই দেশের শিল্পসাহিত্যের মধ্য দিয়ে জাতিসত্তার স্বরূপ উন্মোচিত হবে। কিন্তু পঞ্চাশের দশক থেকেই আমাদের লেখকদের সামনে বড় প্রশ্ন ছিল— আমাদের সাহিত্যের ভাষা কেমন হবে? বিষয়বস্তু কী হবে? কীভাবে বলা হবে গল্পটা? কেননা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়রা বাংলা সাহিত্যের যে ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন, ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হওয়ার পর সেই ঐতিহ্যের অন্ধ অনুকরণ আমাদের লেখকরা করতে পারেননি। সচেতনভাবেই আমাদের সাহিত্যের নতুন ধারা নির্মাণের জন্য তাদের কাজ করতে হয়েছে। কারণ রবীন্দ্রকালীন বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের ভাষা-সংস্কৃতি এবং মুসলিম চরিত্র বলিষ্ঠভাবে উঠে আসেনি। ফলে সংখ্যাগুরু মুসলমানদের জীবনভিত্তিক সাহিত্যরচনার ভাষাটা তৈরি ছিল না। পাশাপাশি ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আমাদের যে সংগ্রাম, তা পরিষ্কারভাবেই কলকাতার সাহিত্য-কন্টেন্ট থেকে আমাদের সাহিত্যকে আলাদা করে তুলেছে। স্বাধীন দেশ মানে শুধু ভূখণ্ডের স্বাধীনতা নয়, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাও বটে। আমাদের লেখকরা এই সত্য অনুধাবন করেছিলেন।
বাংলাদেশের স্বকীয় সাহিত্যভাষা ও সাহিত্যরীতি নির্মাণে যে দুজন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা হলেন সৈয়দ শামসুল হক ও রাবেয়া খাতুন। বাংলার হাজার বছরের লোকায়ত ধর্ম, লোকজ সংস্কৃতি, বাউল সংস্কৃতি ও সুফীবাদ- এসবের মধ্যে সমন্বয় করে তারা হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা লেখক। দুজনেই জন্মেছিলেন একইদিনে, ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর— একজন কুড়িগ্রামে, অন্যজন ঢাকায়। বাংলাদেশের সাহিত্যের জন্য ডিসেম্বরের এই দিনটি তাই ঐতিহাসিক। শুধু বাংলা সাহিত্য না, বিশ্বসাহিত্যে একই ভাষার দুজন অন্যতম প্রধান লেখকের একই বছর একইদিনে জন্মগ্রহণের ঘটনা বিরলই।
দুজনই পঞ্চাশের দশকে কিশোর বয়স থেকে লিখতে শুরু করেন এবং দ্রুতই হয়ে ওঠেন বহুমাত্রিক ও বহুপ্রজ লেখক। সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন সব্যসাচী লেখক— একাধারে উপন্যাস, গল্প, নাটক, কবিতা, গান, সিনেমার চিত্রনাট্য, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, অনুবাদসাহিত্য, শিশুসাহিত্য প্রভৃতি রচনা করেছেন। অন্যদিকে রাবেয়া খাতুন কবিতা না লিখলেও উপন্যাস, গল্প, শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী, স্মৃতিকথা, সম্পাদনাসহ সাহিত্যের বিচিত্র ক্ষেত্রে পরিভ্রমণ করেছেন। দুজনেরই লেখকজীবন দীর্ঘ, রচনা সম্ভার বিপুল ও বিষয়-বৈভবে অনন্য।
সৈয়দ শামসুল হক ও রাবেয়া খাতুন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই বাঙালি জাতিসত্তার স্বরূপ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তারা তাদের সাহিত্যের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন পরিবর্তিত গ্রাম, অন্যদিকে বিবর্তিত নগরকে চিত্রিত করেছেন। রংপুরে জলেশ্বরী নামে একটি কাল্পনিক ভূগোল নির্মাণ করেছেন সৈয়দ হক। তার ভাষা ও পর্যবেক্ষণ শক্তির কারণে বাংলাদেশের সাহিত্য অখণ্ড বাংলার সাহিত্য থেকে আলাদা হয়ে বিন্দুমাত্র টলে যায়নি, বরঞ্চ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্যের স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কথাসাহিত্যের পাশাপাশি কবিতা ও কাব্যনাট্যে তিনি বিরল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন বাংলা সাহিত্যে।
রাবেয়া খাতুন সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ও সবল ছিলেন উপন্যাসে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক রূপান্তরের চিত্রটা তার সমগ্র উপন্যাসে উঠে এসেছে। স্বকাল ও জীবনাভিজ্ঞতা তার সৃষ্টির সারাৎসার। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে তিনি। এ কারণে বিদ্যালয়ের গণ্ডির পেরিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি। নারী হয়ে লেখালেখিতে আসার কারণে যাদের নিন্দা করার কথা তাদের কাছে নিন্দিতও হয়েছেন তিনি। লেখকজীবনে এসবের কোনোটাই তার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তিনি হয়ে উঠেছেন নাগরিক এবং তার সময়ের নারীর কণ্ঠস্বর। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের শুরুর দিকে যখন ঢাকাকেন্দ্রিক ও নারীচরিত্র-প্রধান কথাসাহিত্য গড়ে ওঠেনি, তখন সেটি প্রতিষ্ঠায় রাবেয়া খাতুন ছিলেন অন্যতম পুরোধা লেখক।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সাহিত্যের ‘ইউনিক’ বিষয়বস্তু। মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হক ও রাবেয়া খাতুনের অবদান অনস্বীকার্য। সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তিনটি বিখ্যাত উপন্যাস: ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী (১৯৮৪)’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’ (১৯৯০) ও ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’। এরমধ্যে ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে গেরিলা নামে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সৈয়দ হকের মুক্তিযুদ্ধের দশটি উপন্যাস গ্রন্থে আরও মুদ্রিত হয়েছে ‘জনক ও কালোকফি’, ‘নীল দংশন’, ‘বালিকার চন্দ্রযান’, ‘দূরত্ব’, ‘ত্রাহি’, ‘চোখবাজি’, ‘ইহা মানুষ,’ ‘বাস্তবতার দাঁত ও করাত’ ও ‘একমুঠো জন্মভূমি’।
অন্যদিকে, রাবেয়া খাতুনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ‘ফেরারী সূর্য’, ‘নীল নিশীথ’, ‘বাগানের নাম মালনিছড়া’, ‘হিরণদাহ’, ‘মেঘের পরে মেঘ’, ’৭১ এর নয় মাস’, ’৭১ এর নিশান’ প্রভৃতি। সৈয়দ হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাসের মতোই রাবেয়া খাতুনের ‘ফেরারী সূর্য’ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ও অবদানের চিত্র উঠে এসেছে দৃঢ়ভাবে। ‘মেঘের পরে মেঘ’ উপন্যাস অবলম্বনে একই নামে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। সৈয়দ হক এবং রাবেয়া খাতুন, দুজনেই অসংখ্য গল্প লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে।
দুজনই পড়াশুনা শেষ করেননি। সৈয়দ শামসুল হক জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পড়া শুরু করেন। তবে অনার্স শেষ করার আগেই বাবার মৃত্যু হলে পড়ালেখা ছেড়ে সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। রাবেয়া খাতুন রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে হওয়ায় লেখাপড়ায় আগ্রহ থাকলেও স্কুলের গণ্ডি পার হতে পারেননি। আরও একটি মিল হল, কর্মজীবনের একটি পর্যায়ে দুজনেই সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তী জীবনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তারা ভ্রমণ করেছেন। এ কারণে কথাসাহিত্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের ভ্রমণসাহিত্য ও স্মৃতিকথায় দুজনের অবদান অবশ্য-স্মরণীয়। পাশাপাশি শিশুসাহিত্যেও তাদের অবদানের কথা স্মরণ করতে হবে।
সৈয়দ শামসুল হক ও রাবেয়া খাতুন বাংলাদেশের প্রথম দিককার সেলিব্রেটেড লেখক। আমৃত্যু তারা পাঠকপ্রিয় ছিলেন। বর্তমানে তুলনামূলক বিচারে সৈয়দ শামসুল অধিক জনপ্রিয় হলেও রাবেয়া খাতুনও বহুল পঠিত। তরুণ লেখকদের জন্য বাংলাদেশের সাহিত্যের ঐতিহ্য সৃষ্টির পাশাপাশি নতুন পাঠকদের পাঠরুচি সৃষ্টিতে তাদের অবদান আমাদের স্বীকার করতে হবে।
দুজনই তাদের সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রায় সবগুলো উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। সৈয়দ শামসুল হক বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন ১৯৬৬ সালে। রাবেয়া খাতুন এই পুরস্কারটি পান ১৯৭৩ সালে। এরপর আগেপরে দুজনেই একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হন। তাদের গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে যেমন সিনেমা নাটক নির্মিত হয়েছে, তেমনি ইংরেজিসহ নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
আজ জন্মদিনে এই দুই লেখকের প্রতি অতল শ্রদ্ধা। তারা আরও বেশি বেশি পঠিত হবেন, উন্মোচিত হবেন, বাংলাদেশের বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে এই কামনা।