চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সৈয়দ শামসুল হক: ভবিষ্যতের দিকে

ডাক্তারদের বেঁধে দেওয়া ছয় মাস সময়ের ভবিষ্যত বাণী মিথ্যা করে দিয়ে ২৭
এপ্রিল শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক। তাকে নিয়ে এবার
ফেসবুুকে পোষ্ট দিলেন আরেক কবি আহমাদ মাযহার।

ফেসবুকে পোষ্টে তিনি লিখেছেন, ‘সৈয়দ শামসুল হকের কোন লেখাটি প্রথম পড়েছিলাম মনে নেই। তবে তার উপন্যাস দূরত্ব, নিষিদ্ধ লোবান, নীলদংশন, তুমি সেই তরবারি, অন্য এক আলিঙ্গন, প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান, কাব্য উপন্যাস অন্তর্গত বেরিয়েছিল সত্তরের দশকের একেবারে শেষের দিকে বা আশির দশকের একেবারে প্রথম দিকে অল্প সময়ের ব্যবধানে বিচিত্রা, সচিত্র সন্ধানী, রোববার, পূর্বাণী বা চিত্রালীর ঈদসংখ্যায়। আমি তখন সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ বয়সে পৌঁছে সাহিত্যপ্রেমে মজতে শুরু করেছি। পশ্চিমবঙ্গের নীহাররঞ্জন গুপ্ত, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বা নিমাই ভট্টাচার্য্যদের রচনায় তুষ্ট থাকতে পারছি না। আমাদের দেশের লেখকদের খুঁজছি। ঐ সময়েই দু-তিন বছরের ব্যবধানে ঈদসংখ্যার পাতায় এই উপন্যাসগুলো পড়ে আমি হয়ে গেছি সৈয়দ শামসুল হকের অনুরাগী পাঠক।

মনে পড়ছে তুমি সেই তরবারি বা অন্য এক আলিঙ্গন উপন্যাসে ইংরেজিভাষী চরিত্রের সংলাপের ক্ষেত্রে সাধুরীতির বাংলা গদ্য ব্যবহারের নিরীক্ষাটি আমাকে চমকিত করছিলে। দেখে ফেলেছি থিয়েটারের প্রযোজনায় তার লেখা পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকেও। কিছু সময়ের ব্যবধানে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রযোজনায় তার নূরলদীনের সারাজীবন মঞ্চস্থ হলো। অগ্রজপ্রতিম বন্ধু আলম খোরশেদের উপদেশনায় আমি তখন গো-গ্রাসে সাহিত্যের নানা বই গিলছি। শুনলাম তিনি নূরলদীনের সারাজীবনে অভিনয়ও করছেন। আমি গেলাম মহিলা সমিতিতে। আলী যাকের-আসাদুজ্জামান নূরদের তখন স্বর্ণযুগ! অনুভব করলাম কাব্যনাটকের অভিনয় দেখতেও কত আনন্দ! বুঝলাম অবরুদ্ধ সামরিক স্বৈরাচার কবলিত বাংলাদেশে ইতিহাসবোধ ও স্বদেশবোধের আঁধার এই নাটক।

এরপরে তিনি লিখেছেন, আমি উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম লক্ষ্মীবাজারের শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে। কলেজের ঠিক পাশেই সৈয়দ শামসুল হকের পৈত্রিক বাড়ি। লেখক সৈয়দ শামসুল হককে চর্মচক্ষে দেখতে পাওয়া তখনই অামার কাছে এক আনন্দের ব্যাপার। একদিন তার খোঁজ করে এলাম সহপাঠী বন্ধু মোস্তফা জামান সহযোগে। তিনি তখন আর ওখানে থাকেন না। পেলাম তার অনুজ সৈয়দ আমজাদ হোসাইন রাজাকে। সৈয়দ হকের ভাই বলে রাজাভাইকেই বড় আপন মনে হলো। যেন লেখকদর্শন খানিকটা হয়েই গেল।

সোহরাওয়ার্দী কলেজে পড়বার সময়েই সৈয়দ হকের ভাইপো সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো আমার লেখালেখির সূত্রে। খোঁজ নিয়ে জানলাম আমার উত্তর যাত্রাবাড়িস্থ নিবাসের অদূরেই তার বাড়ি। কখনো কখনো সৈয়দ হকের জীবন-কথা শুনতে পাই ওর কাছ থেকে। সৈয়দ হকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা না হলেও সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে এক ধরনের নৈকট্য অনুভব করি। সোহরাওয়ার্দী কলেজের পাট চুকিয়ে যখন ঢাকা কলেজে বাংলায় স্নাতক সম্মান পড়তে গেছি তখন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ছাত্র হবার সুবাদে ঠিকানা পেলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের। সেখানে এর ওর মুখে শুনতে পেলাম তার ‘রক্তগোলাপ’ গল্পটার কথা। ততদিনে গল্পটি দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। খোঁজাখুজি করে ওটাও পড়ে নিয়েছি। পড়ে নিয়েছি কবিতার বই বৈশাখে রচিত পঙতিমালা। সৈয়দ হকের অনুজ সৈয়দ আমজাদ হুসাইন রাজা ততদিনে হয়ে গেছেন রাজাভাই। তিনি আবির্ভূত হয়েছেন সৈয়দ হকের বইয়ের প্রকাশক হিসেবে সব্যসাচী প্রকাশনী নিয়ে। ১৯৮২ সালের বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণের বইমেলায় সেই সব্যসাচী প্রকাশনী থেকে বেরিয়ে গেল তার কবিতার বই পরানের গহীন ভিতরে। বইমেলার স্টলে দাঁড়িয়েই পড়ে ফেললাম অনেকটা। আঞ্চলিক বাকভঙ্গিতে লেখা প্রেমের কবিতার বই আলোড়ন তুলল আমার মনে। বইমেলায় একদিন পেয়েও গেলাম তাকে। বইটি কিনে তার কাছে অটোগ্রাফ প্রার্থনা করলাম। হাসিমুখে আমার নাম লিখে অটোগ্রাফ দিলেন তিনি। এরপরে বহুবার তাকে এখানে সেখানে দেখেছি দূর থেকে। যেখানে তার যে লেখা পাই পড়ে ফেলি। কিন্তু তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ ঘটে না।

সৈয়দ শামসুল হক বিচিত্র মাধ্যমের লেখক। তার উপন্যাস, নাটক ও কবিতার প্রসঙ্গ বেশি সামনে এলেও ছোটগল্পের প্রসঙ্গ কম ওঠে। কিন্তু সেখানেও রয়েছে তার বৈচিত্র্যের সম্ভার। তার জলেশ্বরীর গল্পগুলো যেমন ভিন্ন জগতের সামনে এনে দেয় আমাদের তেমনি সমকালীন জীবনপ্রবাহকে উন্মোচন করে দেয় আবদুল খালেক সিরিজের গল্পগুলো। গল্পরচনার মিস্তিরিগিরি নিয়ে কত কথা শুনেছি তার কাছ থেকে! তার মতো একজন লেখকই জানেন কী করে তার ভাবনাকে শিল্প করে তোলার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়! তার সাহচর্য এইভাবে ঋদ্ধ করে আমাদের।

পরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ততার সূত্রে বিভিন্ন সময় সেখানে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। স্ত্রী শিরীন বকুলের সূত্রে নাটকের দল থিয়েটারের সঙ্গে আমার যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল। একবার থিয়েটারের পিকনিকে গেছিলেন তিনি। সম্ভবত সেটা ১৯৮৭ বা ৮৮ সালের ঘটনা। থিয়েটার সেবার লঞ্চে করে গিয়েছিল পদ্মার চরে। রামেন্দু মজুমদারের মতো প্রবীণসহ থিয়েটারের এক দল তখন চরে নেমে ফুটবল খেলায় ব্যস্ত। আরেকদল বসে গেছে তাস খেলায়। অল্পকাল আগেই সৈয়দ হকের বাইপাস সার্জারি হয়ে গেছে। সুতরাং তার পক্ষে শারীরিক চাপ নেয়া সম্ভব হবে না। সৈয়দ হক তখন এগিয়ে গেলেন চরের পাশে ফসলের ক্ষেতে কর্মরত মানুষের দিকে। আমিও সঙ্গী হলাম তার। বোধ হয় ঘণ্টাখানেক ছিলাম ওখানে আমরা। তিনি কর্মরত কৃষকদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে কথা বললেন। বাড়িঘরের খোঁজ নিলেন। পরিবারের সদস্য কয়জন, উপার্জনক্ষম মানুষ কয়জন জানতে চাইলেন। সংসারের অবস্থা কী রকম। ফসলের অবস্থা কেমন। রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও খবর নিলেন দু-একটা। এমন সব প্রশ্ন তাদের করলেন যাতে পৌঁছে গেলেন তাদের সমসাময়িক ভাবনার একেবারে তলায়। কৃষকদের সঙ্গে কথপোকথনে চমকিত হলাম আমি। আশ্চর্য, কৃষকেরা তাদের উপলব্ধির কথা অকপটে বলল তার কাছে! সংসারে মূল সংকট কী। কী করতে পারলে তার থেকে উত্তরণ ঘটানো যাবে এইসব নানা ভাবনা তাদের কাছ থেকে তিনি জেনে নিলেন। তিনি আমাকে বললেন, আমি সাধারণ মানুষের সঙ্গেই মিশি সবসময়। তাদের থেকে বুঝে নিতে চেষ্টা করি তাদের মনকে। মানুষের জীবনযাপনের খবর না জানলে কবিতা বা কথাসাহিত্য রচনা কিভাবে করা যাবে! যে সময়ের কথা বলছি তার কিছুকাল আগে তার সাহিত্যিক কলাম ‘মার্জিনে মন্তব্য’ বেরিয়ে গেছে শাহাদাত চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। ‘মার্জিনে মন্তব্য’র লেখাগুলো থেকে দারুণ উপকৃত হয়েছিলাম। এ নিয়ে আগেও লিখেছি বলে আর বাকবিস্তার করতে চাইছি না। আরেকবার উপকৃত হলাম মানুষের সঙ্গে তাকে কথা বলতে দেখে।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সূত্রে জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠিত হলে সৈয়দ শামসুল হক সেখানে সক্রিয় হলেন। সেখানেও তাকে দেখলাম কাছ থেকে। তাকে যুক্ত হতে দেখলাম সাংগঠনিক নানা দিকে। অনেক সভায় শুনলাম তার বক্তৃতা। রাষ্ট্রের নানা পরিস্থিতিতে তাকে দেখলাম সিভিল সোসাইটির ব্যক্তিভূমিকায়! তার ব্যক্তিত্ব, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেক শেখার আছে আমাদের।

সব্যসাচী প্রকাশনীর কথা বলছিলাম। আশির দশকে এই প্রকাশনা-সংস্থাটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এর ভিন্নধর্মী প্রকাশনাবৈশিষ্ট্য নিয়ে। পরে জেনেছি ওই প্রকাশনার প্রধান লেখকই কেবল তিনি ছিলেন না প্রধান পরিকল্পকও ছিলেন তিনি। প্রচ্ছদ অঙ্গসজ্জাসহ বিশেষ করে কবিতার বই প্রকাশনায় ভিন্ন মাত্রা দিয়েছিলেন তিনি। এমনকি কয়েকটি উপন্যাসের প্রকাশনাও অগতানুগতিক হয়ে উঠেছিল তার সৃষ্টিশীল পরিচর্যায়। সব্যসাচী প্রকাশনের নির্দেশযও তিনি সাহচর্য দেন আমাদের। তার শিল্প-প্রকল্পনা যোগ করেন আমাদের অভিজ্ঞতায়।’

সবশেষে তিনি লিখেছেন, ‘চ্যানেল আইয়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। নানা অনুষ্ঠানের সূত্রে তিনি চ্যানেল আইয়ে আসেন। আসলেই জমে ওঠে সাগরভাই, আমীরুল, শহিদুল আলম সাচ্চু কিংবা আমার–আমাদের আড্ডা। বছরখানেক ধরে একটি অভিনব বইয়ের অনুষ্ঠান করছিলেন তিনি ‘আমি বইয়ের কথা বলছি’ নামে। বাংলাদেশে বই নিয়ে এমন অভিনব টিভি-অনুষ্ঠান আর হয়নি। এখানেও আমরা সাহচর্য পাই পড়ুয়া সৈয়দ শামসুল হকের। খোঁজ পাই অতি তরুণতম প্রজন্মের লেখকেরাও বাদ যান না তার পাঠসীমানা থেকে। ২০০৯ সাল থেকে আমি বই-সমালোচনার একটি লিটল-ম্যাগাজিন সম্পাদনা করে আসছি। প্রথম সংখ্যা প্রকাশের পর পরই এক সাক্ষাৎকারে তিনি আমাকে স্বাগত জানান। উল্লেখ করেন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে। এভাবেই আমরা সাহচর্য লাভ করি তার ইতিবাচকতার।

কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন এবং তার জন্মদিন একই হওয়ায় বহু বছর ধরে আমরা তার জন্মদিন উদযাপন করি একত্রে। জন্মদিন উদযাপনের এই আনন্দের মধ্য থেকে তার লেখক সত্তার বিচিত্র বিবেচনা সম্পর্কে আমরা অবহিত হই। বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাহিত্যিক নানা প্রসঙ্গে তার দীর্ঘ জীবনাভিজ্ঞতার সাহচর্য আমাদের সমৃদ্ধ করে তোলে। বয়সে তার অগ্রজ, সমসাময়িক ও অনুজ অনেকের সম্পর্কে বহু না-জানা কথা আমরা শুনতে পাই তার কাছে। সে-সব কথা তো কেবল নয় অতীতচারণা, সে-সবের মধ্য থেকে আমরা পেয়ে যাই সৃষ্টিশীলতার আনন্দ-গান বা সংগ্রামী যাত্রাপথের ইতিহাসকে। তার জীবনের সুদূর অতীত থেকে আসা সুবাস পৌঁছে যায় আমাদের কাছে। আমরা তরুণতররা তার অতীতের ভিত্তিভূমে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি রাখি ভবিষ্যতের দিকে।’