সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১৬ সালের এই দিনে ৮২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন দেশবরেণ্য এ লেখক।
সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে। হোমিও চিকিৎসক সৈয়দ সিদ্দিক হোসেন ও মা নুরজাহানের ৫ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। ধরলা নদীর পাড়ে শৈশব কাটানো এ লেখক শহরের রিভারভিউ স্কুলে পড়ালেখা করেছিলেন নবম শ্রেণি পর্যন্ত।
তার বাবা চাইতেন ছেলে চিকিৎসাবিদ্যায় পড়বে। কিন্তু তিনি এ চাপ এড়াতে ১৯৫১ সালে ভারতের মুম্বাই পালিয়ে যান। সেখানে তিনি বছরখানেক একটি সিনেমা প্রডাকশন হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এর পর দেশে ফিরে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজের মানবিক শাখায়। পরে ১৯৫৪ সালে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। তবে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়েন তিনি। এর কিছুদিন পর প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’।
১৯৫৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সৈয়দ হক ৩০টির মতো চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেন। সৈয়দ হকের লেখা ‘মাটির পাহাড়’, ‘তোমার আমার’, ‘রাজা এল শহরে’, ‘শীত বিকেল’, ‘সুতরাং’, ‘কাগজের নৌকা’ ইত্যাদি চলচ্চিত্র দর্শকপ্রিয় হয়।
সৈয়দ হক চলচ্চিত্রের জন্য গানও রচনা করেন। ‘এমন মজা হয় না, গায়ে সোনার গয়না’, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’, ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাহিয়া’ ইত্যাদি গান সমৃদ্ধ করেছে বাংলা চলচ্চিত্রকে।
তবে চলচ্চিত্র অঙ্গনে এ ব্যস্ততার মধ্যেও থেমে থাকেনি সৈয়দ হকের কবিতা কিংবা ছোটগল্প রচনা। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় তার কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত লেখা তার ছোটগল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘তাস’, ‘শীত বিকেল’, ‘রক্ত গোলাপ’ প্রভৃতি।
সৈয়দ হকের উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘এক মহিলার ছবি’, ‘অনুপম দিন’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘নীল দংশন’, ‘স্মৃতিমেধ’, ‘মৃগয়া’, ‘এক যুবকের ছায়াপথ’, ‘বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল’, ‘ত্রাহি’, ‘তুমি সেই তরবারি’, ‘কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন’, ‘নির্বাসিতা’, ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘মেঘ ও মেশিন’, ‘ইহা মানুষ’, ‘বালিকার চন্দ্রযান’, ‘আয়না বিবির পালা’ প্রভৃতি। তার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’, ‘বিরতিহীন উৎসব’, ‘প্রতিধ্বনীগণ’, ‘পরানের গহিন ভিতর’ উল্লেখযোগ্য।
বাংলা মঞ্চ নাটকেও নিজের লেখনীর প্রমাণ দিয়েছেন সৈয়দ হক। তার লেখা নাটকগুলোর মধ্যে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ এবং ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ সমকালীন অভিপ্রায়ের এক দৃপ্ত প্রকাশ। তার অন্যান্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘গণনায়ক’, ‘ঈর্ষা’, ‘নারীগণ’, ‘উত্তরবংশ’ ইত্যাদি।
অগণিত পাঠকের ভালোবাসার পাশাপাশি দেশের প্রায় সব পুরস্কারই তার করতলে শোভা পেয়েছে। পেয়েছেন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদক। প্রাপ্ত পুরস্কারগুলোর মধ্যে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো বাংলা একাডেমি পদক, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, পদাবলী কবিতা পুরস্কার, জাতীয় কবিতা পুরস্কার, আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার প্রভৃতি।
বাংলা সাহিত্যের এ সব্যসাচী লেখক ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এর আগে তিনি প্রায় ৪ মাস লন্ডনের রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিলে ওই বছরের ১৫ এপ্রিল তাকে লন্ডন নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে।