কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে এক দম্পতির কাছে টুরিস্ট পুলিশ কর্তৃক কাবিননামা চাওয়া নিয়ে গণমাধ্যম ও সোস্যাল মিডিয়ায় বেশ হৈ চৈ হয়ে গেল। বিবিসিও খবরটা কাভার করেছে দেখলাম। সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যকে ‘ক্লোজড’ করার মধ্য দিয়ে ঘটনার আপাতত ইতি ঘটেছে। অভিনন্দন মোহাম্মদ কায়েদে আজমকে তার প্রতিবাদ এবং বিষয়টা কর্তৃপক্ষের নজরে আনার জন্য।
কিন্তু বাকীদের খবর কী? সমাজে ক’জন মানুষ আছেন যারা অন্যায়ের বিশেষ করে পুলিশ বা সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের অন্যায় কাজ বা আচরণের প্রতিবাদ করেন বা করতে পারেন। কিছু পেশার মানুষ যেমন সাংবাদিক, আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়তো তাদের অভিজ্ঞতা, সচেতনতা বা দায়িত্ববোধ থেকে প্রতিবাদ করেন এবং কিছু হয়রানির পর মুক্তি পান। কিন্তু বাকীরা? একজন সাধারণ নাগরিক, শ্রমিক, রিক্সাওয়ালা, ছাত্র বা ছোট ব্যবসায়ী? তারা কোথায় যাবেন? কার কাছে যাবেন? কিভাবে হয়রানির প্রতিবাদ করবেন?
ব্যক্তিগত দু’টি অভিজ্ঞতা দিয়ে বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করি। প্রায় ২০ বছর আগের ঘটনা। আমি একটা মিটিংয়ে যোগ দেয়ার জন্য ব্যাংকক যাচ্ছি। তখন ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটিমাত্র টার্মিনাল। প্লেন ছাড়তে প্রায় ঘন্টাখানেক বাকী। কিছু যাত্রী ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। শামুকের গতিতে এগুচ্ছে লাইন। একজন পোশাকওয়ালা মানুষ যাত্রীদের দেখছেন খুটিয়ে খুটিয়ে। যেন কিছু খুঁজছেন। তিনি আমার ঠিক সামনের ব্যক্তিটির কাছে এসে তার পাসপোর্ট চাইলেন। পাসপোর্টটি হাতে নিয়ে তিনি লেন্স দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দেখলেন। তারপর যাত্রীটির কাছে এসে বেশ ধমকের সুরে বললেন, কী করেন আপনি? একে তো প্লেন ছাড়তে বেশি দেরি নেই, তার উপর লেন্স দিয়ে পাসপোর্ট পরীক্ষা করে এই প্রশ্ন। বয়সে তরুণ সেই যাত্রীটি কিছুটা হকচকিয়ে গিয়ে মিন মিন করে বললো, আমি ব্যবসা করি।
এই অফিসার ততক্ষণে বুঝে গেছেন তার ধমকে কাজ হয়েছে। এবার তিনি গলাটা আরও একটু চড়িয়ে আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন। কীসের ব্যবসা করেন? তরুণ যাত্রীটি আরও করুণ স্বরে উত্তর দিলেন, তার একটা দোকান আছে। পরের কথাটা বেশ মজার এবং আতঙ্কের। তিনি এবার ওই যাত্রীর কাছে তার ট্রেড লাইসেন্স দেখতে চাইলেন। স্বাভাবিকভাবেই ওই যাত্রীর কাছে ট্রেড লাইসেন্স ছিল না। অবধারিতভাবে অফিসারটি উক্ত যাত্রীকে তার সাথে নিয়ে যেতে উদ্যত হলেন। বুঝলাম, যা করার এখনই করতে হবে।
যাত্রীকে নিয়ে অফিসারটি যখন হাঁটা শুরু করেছেন তখন আমি বললাম: এক্সকিউজ মি। ফিরে দাঁড়ালেন অফিসার। আমি তাকে বললাম, আপনি কে? বেচারা মনে হয় ইলেকট্রিক শক খেলেন। এ ধরনের প্রশ্নের জন্য তিনি আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। পোশাক পরা অবস্থায় এমন প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে কখনো হতে হয়নি এটা নিশ্চিত। কিছুটা ভ্যাবাচেকা খাওয়া অবস্থায় বললেন: কেন, আমি ইমিগ্রেশনের লোক! আমার পাল্টা প্রশ্ন, আমি কী করে বুঝবো আপনি ইমিগ্রেশনের লোক? মনে হলো এবার উনি মনে হয় আমাকে মাপা শুরু করেছেন। অনেক কষ্ট করে শিকার ধরার পর এই বুঝি হাতছাড়া হয়ে যায়! কিছুটা সামলে নিয়ে উত্তর দিলেন, কেন আমি তো এখানে ডিউটি করছি, আমার পোশাকও আছে।
এবার আমি অতি বিনয়ের সাথে ইমিগ্রেশন অফিসারটিকে বললাম: আমি কি আপনার সরকারি চাকরীর নিয়োগপত্রটা দেখতে পারি! এবার মনে হলো সত্যিই উনি আমার প্রশ্নে বিভ্রান্ত। বললেন, আমি কেন আপনাকে আমার নিয়োগপত্র দেখাবো? আমিও তাৎক্ষনিক বললাম: তাহলে উনি কেন আপনাকে ট্রেড লাইসেন্স দেখাবেন? প্লেন ছাড়তে আর আধাঘণ্টা বাকী আর আপনি চাচ্ছেন উনার ট্রেড লাইসেন্স! আপনি দেখেন উনার পাসপোর্ট, ভিসায় কোন সমস্যা আছে কি না। কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন: যান, আপনার জন্য উনাকে ছেড়ে দিলাম! তরুণ যাত্রীটি আমাকে ধন্যবাদ জানালেন। আশেপাশে কাউকে দেখিনি এগিয়ে আসতে।
এবার দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা। এটা বছর দশেক আগের ঘটনা। একটি প্রখ্যাত কোম্পানির এসি বাসে খুলনা থেকে ঢাকা আসছি। বাস যশোরে আসার পর যাত্রী উঠানোর জন্য কিছুক্ষণ থামে। সেসময় দেখলাম আমার ঠিক বাম সারিতে বসা এক যাত্রী চিপস আর একটা ছোট কোক কিনে বাসে উঠলেন। উনি কোক আর চিপস খেতে খেতে চলেছেন, বাসও চলছে। ওই অতি নিরীহ ভদ্রলোক জানতেন না এই কোকই উনার সর্বনাশ ডেকে আনতে যাচ্ছে। আমরা ফেরি পার হয়ে আরিচা পৌঁছেছি মাত্র। হঠাৎ বাস থামলো। পুলিশ চেক করবে। দেখলাম একজন পুলিশ আর একজন সিভিল ড্রেসের লোক বাসে উঠলেন। পুলিশ লোকটি গেটে দাঁড়িয়ে থাকলাঁ আর সিভিল ড্রেসের লোকটি যেন শকুনের মতো কী যেন খুঁজছে! চেহারা দেখে মনে হলো দুনিয়ার হেন মাদক নেই যা সে নেয় না। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ ঝাঝালো কণ্ঠে চিৎকার, নামেন আমার সাথে!
দেখলাম আমার পাশের লাইনের সেই লোকটিকে ধরেছে পুলিশের দালাল। লোকটি তখন ইতস্ততঃ করতে শুরু করেছে। পুলিশের লোকটি কথা বলছে ধমকের সুরে আর যাত্রীটি তখন অনেকটা মিইয়ে পড়েছে। মিন মিন করে বললো,
– ভাই আমি নামবো কেন? কী করেছি আমি!
– কী করেছেন জানেন না! নামেন আমার সাথে।
– ভাই আমি তো ঢাকায় যাচ্ছি। আমি নামবো কেন!
– কেন নামবেন? আপনি কোকের সাথে ‘জিনিস’ মিশিয়েছেন। নামেন! (আবারো কড়া ধমক)। এভাবে কিছুক্ষণ চললো। এক পর্যায়ে যাত্রীটি অসহায়ভাবে পুলিশের দালালের সাথে নেমে যেতে উদ্যত হলেন। আমি যেন কিছুই দেখছি না এমন ভাব করে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছি। যখন দালাল তার শিকারকে নিয়ে যাচ্ছে সেসময় আমি অতি বিনয়ের সাথে দালালকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই উনার কী সমস্যা? নিয়ে যাচ্ছেন কেন?
দালালটি এমনভাবে আমার দিকে তাকালো যেন আমাকে খেয়ে ফেলবে। ঠিক ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে হরিণ ধরার কাহিনী। অনেক চেষ্টা করে যখন চিতা বাঘ হরিণটা ধরেছে ঠিক সে সময় কোথা থেকে এক বাঘ এসে হাজির! চিতা যেমন সহজে তার শিকার ছাড়ে না দালালও তেমনি লোকটাকে ধরে থাকলো। আবারো জিজ্ঞাসা করলাম, উনার সমস্যা কী?
– উনি কোকের সাথে জিনিস মিশিয়েছেন, দালালের উত্তর।
– আবার আমার প্রশ্ন, কোকের সাথে উনি কী জিনিস মিশিয়েছেন?
– উনি কোকের সাথে ‘মাল’ মিশিয়েছেন।
– কোকের সাথে কী মাল মিশিয়েছেন?
– উনি কোকের সাথে ফেন্সিডিল মিশিয়েছেন, দালালের জবাব।
– উনি কোকের সাথে ফেন্সিডিল মিশিয়েছেন নাকি ফেন্সিডিলের সাথে কোক মিশিয়েছেন! আমি একটু রসিকতা করতে চাইলাম। আমার উদ্দেশ্য সময় নষ্ট করে দালালকে উত্তেজিত করা।
– না, উনি কোকের সাথে ফেন্সিডিল মিশিয়েছেন, দালালের জবাব।
আমি তখন হেসে বললাম, এটা কোন কথা হলো! আমরা তো হামেশাই ফেন্সিডিল খাই। তাছাড়া উনি তো কোকের সাথে একটু ফেন্সিডিল মিশিয়েছেন। তাতে অসুবিধা কী? কাউকে তো উনি বিরক্ত করছেন না। তা আপনি কি নিশ্চিত যে উনি কোকের সাথে ফেন্সিডিল মিশিয়েছেন? হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত, দালালের জবাব।
এবার আমি দালালকে বললাম, চ্যালেঞ্জ করবেন আমার সাথে?
এই প্রথম দালালকে দেখলাম একটু সময় নিল। চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে আমার আপদমস্তক পর্যবেক্ষণ শুরু করেছে। হয়তো ভাবছে আমাকেও নামাবে কি না। এমন সময় সে বলে বসলো, হ্যাঁ, আমি চ্যালেঞ্জ করছি।
আমার মেজাজ তখন বিগড়াতে শুরু করেছে। এমন ঝামেলার ফল কী হতে পারে তা তাকে বললাম। কিছু ধমকও দিলাম। কিন্তু সে তখনও তার শিকার ছাড়েনি। যাত্রীটি দাঁড়িয়ে আছে তার সাথে। এ সময় সে তার শেষ অস্ত্র ছাড়লো। আমাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলো, কী করেন আপনি? আমি জানি এই প্রশ্নের উত্তরের উপর নির্ভর করছে ‘শিকার’ আর আমার ভবিষ্যৎ। কারণ তার সাথে পুলিশ আছে। পুরো বাসের লোক হাঁ করে দেখছে আমাদের এই খেলা। ভাবলাম একটু দুষ্টুমি করি আবার। বললাম, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী আমি এই দেশের মালিক।
লোকটি কী বুঝলো, আদৌ কিছু বুঝলো কিনা জানি না। কিন্তু এটুকু বুঝলাম, এমন উত্তর সে আশা করেনি। কয়েক মূহুর্ত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। হয়তো আমাকে পাগলও ভাবছে। আমার উত্তরে বাসের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশটি বললো, এই, তাড়াতাড়ি নেমে আয়। বাস ছেড়ে দে।
এমন অভিজ্ঞতা আমার প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হয়। উপরের দুটো ঘটনাসহ আরো কিছু ঘটনা আমি কেস স্টাডি হিসেবে ব্যবহার করি বিভিন্ন সময়। মজার ব্যাপার হলো, অনেকেই তখন বলেন এমন ঘটনা হয় তাদের সাথে ঘটেছে না হয় তাদের সামনে ঘটতে দেখেছেন। কিন্তু তারা কোনই উচ্চবাচ্য করেননি।
পকেটে নেশাদ্রব্য, ইয়াবা বা গুলি ঢুকিয়ে তরুণদের বা তাদের পরিবারকে ব্লাকমেইল করা, মেয়ে লাগিয়ে দিয়ে সমাজের উচ্চবিত্তদের ফাঁদে ফেলা, পার্কে বসা জুটিকে ফাসিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে সব কেড়ে নেয়া এমনকি মিথ্যা মামলায় জড়ানোর হুমকি তো নৈমিত্তিক ব্যাপার। আরো বড় সব ঘটনা আছে কী করে মানুষকে হয়রানি বা ফাঁদে ফেলে ফায়দা লুটে নেয়। অনেকক্ষেত্রেই সরকারি কর্মচারীরা জড়িত থাকেন এসব প্রতারণার সাথে। এদেরকে রুখতে না পারলে আপনিই হতে পারেন পরবর্তী শিকার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)