কয়েক দিন আগে আমাকে একটা দুষ্ট মেয়ে ‘দাদী’ খেতাব দিয়েছে। আমি নাকি আমার বন্ধুদের দাদী। খুব রাগ করতে পারিনি। আমি একটু ওরকমই, কাছের মানুষের উপর রাগ ঝাড়তে, খবরদারি করতে পছন্দ করি। নিজের গণ্ডির বাইরের মানুষ সেটা কীভাবে দেখলো বিবেচনা করতে পারি না।
রাজীবের মৃত্যুর খবর প্রচারের সময় থেকে ফেসবুক ভেসে যাচ্ছে সুখস্মৃতি, বন্দনা, জীবনে আটকে রাখতে না পারার আফসোসে। আমি কিছুই করতে পারিনি বা পারছি না। কিন্তু তার উপর আমার খবরদারি তো কম ছিল না। আমার শাসনও সে ভালই বাসতো। আমি কি আমার বাকি ২/৪ জন বন্ধুর মতো তাকে ভালবেসেছি? সহজ কথায় বললে, না।
পরীক্ষার পাস শেষে জীবনবোধের কারণে তার আর আমার পথ একেবারেই আলাদা হয়ে গিয়েছিল। তার থেকে বহু দূরের পথ হেঁটেছি আমি। আমাদের কর্মজগত, সামাজিক পরিসর কোথাও অভিন্নতা ছিল না। গত ১৫ বছরে তার সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনা হাতে গোণা। দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও তার কর্মকাণ্ড অজানা ছিল না। জেনেছি, সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছে। কর্মজগতে তুমুল আলোচিত-সমালোচিত। একই সঙ্গে খুব জনপ্রিয়ও।
চট্টগ্রামে শিক্ষকতা করলেও ঢাকার নানা অনুষ্ঠানে তার বিচরণ লক্ষ্য করার মতো। কী বিভাগের এলামনাইয়ের আয়োজন, বিভাগের নিয়মিত অনুষ্ঠান, কী বন্ধু আড্ডা। তার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
বছর কয়েক আগে ইন্দিরা রোডের বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম, অফিস যাব বলে। দরজা খুলে আমি হাঁ। কাকে দেখছি! ক্যাম্পাস ছাড়ার পর সেদিনই মনে হয় প্রথম দেখা। হ্যাঁ, দরজা খুলে আমি রাজীবকে দেখেছিলাম। আমাদের উল্টো পাশের বাসাটা খালি, টু-লেট ঝুলছিল। রাজীব বাসা দেখতে এসেছে। অফিসের তাড়া থাকায় ফোন নাম্বার বিনিময় করে বিদায় নিয়েছিলাম।
কয়েক মাস পর আবার দেখা। আমি ছেলের মেডিকেল রিপোর্ট নিতে ল্যাবে যাচ্ছি। সে যাচ্ছে কোথাও আড্ডা দিতে। মুখে একগাল হাসি। ছেলের খোঁজ নিয়ে জানালো, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছে। বাসা নিয়েছে আমার বাসার কয়েক গলি পরে। চায়ের নিমন্ত্রণ দিল। সেদিনের মতো বিদায় নিল।
সম্ভবত ২০১০ সালের ডিসেম্বরে রাজাবাজারে রাজীবের বাসায় দাওয়াত পেলাম। উপলক্ষ, বন্ধু সবিতা জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষক হয়েছে। ‘দাদী’ স্বভাবের কারণে জিজ্ঞেস করলাম, তুই ব্যাচেলর মানুষ বাসায় দাওয়াত দিচ্ছিস কেন? রান্নাবান্না করবে কে? ঝামেলার দরকার কী? চিরাচরিত হাসি দিয়ে বললো, চলে আসো, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে, হয়েছিলোও। জম্পেস আড্ডা হলো। দীর্ঘদিন পর অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। পুত্র ঘুমিয়ে পড়ায় আড্ডা অসম্পূর্ণ রেখে চলে এসেছিলাম।
দিনে দিনে সব মহলে তার উপস্থিতি বাড়তে থাকলো। কী তুমূল সেই পদচারণা। বুঝি আগেই জেনে গিয়েছিলো, তার সময় বড্ড কম। খালি শিক্ষক হলেই হবে না, অনেক অনেক কাজ করতে হবে। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চে স্লোগান দিলেই হবে না, বন্ধু আড্ডায় ফোক গান গেয়েও মাতাতে হবে। বন্ধুদের আণ্ডা-বাচ্চার সঙ্গে নাচানাচি করতে হবে। হ্যাঁ, কবিতা লিখতেও হবে। কবিতার বই ছাপাতে হবে। কবিতাদের জন্মের পর বন্ধুদের ইনবক্স ভরাতে হবে। মতামত চাইতে হবে। বইয়ের প্রচ্ছদ হওয়ার পর গ্রুপে দিয়ে আলোচনা করতে হবে। ছুটিতে বাড়ি গিয়ে ভাগ্নি আর প্রতিবেশীদের বাচ্চাদের নিয়ে মুদি দোকান দিতে হবে। সেই ছবি ফেসবুকে শেয়ার করতে হবে। যা যা ইচ্ছে করে সব, সব করতে হবে।
তার প্রথম বই ‘শুধু তোমার জন্য লিখি’ যে বছর মেলায় এলো সেই প্রকাশনায় যেতে পারিনি। তবে রাজীবের বই কেনার জন্যই মেলায় গিয়েছি। পরের মেলায়, বই মেলায় ভাইয়ের সঙ্গে ঘুরছি। অন্ধকার ফুঁড়ে রাজীব কোত্থেকে যেন হাজির। ঘাড় নীচু করে মাথা চুলকে (শিক্ষকদের সঙ্গে এই ভঙ্গিতেই কথা বলতো রাজীব) ভাইয়াকে ছোট গলায় বললো, স্যার আমার একটা বই বেরিয়েছে, দেখবেন। সরাসরি শিক্ষক না হলেও ভাইয়াকে স্যার বলতো সে।
আরেকদিন ভাইয়া-ভাবীকে দেখেছে আজিজ সুপার মার্কেটে। তাদের সুন্দর মুহূর্তের ছবি তুলে ফেসবুকে আমার সঙ্গে শেয়ার করেছে। সে জানতো এই ছবি আমার কাছে কত দামী এবং কত আনন্দের হবে। সে জানতো কার ভালবাসা কোথায় লুকিয়ে থাকে। এই যে ছাড়া ছাড়া কথা, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ, ভাসাভাসা জানাশোনা- এ দিয়ে মানুষকে বেশীদিন মনে রাখা যায় না, মানুষ বন্ধু হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলাম। সে হিসাবে বলা যায়, আমরা পরীক্ষা দিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বন্ধু হয়েছি। স্বল্পপরিচিত মহলে আমরা বন্ধুদের এভাবেই বন্ধু হিসেবে দাবি করি। কেবল ক্লাসমেট বলেই না, অন্য সূত্রে সে-আমি ডাবল বন্ধু হয়ে গেলাম। কলা ভবনে আমাদের পাশের বিভাগে ভর্তি হয়েছিল আমার স্কুলের বন্ধু। আমরা একই স্কুলে ১০ বছর পড়েছি। সেই বন্ধুর রুমমেট ছিলো রাজীব।
স্কুলের বন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে রাজীবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেল। তারা থাকতো সলিমুল্লাহ হলে, আমি শামসুন্নাহারে। আমার হল থেকে ওদের হলে যাওয়ার শর্টকাট একটা রাস্তাও ছিল। (সে রাস্তা বন্ধ করে পরে নির্মিত হয়েছে শিক্ষকদের বিশাল আবাসিক ভবন।) সলিমুল্লাহ হল পার হয়েই পলাশী বাজার। যেখান থেকে আমরা হলের মেয়েরা কাঁচা বাজার করতাম। চাল-তেল-ডিম-শব্জি কিনতাম। প্রয়োজনীয় ফটোকপি করাতাম। প্রতি শুক্রবার প্রায় নিয়মিত বাজারে যেতাম। বাজারে যাওয়ার আগে আড্ডা হতো সলিমুল্লাহ হলের গেস্টরুমে। রাজীব-রবীন ছাড়াও থাকতো ইমরুল, সাইফুল। আড্ডা শেষে পলাশীর বাজারে যাওয়া হতো সদলবলে।
রাজীব সব জায়গায় প্রথম হতে চাইতো। বন্ধু হিসেবেও তার এক নম্বর হওয়া চাই। রবীনের সঙ্গে ১০ বছরের বন্ধুত্ব সে উড়িয়ে দিতে চাইতো। রবীনকে জন্মদিনে আমি হয়তো একটা বই কিনে দিয়েছি, তাই রাজীবকেও দিতে হবে। রবীনের বোন ঢাকায় পড়তে এসেছে। তার ভর্তি, হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হয়েছি, তাই রাজীবের বোনেরও সব দায়িত্ব আমাক নিতে হবে।
সম্ভবত দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় এক শীত রাজীব কাটিয়ে দিল শীতের কাপড় না পরে। রবীনকে কোন একটা কাজে আমি ৫শ টাকা দিয়েছি তাই রাজীবের শীতের কাপড় কেনার টাকা আমাকেই দিতে হবে। ওই সময় আমার কাছে টাকা ছিল না। আবার এই আব্দারটাও আমার কাছে বাড়াবাড়িই মনে হয়েছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সে আর শীতের স্যোয়েটার কিনলো না।
আরেকবার এক সন্ধ্যায় আজিজে গিয়েছি বই কিনতে। কিনলামও একটা। দাম দেয়ার পর রাজীব বইটা হাতে নিয়ে বললো, বইটা আমি নিয়ে যাই, কালই ক্লাসে তোমাকে দিয়ে দিব। সেই বই এখনো রাজীবের আলমারীতে। যতবার দেখা হয়েছে, বলেছি- আমার বই কই? বই দে। প্রতিবারই হাসি দিয়ে বলেছে, আমার বাসায় আছে, নিয়া আইসো।
স্মৃতিগুলো পড়তে পড়তে মনে হতে পারে, আমি তার সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিলাম বলে দাবি করছি মৃত্যুর পর। মোটেও না। পুতুল, মুন্না, কাকলী, চিত্রা, সুজন, চন্দন, সাজু, ইমরুল বা ক্লাসের যে কেউ এর চেয়ে বিশাল বিশাল স্মৃতির ভাণ্ডার নিয়ে হাজির হতে পারবে। সবার কাছেই রাজীব ছিল এমন।
একজন মানুষ জীবনের নানা বাঁকে এসে বদলে যেতে পারে; তার জীবন, বোধে পরিবর্তন আসতে পারে। এই চলার পথে অনেক মানুষ যোগ হয় আবার অনেকে ঝরে পড়ে। এটাই জীবনের নিয়ম। কিন্তু রাজীবের মা? যাকে বিভাগের চেয়ারপার্সনের চেয়ারে বসিয়ে গর্বভরে ছবি শেয়ার করেছিল রাজীব। রাজীবের দুই নয়নের মণি তার দুই বোন! রাজীবের স্ত্রী। দু’জনের রোমান্সের ছবি আর ভাসবে না টাইমলাইনে! বিভোর! রাজীবের কন্যা! কেউই তো চায়নি এখনই এত তাড়াতাড়ি এরকম বিচ্ছিন্নতা!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)