একাদশ জাতীয় সংসদ যাত্রা শুরু করেছে। টানা তৃতীয়বার এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ চতুর্থবারের মত সরকারি দলের আসনে। একই সঙ্গে টানা দ্বিতীয়বারের মত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি বিরোধীদলের ভূমিকায়।
নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর এটাই দলটির সেরা সময়। দশম ও একাদশ সংসদে বিরোধীদলের ভূমিকায় জাতীয় পার্টি। পতনের পর এরশাদ কিংবা দেশের কেউই এমন ভাবেননি, তবে এটাই ঘটেছে।
দশম ও একাদশ সংসদের মধ্যকার পার্থক্য হচ্ছে আগের সংসদে ছিল না বিএনপি; এবার তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। দলটির নির্বাচিতরা সাংসদ হিসেবে শপথ নেবেন কিনা সেটা পরের ব্যাপার তবে তারা কাগজে কলমে এখনও আছেন তালিকায়। বিএনপির মত দল থাকার পরেও এরশাদের জাতীয় পার্টি জাতীয় সংসদের বিরোধীদল- এটা দলটির অনেক বড় অর্জন, নিঃসন্দেহে।
বন্দুকের নলে ক্ষমতা দখলের পর নয় বছর দেশ শাসন করেন সামরিক শাসক এরশাদ। তাকে বলা হয় স্বৈরাচার, শাসনামলটাও স্বৈরশাসন। তার ক্ষমতাচ্যুত করতে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ, বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপিসহ দেশের সকল দলই রাজপথে আন্দোলনে ছিল।
এরপর তীব্র গণআন্দোলনে নব্বইয়ে এরশাদের পতন হলেও ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া নির্বাচনে এরশাদের দল সবাইকে অবাক করে দিয়ে ৩৫টি আসনে জয়লাভ করে।
এরপর ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৩২টি আসন, ২০০১ সালের নির্বাচনে ১৪টি আসন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ২৭টি আসন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩৪টি আসন, এবং সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদের দলের আসন সংখ্যা ২২।
এর মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নেয়নি জাতীয় পার্টি। তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগের সঙ্গে তারাও ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের আন্দোলনে।
প্রতি নির্বাচন শেষে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এরশাদের দলের আসন সংখ্যা। তারা গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে কিন্তু প্রতি নির্বাচনে আসনপ্রাপ্তির দিক থেকে একটা ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে। গত তিনটি নির্বাচনে তারা মহাজোটের শরিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের দলীয় ভোটারদের ভোট পেয়েছে ঠিক কিন্তু এটাও জোটগত রাজনীতির কৌশল। এই কৌশল দিয়ে এবং বৃহত্তর রংপুর এলাকার এরশাদের নিজস্ব ভোটব্যাংককে কাজে লাগিয়ে রাজনীতিতে তারা টিকে আছে।
এই সময়ে এরশাদের দল বারবার ভেঙেছে। নাজিউর রহমান মঞ্জুর, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, কাজী জাফর আহমেদসহ যারাই জাতীয় পার্টির ভেঙেছেন তারাই দিনশেষে একা এক দলের এক নেতা হিসেবে নিজেরা অথবা তাদের উত্তরাধিকাররা বিবেচিত হয়েছেন।
ব্র্যাকেটবন্দি জাতীয় পার্টির ওইসব নেতা ছাড়া তাদের দলগুলোর অস্তিত্ব নাই। তবে এতকিছুর পরেও এরশাদ টিকে রয়েছেন, এবং জাতীয় সংসদের বিরোধীদল হিসেবে তার দল টানা দুইবার দায়িত্ব পালনের পথে রয়েছে।
এটা এরশাদের দলের জন্যে, এরশাদের রাজনীতির জন্যে উল্লেখযোগ্য দিক। অথচ এই দলটির পরিণতি মুসলিম লিগের মত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেটা না হয়ে এরশাদের দল এখনও রাজনীতিতে টিকে আছে এবং জাতীয় সংসদের বিরোধীদল হিসেবেই টিকে আছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগবিরোধী বলয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আওয়ামী লীগবিরোধী বড় দল হিসেবে বিএনপিই বাকি সকলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল হিসেবে প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির যে ঐতিহ্য আওয়ামী লীগ ধারণ করে আসছিল গত ক’বছরে সেখানে কিছু দাগ পড়লেও এই ধারার রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখতে এখনও আওয়ামী লীগের বাইরে শক্তিশালী আর কোন দল খুঁজে পাওয়া যায়না।
এরশাদের জাতীয় পার্টিও ডানপন্থী রাজনীতির ধারক। তবে এই ডানধারার নেতৃত্ব দিয়ে আসছে বিএনপিই। এরশাদের দল এই ধারার নেতৃত্ব দেওয়ার মত অবস্থায় না থাকলেও তারা নিজেদেরকে টিকিয়ে রেখেছে মূলত কৌশল দিয়েই।
অবশ্য অনেকেই বলে থাকেন এরশাদের রাজনীতিতে টিকে থাকার মূল কারণ তাকে নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির টানাটানি। এটা সর্বাংশে মিথ্যা নয়। একটা সময়ে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে আওয়ামী লিগ-বিএনপির টানাটানি ছিল রাজনীতির আলোচনার বিষয়।
তবে গত এক দশকে এরশাদ আওয়ামী লীগকেই আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন; আওয়ামী লীগও তার দলকে আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের এই আশ্রয় দান নিজেদের প্রয়োজনে ঠিক তবে এর মাধ্যমে এরশাদও তার রাজনৈতিক বিলুপ্তিকে ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছেন। ফলও পেয়েছেন হাতেনাতে; দশম ও একাদশ সংসদে তার দলকে বিরোধীদলের আসনে বসিয়ে।
গতবার আর এবার জাতীয় পার্টির সংসদে ভূমিকার পার্থক্য হলো আগে যেখানে তারা সরকারের অংশ আবার বিরোধীদল এই দ্বৈত ভূমিকায় ছিল এবার সেটা না হয়ে স্রেফ বিরোধীদল তারা।
গতবার রওশন এরশাদ ছিলেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, আবার একই দলের একাধিক সাংসদ মন্ত্রিসভার সদস্যও হন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হন মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত।
ওই সময়ে একাধিকবার জাতীয় পার্টির মন্ত্রিসভার সদস্যদের মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগের কথা জানানো হলেও তারা কেউ মন্ত্রিসভা ছাড়েন নি। উপরন্তু পুরো পাঁচ বছর মন্ত্রিত্ব করে গেছেন। এবার তার ব্যতিক্রম হয়েছে। জাতীয় পার্টিকে কেবল বিরোধীদলের ভূমিকায় থাকতে হচ্ছে।
দশম সংসদে জাতীয় পার্টিকে ‘গৃহপালিত বিরোধীদল’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন অনেকেই। এমনকি দলটির অনেকেই তীব্র খেদে মাঝেমাঝে নিজেদের এমন পরিচয়কেও স্বীকার করেছিলেন; এর কারণ ছিল মূলত সরকারের অংশ থাকার পাশাপাশি বিরোধীদলীয় আসন গ্রহণের।
এবার একটা পরিচয় কিংবা অপবাদ তাদের মুছে গেছে। স্রেফ বিরোধীদল হিসেবে তাদের ভূমিকা পালনের সিদ্ধান্ত দলটিকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। তবে প্রকৃত অর্থে তারা বিরোধীদলীয় ভূমিকা পালনে সক্ষম কিনা তা সময়ই বলে দেবে।
কারণ ২২ আসন নিয়ে জাতীয় সংসদের বিরোধীদল হলেও দলটির নির্বাচিতরা ভালো করেই জানেই এটা যতটা না তাদের দল ও নির্বাচিতদের মুনশিয়ানা তারচেয়ে বেশি আওয়ামী লীগের বদান্যতা কিংবা আনুকূল্য। এর প্রতিদান দিতে গেলে তারা নিশ্চিতভাবেই প্রকৃত বিরোধীদলীয় ভূমিকা পালন করতে পারবে না বলেই মনে হয়।
ইত্যমধ্যে দলটির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টি কারো পাতানো খেলায় অংশ নেবে না। সংসদে গৃহপালিত বিরোধী দল হতে যাবে না কখনোই।
সংসদীয় গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী জাতীয় পার্টি প্রতিটি অধিবেশনে ভূমিকা রাখবে’। এই বক্তব্য যদি বাস্তবায়িত হয় দলটির নির্বাচিতদের দ্বারা তবে হয়ত একটা গঠনমূলক বিরোধীদল পেতে যাচ্ছে সংসদ। তবে বাস্তবতা বিবেচনায় এখনই এই বক্তব্যে আস্থা রাখতে পারছি না; তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এজন্যে সময় নিতেও আগ্রহী আমি।
জাতীয় পার্টির সংসদের ভূমিকা কেমন হতে যাচ্ছে এনিয়ে এখনই কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারলেও দলটি যে তাদের রাজনীতির সেরা সময়ের মধ্যে রয়েছে এনিয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই।
তবে সেরা এই সময়ের বাইরে দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আওয়ামী লীগের আনুকূল্য সরে গেলে দলটি কি টিকবে? কিংবা বয়সের ভারে নুয়ে এরশাদের পর দলটি কতদিন টিকে থাকবে?
দলটির অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা দিকটি বিবেচনায় নিলে এই প্রশ্ন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। জাতীয় পার্টি সরকারের অংশ হয়ে থাকবে নাকি বিরোধীদলে থাকবে এনিয়ে নিকট অতীতের নানা মতের প্রকাশ শেষে এরশাদের বিরোধীদলের ভূমিকা পালনের সিদ্ধান্ত এই প্রশ্নকে ফের সামনে নিয়ে আসছে।
জাতীয় পার্টির বর্তমান তাদের জন্যে সুখের কিন্তু অনিশ্চিত তাদের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতের এই অনিশ্চয়তা সম্পর্কে তারা কিছু কিছু ভাবছে কিনা কে জানে তবে এরশাদের পর এই দলটির ভবিষ্যৎ নিশ্চিতভাবেই অন্ধকার।
সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদ দলটিকে এখনও টিকিয়ে রেখেছেন, তার অবর্তমানে দলটি আরও এক বা একাধিকবার ভাঙতে পারে। ভাঙনের পর ওইসব ব্র্যাকেটবন্দি জাতীয় পার্টির এক বা একাধিক অংশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অংশ হিসেবে থাকবে, কেউ কেউ আবার জায়গা না পেয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটেও যেতে পারে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের নিজেদের জোটে জাতীয় পার্টির একাধিক অংশকে রেখেছে। আগামীতে এই সংখ্যা বাড়তেও পারে।
গত দশ বছরে আওয়ামী লীগের মহাজোটের অংশ হিসেবে সরকারের অংশ ও বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করা জাতীয় পার্টি সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়নি। সারাদেশে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা দলে দলে আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে যোগ দিয়েছে।
এত এত সুবিধাপ্রাপ্তির পরেও এরশাদ সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করতে কোন উদ্যোগ না নিয়ে কেবল ক্ষমতার রাজনীতি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আনুকূল্য প্রত্যাশী ছিলেন। তার এই কৌশল তাকে ক্ষমতার কাছাকাছি রাখলেও দলকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
এর খেসারত তাকে দিতেই হবে। সময়টা এখন তার সুসময়ের হলেও একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগুচ্ছে জাতীয় পার্টি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)