চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ কি বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে পারতেন?

৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই খুনী ফারুক-রশীদ-ডালিম চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। সেদিন অনেকটা নির্বিঘ্নেই তারা একের পর এক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে চরম ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে এক ঘৃণ্য ইতিহাসের জন্ম দেয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে নির্মম হত্যাকান্ড চালালেও সেদিন বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের সদস্যদের রক্ষায় কোনো ধরনের ভূমিকা ও সামর্থ দেখাতে ব্যর্থ হন তৎকালীন সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ। সেনাপ্রধানের সেদিনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা এখনও যেমন রহস্যাবৃত হয়ে আছে তেমনি ইতিহাসের পাতায় তা নিন্দনীয় এক অ্যাখ্যান হিসেবেও লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে যারা গবেষণা করছেন তারাও মনে করেন সেদিন তৎকালীন সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ সঠিক সাহসী ভূমিকা রাখতে পারলে ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে নির্ণিত হতো। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকান্ডের মতো এত বড় একটি অন্যায়কে তিনি যদি অনুগত সৈন্য সামন্ত নিয়ে প্রতিরোধ করতেন, খুনীদের চ্যালেঞ্জ জানাতেন তাহলে ইতিহাস সত্যিই লেখা হতো অন্যভাবে। এমন কি তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রণাঙ্গণের মতো নিজ বাহিনী নিয়ে যদি দ্রুত শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন তাহলে বঙ্গবন্ধু বেঁচেও যেতে পারতেন। ১৫ আগস্টের সার্বিক প্রেক্ষাপটে এ কথাগুলো অনুমানভিত্তিক হলেও এ ধরনের প্রশ্ন তোলা বা উত্থাপনের পেছনে যথেষ্ঠ কারণও আছে।

বঙ্গবন্ধুকে রক্ষায় ১৫ আগস্ট ভোরে শুধুমাত্র এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ। ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর রোডের অনেকটা নিকটবর্তী অবস্থানেই তিনি ছিলেন। তাঁর বাসভবন ছিল গণভবন এলাকায়। খবর পেয়ে গণভবন থেকে নিজস্ব জীপে করে বাসা থেকে সোবহানবাগ পৌঁছালে খুনী সৈনিকরা তাঁকে সেখানেই হত্যা করে। সেদিন কর্নেল জামিল উদ্দিন ছাড়া আর কেউ বঙ্গবন্ধুকে রক্ষায় এগিয়ে আসেননি। এই একজনই কেবল স্পটে জীবনদান করেন বঙ্গবন্ধুর জন্য।

১৫ আগস্ট এলে হাজারো লক্ষ প্রশ্ন আমাদের চারপাশে ঘুরতে থাকে। সবকিছু জানা ও শোনার পরেও সেদিন ভোরে সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ কেন একজন সৈন্য পাঠাতে ব্যর্থ হলেন-এ প্রশ্ন যে অনাদিকাল ধরে ইতিহাসে ঘুরতে থাকবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান লে. কর্নেল কাজী মুহাম্মদ সফিউল্লাহকে সেনাপ্রদান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে তিনি ছিলেন মেজর র‌্যাংকের একজন সেনা অফিসার। যুদ্ধের মধ্যেই তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। সাহস এবং যুদ্ধকৌশল ভাল জানার কারণে যুদ্ধের সময় তিনি তিন নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। শুধু এই নয় তাঁর নামে ‘এস’ ফোর্সও গঠিত হয়। সম্মুখ সমরে যোগ্য নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে তিনি বীরউত্তম খেতাবেও ভূষিত হন। কিন্তু কেন মুক্তিযুদ্ধের ময়দানের এই সাহসী সৈনিক ১৫ আগস্ট সামান্যতম সাহস, কৌশল দেখাতে ভীষণরকম ব্যর্থ হয়েছিলেন?

এখনও অনেকেই মনে করেন ১৫ আগস্ট সকালে যদি সেনাপ্রধান কোনো ইউনিট থেকে তাঁর অনুগত এক প্লাটুন বা কোম্পানী সেনা নিয়ে পাল্টা মুভ করাতে পারতেন তাহলে দৃশ্যপট দ্রুতই চেঞ্জ হয়ে যেত। কাউন্টার অ্যাটাকে ফারুক-রশীদ চক্রের সবকিছু দ্রুতই ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। কেননা সেদিন হাতে গোণা কয়েকজন কর্নেল, মেজর, ক্যাপ্টেন র‌্যাংকের অফিসারদের নেতৃত্বেই বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। এর বাইরে আর সব অফিসারই তো তার নিজ নিজ ইউনিটে দায়িত্বরত ছিলেন। তাহলে কেন সেনাপ্রধান সেদিন কিছুই করলেন না বা নির্দেশও দিলেন না।

২০০২ সালের আগস্ট মাসের কথা। ক্যান্টমেন্টনের বাসভবনে বসে সে সময়কার (৭৫ সাল) সেনপ্রধান কে এম সফিউল্লাহর অন্তরঙ্গ ইন্টারভিউ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকার জন্য। ইন্টারভিউটি সেবছর ১৫ আগস্ট তারিখে ছাপা হয়। সেই আঠারো বছর আগে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড এবং তাঁর ভূমিকা নিয়ে তিনি যে যে কথাগুলো বলেছিলেন, পরবর্তীতে সেসব কথামালার খুব একটা হেরফের চোখে পড়েনি। এমন কি আদালতে সাক্ষী হিসেবে যে কথাগুলো বলেন সেগুলো তিনি আগেও গণমাধ্যমেও বলেছেন বলে প্রতীয়মান।

১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ডাইরেক্টর মিলিটারি ইনটেলিজেন্স (ডিএমআই) লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালাহউদ্দিনের কাছ থেকে প্রথম সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি অ্যাটাক্ট হওয়ার খবর পেয়েছিলেন। কর্নেল সালাহউদ্দিন সরাসরি সেনাপ্রধানের বাসায় গিয়ে তাঁকে বলেন আরামার আর আর্টিলারিরা শহরের দিকে যাচ্ছে। এ কথা শোনার পর সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ কর্নেল সালাহউদ্দিনকে বলেন, বিষয়টি ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডার শাফায়াত জামিল জানে কিনা? সফিউল্লাহ সে সময় জানিয়েছিলেন, বিষয়টি জানার পরপরই তিনি সালাহউদ্দিনকে শাফায়াত জামিলের বাসায় পাঠান। সফিউল্লাহর বয়ান সেসময় তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফোনে শাফায়াত জামিলকে পুরা ঘটনার কথা বলে ফাস্ট,সেকেন্ড এবং ফোর্থ বেঙ্গলকে পাঠিয়ে তাদেরকে প্রতিহতের নির্দেশনা দেন। এরমধ্যে ফোনে বঙ্গবন্ধুকে পাওয়ার পরপরই তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘স্যার আই অ্যাম ডুইং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউপ অফ দ্যা হাউস?’ এদিকে সফিউল্লাহ খবর পান তিনি শাফায়াত জামিলকে যে নির্দেশ প্রদান করছেন তা কার্যকর হচ্ছে না। কোনো সৈন্য মুভ করছে না। একসময় তাঁর এডিসি হুমায়ূন কবীর জানান, বঙ্গবন্ধু ইজ ডেড।

এদিকে সকাল আটটার দিকে এসে ডালিমসহ বেশ কয়েকজন সৈন্য সব নিয়মকানুন ভেঙে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর রুমে ঢুকে সরাসরি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে তারা হত্যা করেছে। তাদের কথায় সব চলবে। সেনপ্রধানকে এখনই রেডিও স্টেশনে যেতে হবে। সেসময় সেনপ্রধানের সাথে ডালিমের অনেক তর্কাতর্কি হয়। এক পর্যায়ে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ রুম থেকে ৪৬ ডিভিশনে যান। কিন্তু ওখানে গিয়ে খানিকটা নির্বাক হন। দেখেন, কোনো সেন্যই মুভ করেনি। সেই আঠারো বছর আগে তিনি ক্লান্ত চোখে এই প্রেক্ষাপটের বর্ণনা করেছিলেন এভাবে-‘সিজিএস খালেদ মোফাররফ আমার রুমে। খালেদ কেবল কথা শুরু করবে। এক সময় ১৫ থেকে ১৬ জন সৈন্যসহ আমরা রুমে ঢুকলো মেজর ডালিম। বেলা তখন প্রায় আটটা। সবার অস্ত্র আমার দিকে তাক করা। আমি তখন ইংরেজিতে ডালিমকে বললাম, দেখ ডালিম এই সব অস্ত্র দেখেছি ও ব্যবহার করেছি। তুমি যদি অস্ত্র ব্যবহার করতে আসো তাহলে করো। আর যদি কথা বলতে আসো তাহলে অস্ত্র ও লোকজন বাইরে রেখে আসো। ডালিম একথা শুনে অস্ত্র নিচে নামিয়ে রাখলো। এরপর বলল, স্যার প্রেসিডেন্ট আপনাকে রেডিও স্টেশনে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি বললাম প্রেসিডেন্ট তো মারা গেছেন। ডালিম তখন এ শুনে বলল, ইউ শুড নো খোন্দকার মুশতাক ইজ এ প্রেসিডেন্ট নাউ। আমি বললাম, খোন্দকার মোশতাক মে বি ইউর প্রেসিডেন্ট, হি ইজ নট মাইন। সে (ডালিম) বলল, আমাকে এমন কিছু করতে বাধ্য করবেন না যা আমি করতে আসিনি। আমি বললাম, ইউ ক্যান ডু এনিথিং। এ কথা বলে অনেকটা ঠেলেই গাড়িতে উঠলাম। আমি দ্রুত ৪৬ ব্রিগেডে এলাম। ৪৬ ব্রিগেডে এসে দেখি সবাই চুপ করে বসে আছে। স্বভাবতই আমি একা আমার সাথে কেউ নেই।’

তৎকালীন সেনাপ্রধান কেএম সফিউল্লাহ অনেকবার বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি রক্ষা করতে যেতে পারেননি। এটি তাঁর ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা নিয়ে তিনি বেঁচে আছেন। বারবারই বলেছেন, নিজের চরম ব্যর্থতা ও অসামর্থের কথা। মাঝে মাঝে তিনি হাস্যকর কথাও বলেছেন। কখনও কখনও দোষ চাপিয়েছেন তৎকালীন ৪৬ ডিভিশনের প্রধান মেজর শাফায়াত জামিলের উপর। বলেছেন, শাফায়াতকে তিনি বলেছিলেন সৈন্য মুভ করাতে। কিন্তু শাফায়াত জামিল তার কথা একদমই শোনেননি।

কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল বীরবিক্রম বেঁচে নেই। মারা গেছেন বেশ কয়েকবছর হলো। সাবেক সেনাপ্রধান কেএম সফিউল্লাহ বীরউত্তম এখনও বেঁচে আছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর রাজনীতির সাথেও তিনি জড়িত। মাঝে মাঝে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে রক্ষায় তিনি একা গেলে কর্নেল জামিলের মতো অবস্থার উনারও হতো। এটিও এক হাস্যকর মন্তব্য।
সেনাবাহিনী কমান্ডে চললেও সেনাপ্রধান হিসেবে উনার কমান্ড ১৫ আগস্ট সেদিন কেউ শুনলো না-এর উত্তর কি আর কোনোদিন মিলবে? বঙ্গবন্ধুর বাঁচার শেষ আকুতি বা নিবেদনটি ছিল সেনাপ্রধান কেএম সফিউল্লাহর কাছেই ‘সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’ না সেনাপ্রধান কেএম সফিউল্লাহ সেদিন বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে ফোর্স পাঠাতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুও হয়ত ভেবেছিলেন সফিউল্লাহই তাঁকে বাঁচাতে পারবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)