ভাষা অন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের বহু স্মৃতি বুকে ধারণ করে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি স্থানেই যেন দেশের ক্রান্তিকাল এবং তা থেকে উত্তরণের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। তার বড় উদাহরণ সেখানকার শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা।
এই সংগ্রহশালায় যেমন আছে, ভাষা শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি, তেমনি আছে বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ যারা বাংলাদেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তাদের স্মৃতি। ৫২’র ভাষা অন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা, ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এবং এর পরবর্তী কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন সময়কালের আলোকচিত্র, চিত্রকর্ম, দলিল দস্তাবেজ, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিকৃতিসহ আরো গুরুত্বপূর্ণ নথি ও বই রয়েছে এই সংগ্রহশালায়।
স্বাধীনতা দিবসের বিকাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে শেরে বাংলা ফজলুল হক হলের সামনে বেশ ভিড় দেখা গেলো। সেখানে স্থানীয় ও বাইরের দর্শণার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে এসেছেন। তাদের গন্তব্য শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা।
সেখানে ফটকের বাম পাশে রাখা রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ড. একে এম নুরুল ইসলামের ব্যবহৃত একটা ভাঙা গাড়ী। তিনি এই গাড়ীটা একাত্তরে ব্যবহার করতেন। এরপর দেখা গেলো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটা আলোকচিত্র, তার পাশেই মোটা হরফে লেখা স্বাধীনতা ঘোষণার সেই দলিল।
তার পাশেই ১ নং গ্যালারি। ভেতর থেকে কথার গমগম শব্দ আসছে। বোঝা যায় অনেক লোক ভেতরে। কেউ অন্য একজনকে ডেকে বলছে, দেখ দেখ শামসুজ্জোহা স্যারের সেই গুলিবিদ্ধ অবস্থার ছবি। পাশে আরেক জন বলছে, ’স্যার ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় শিক্ষার্থীদের জন্য জীবন দিয়েছিলেন তারই ছবি। এটা তার স্মৃতি রক্ষার্থে রাখা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা ভালবাসা থাকলে বলা যায় যে, ‘কোনো ছাত্রের গায়ে একটা গুলি লাগার আগে সেই গুলি যেন আমার বুকে লাগে।’ এ কথা শুনেই শরীরের আলাদা একটা অনুভূতি হয়। সেখানে রাখা তার রক্তমাখা শরীর, হাসপাতালে নিথর দেহ আর তাকে কবরে নিয়ে যাওয়ার আগে তার স্ত্রীর আর্তনাদের ছবি মনে দাগ কেটে যায়। তার ব্যবহৃত অন্য জিনিসপত্র মনকেই জাগিয়ে তোলে তার সম্পর্কে জানতে।
সংগ্রহশালায় আছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া এক যোদ্ধা বন্দুক নিয়ে সংগ্রামের মিছিল দিচ্ছেন, এমন একটা ভাস্কর্য। পাশেই ভাষা আন্দোলনের সময় আর্তনাদ করা প্রণব দাশের একটা ভাস্কর্য। আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারের ছবি। যেটা পরে পুলিশ ভেঙে ফেলেছিল। আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যারা সাক্ষ্য দিয়েছিল তাদের ছবিও আছে সেখানে। ভাষা আন্দোলনের আলোকচিত্র, ১৪৪ ধারা ভেঙে মাওলানা ভাসানীর কার্যক্রমের ছবি, ৬৯ এর গণঅভ্যুধানের সময় পুলিশের নির্যাতনের ছবিসহ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার রচিত আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের আলোকচিত্র।
দ্বিতীয় গ্যালারির সামনেই আছে একাত্তরের শহীদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যাপক শহীদ হবিবুর রহমানের ব্যবহার করা কোর্তা, ছাতা ও সম্মাননা স্মারকলিপি। আছে মুক্তিযুদ্ধের সেই সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের আলোকচিত্র। শহীদ নওরোজদ্দৌল্লা খানের ব্যবহার করা টাই, কোট, পাঞ্জাবী, রক্তমাখা টুপি।
এছাড়াও আছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া আব্দুল রাজ্জাক, মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামান টুনু, শহীদ লে. মো. আনোয়ারুল আজিম, শহীদ আ. হালিম চৌধুরী, বীর বিক্রম শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসান, শহীদ মোফাজ্জাল, বিগ্রেডিয়ার গিয়াস উদ্দীন, হায়দার চৌধুরী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ও মীর আব্দুল কাইয়ম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্রী সন্তোষ কুমার ভট্টাচার্য, ড. জ্যোর্তিময় গুহ ঠাকুরতা, শহীদ মুনির চৌধুরীর ব্যবহার করা পোষাক, প্লেট, বই, ব্যাগ, ডায়েরি, নকশী কাঁথা, বাইনোকুলার, কম্বল, প্যান্ট ছাইদানী, ছাতা, লাঠি, স্যুট, প্যান্ট, জুতা, তোয়ালে, মগ, ক্রাচসহ আরো অনেক কিছু।
দেশ স্বাধীন করতে যে সন্তান যুদ্ধে গেছে, সেই সন্তান মাকে একবারের জন্যও ভোলেন নি। মাকে চিঠি লিখেছেন শহীদ বীর প্রতীক আব্দুল্লাহ-হিল-বাকী। তাকে যে আদর করে সাজু নামে ডাকতেন তাও তিনি চিঠিতে উল্লেখ করে গেছেন। এই চিঠি দেখে কোন অজানায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। মনে হয় যেনো সেদিনের ঘটনা। মনের মধ্যে কেমন জানি আচমকা দাগ কেটে যায়। দেখার কৌতুহল আর শেষ হয় না। যে পাশে দেখি সব দেশ বরণ্যে গুণীজন। সেদিন ছিল ৩ নভেম্বর, জেল হত্যার শিকাড় হয়েছিলেন এইচ এম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ। তারাই এক সময় দেশ পরিচালনা করেছেন। তাদের কথাই আবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্মম হত্যাযজ্ঞের কথা। সেখানে আছে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পোশাক, চশমা, ডায়েরিসহ মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাগ করা ১১টি সেক্টরের কমান্ডারদের ছবি।
তৃতীয় গ্যালারিতে প্রবেশ করেই চমকে যেতে হয়। সেখানে রাখা মানুষের মাথার খুলি আর হাড়গোড় দেখে। এগুলো ছিল ১৯৭১ সালের গণহত্যায় নিহত শহীদের মাথার খুলি আর হাড়গোড়। শহীদ শামসুজ্জোহা হলের পাশে বদ্ধভূমির গণকবর থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে এসব। তার পাশেই একাত্তরে পাক-হানাদার বাহিনীর ব্যবহার করা লোহার গুলির বাক্স, কাঠের গুলির বাক্স, বুলেট, রকেট লঞ্চার, ছুরি, মাইনের ঢাকনা, মগ, বেল্ট ইত্যাদি।
গ্যালারির বড় একটা অংশজুড়ে আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র। একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ করার আলোকচিত্র। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা ছবি, শিল্পী পলাশ উদ্দীনের কাঠ দিয়ে তৈরি জীবন যুদ্ধের মূর্তি, আবু তাহের বাবুর আঁকা যুদ্ধের সেই বর্বরতার ছাপ, কামরুল হাসানের ৭১ সালের থিস ডিমোনেস এর আলোকচিত্র, পোড়া মাটির নারী মূর্তি আর রাবি ছাত্র নেতা শহীদ শাহজাহানের রক্তমাখা শার্ট মনকে নাড়া দিয়ে যায়। এছাড়াও আছে শহীদ নওরোজ দৌল্লাখানের ওয়ারলেস তৈরি করার সেই ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র, টি শার্টে লেখা ১৯৭১ সাল রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং গণকবর থেকে তুলে আনা সেই পবিত্র মাটি। যা আমাদের বর্তমান থেকে অতীতকে জানার ইঙ্গিত আজও বহন করে চলছে।
এছাড়াও রয়েছে একটা উন্মুক্ত মঞ্চ। বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা করার জন্য রয়েছে গবেষণা পাঠাগার। এখানে ১৯৪৭-৭১ সালের উপর প্রায় ৩ হাজার কপি বই, গ্রন্থমালা, পুস্তিকা, ইশতেহার ও সংকলন আছে। বইয়ের পাশাপাশি উল্লেখিত সময়ের পত্রিকা বাঁধাইকৃত আছে। আরও রয়েছে ভাষা আন্দোলন, গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিত্তিক পত্রিকার কাটিং ফাইল। যা দেশ বিদেশ থেকে আগত শিক্ষার্থীদের গবেষণা করার জন্য একটা উপযুক্ত সংগ্রহশালা।
সংগ্রহশালা সূত্রে জানা যায়, এখানে দেশ-বিদেশ থেকে অনেক দর্শণার্থী আসেন। এছাড়াও সংগ্রহশালার মন্তব্য করার ডায়েরিটা দেখলেই বুঝা যায় এখানে কত ধরণের দর্শণার্থী আসেন। আরো জানা যায়, সংগ্রহশালা পারিপূর্ণ করার জন্য অনেক আলোকচিত্র আনা হয়েছে যা অতি দ্রুত দর্শণার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। এজন্য সংগ্রহশালায় আরো একটা গ্যালারি তৈরি করা হয়েছে।
বাংলাদেশের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা বিশ্বের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন সংগ্রহশালা আছে কিনা আমার জানা নাই। তবে এটাই বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সংগ্রহশালা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই সংগ্রহশালাটি। ১৯৭৬ সালের ২ জানুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের সভাপতিত্বে এক সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও দেশের ক্রান্তিকালে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের অত্মত্যাগ, দলিলপত্র, বিভিন্ন আলোকচিত্র ধরে রাখার জন্য এটি নির্মাণ করার সিন্ধান্ত নেন।
ওই বছরের ৬ মার্চ তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা আবুল ফজল আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেন। ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের স্মরণে দর্শণার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। পাশাপাশি অবস্থিত তিনটি গ্যালারির মোট আয়তন ৬ হাজার ৬শ বর্গফুট।
১৯৯০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষকের সহধর্মিণী ওয়াহিদা রহমান, মাস্তুরা খানম ও শ্রীমতী চম্পা সমাদ্দার স্থায়ী প্রদর্শণী গ্যালারি উদ্বোধন করেন।
শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালাটি প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২ পর্যন্ত সকল দর্শণার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।