একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ বালুচ এবং ১৮ ও ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু করে বর্বরতম গণহত্যা। কারণ একটাই ’৬৬’র ছয় দফা, ’৬৯’র ১১ দফার পথ ধরে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ এখানেই বটতলায় লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে ছিলেন শিক্ষার্থীরা।
আর পত্রিকায়, লেখনীতে, লেকচারে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বুনছিলেন তাদের শিক্ষকরা। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্নের চারাগুলো বেড়ে উঠছিলো জগন্নাথ হলে। একটু দূরেই ইকবাল হলে (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) স্বাধীনতার সুসংগঠিত সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তাই পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এবং রাজারবাগে পুলিশ লাইন্সের সশস্ত্র বাঙালিদের পাশাপাশি ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটে নিরস্ত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কসাইখানায় পরিণত করেছিল পাকিস্তানি সেনারা।
সেই রাতে ট্যাংক, মর্টার, মেশিন গানে ঝাঁঝরা হয়েছিল শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসস্থল, জগন্নাথ হলের কক্ষ থেকে শুরু করে ছাদ, মাঠ ভেসেছিলো ছাত্র, কর্মচারীদের রক্তে। এই হলেই ২৫ মার্চ ও পরের দিন মিলিয়ে নিহতদের মধ্যে প্রায় ৭০ জনের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। ট্রেসার বুলেটের আলোয় ফুলার রোড, ইকবাল হল, রোকেয়া হলসহ সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাকিস্তানি সেনারা যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তা ইতিহাসে নজিরবিহীন।
বিশ্বের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য এতো ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের সাবেক পরিচালক এবং শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন।
চ্যানলে আই অনলাইনকে তিনি বলেন: আমার জানা মতে, পৃথিবীতে অন্য কোথাও একটি দেশ, একটি মানচিত্রের জন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে এতো ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে এক রাতে গণহত্যার কেন্দ্রে পরিণত করা হয়নি। ইতিহাসে অনেক ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা আছে, কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গণহত্যা একেবারেই নজিরবিহীন।
’একাত্তরের ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চ লাইটের অন্যতম টার্গেট ছিল তৎকালীন ইকবাল হল (শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)। কারণ অসহযোগ আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ছিল এই হলে। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালায়। সেই রাতে কতজন নিহত হয়েছিলেন তার সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায়নি। ধারণা করা হয় এই সংখ্যা ২ শতাধিক। নিহতদের মধ্যে যাদের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে তাদের নাম হলের তোরণের সঙ্গে থাকা স্বাধীনতা-স্মারকে লেখা আছে।’
সেই রাতে টার্গেট সশস্ত্র বাঙালি ইপিআর, পুলিশরা হলেও মূলত নিধনযজ্ঞের ‘সার্চলাইট’ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে।
দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গনের মতো বেসামরিক স্থাপনা ও জনসাধারণের পর পাকিস্তানি সেনাদের ঝাঁপিয়ে পড়া সম্পর্কে এই বিশেষজ্ঞ বলেন: শুধু ইপিআর-পুলিশের সশস্ত্র বাঙালি সদস্যরা এই তথাকথিত অপারেশনের মূল টার্গেট ছিল না। স্বাধীনতার জন্য যারা সরব, তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে অপারেশনের মূল টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ এখানেই ধারাবাহিকভাবে স্বাধীন দেশের জন্য সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল এবং বিকাশ ঘটছিল। সামরিক কারণে অপারেশন সার্চ লাইটের লক্ষ্যবস্তু পিলখানা, রাজারবাগ হলেও রাজনৈতিক কারণে সার্চলাইট পড়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর।
‘যারা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী দলকে ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে সময়ক্ষেপণ এবং একই সঙ্গে নিধনযজ্ঞের পাঁয়তারা করছিল, তাদের কাছে আসলে কে সামরিক কে বেসামরিক এমন বিবেক ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রামকে নিঃশেষ করতে এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট।’
মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিমূলে আঘাত করতেই অপারেশন সার্চ লাইটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খান ট্যাংক, মর্টার লঞ্চার, মেশিন গান পাঠিয়েছিল বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: পৃথিবীতে মোড় পরিবর্তনকারী সমস্ত ঘটনার পেছনে একটি দার্শনিক ভিত্তি থাকে। তেমনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দার্শনিক ভিত্তির জায়গা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই দার্শনিক ভিত্তি গড়াদের একটি বড় অংশই ছিলেন স্বাধীনতাকামী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে দানা বেঁধে উঠছিল। এজন্যই অপারেশন সার্চ লাইটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টার্গেটে পরিণত হয়েছিল।
অধ্যাপক মেসবাহ মনে করেন, পাল্টা প্রতিরোধ দমন করতে ইপিআর, পুলিশ লাইন্সে গণহত্যা চালানো হয়েছিল। কিন্তু মুক্তিকামী চিন্তাকে ঠেকাতে একমাত্র টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি বলেন: পাকিস্তানি সেনারা সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব অর্থাৎ যেখানে শিক্ষকরা মিলিত হন সেখানে হামলা চালায়। হামলা চালায় ছাত্র রাজনীতির কেন্দ্র মধুর ক্যান্টিনে। ২৬ মার্চ মধুর ক্যান্টিনের মধুসূদনকেও তারা হত্যা করে। তৎকালীন ইকবাল হল অসহযোগ আন্দোলনের সংগঠক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। এই ছাত্ররা সাধারণ মানুষকেও দিক নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। জগন্নাথ হলে প্রগতিশীল ছাত্ররা অবস্থান করতো। গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মতো শিক্ষকরা ছিলেন এই হল সংলগ্ন ভবনগুলোতে। তাছাড়া এই হলের প্রতি আক্রোশের পেছনে ধর্মীয় কারণ তো ছিলই।
২৫ মার্চ গণহত্যার বর্বরতম ক্ষেত্র হয়ে ওঠা জগন্নাথ হলে, তৎকালীন ইকবাল হলে, রোকেয়া হলে নিহতদের সংখ্যা আজও অজানা। হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল ফজলুল হক, সলিমুল্লাহ, মুহসীন ও সূর্যসেন হলে। তবে ক্যাম্পাসজুড়ে থাকা স্তম্ভ, ফলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদদের মধ্যে যাদের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল তাদের নাম চোখে পড়ে।
স্বাধীনতার পর পরই ১৯৭২ সালে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক বাংলা, ওই বছর জগন্নাথ হলের হীরক জয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত ‘বাসন্তিকা’ সংখ্যায় সেই রাতে বেঁচে যাওয়া মানুষদের ভাষ্যে উঠে এসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ মার্চ গণহত্যার বীভৎস বর্ণনা।