মাধবকুণ্ড আর জাফলং এই দুই পর্যটন এলাকায় জীবনে অন্তত একবার না গেলে নাকি সিলেটের একজন মানুষের ‘সিলেটি-জীবন’ পরিপূর্ণতা লাভ করে না। জাফলং-মাধবকুণ্ডের অভিজ্ঞতা না থাকলে বন্ধুদের আড্ডায় ‘স্মার্টনেস’ যেমন দেখানো যায় না, আধুনিক সমাজে পেতে হয় ‘সেকেলে’ পরিচয়ের লজ্জা।
এসব কথা শ্রেফ মজা করেই বলা হোক, কিংবা সিরিয়াস- সিলেট বিভাগ তথা সারাদেশের অন্যতম পরিচিত এই দুটি জায়গা নিয়ে আমার অন্তত ব্যক্তিগত কোন ‘আফসোস’ নেই। কারণ ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে অনেকবারই গায়ে মেখেছি জাফলং এবং মাধকুণ্ডের অপরূপ প্রাকৃতিক রূপলাবণ্য। দু-একজন বাদে আমার বেশিরভাগ বন্ধু-বান্ধবের ক্ষেত্রেও তাই। তবে ওই দু-একজনও বাদ যাবে কেনো? আর তাদের কারণেই বেশ ক’বছর পর এবারের ঈদের ছুটিতে আবারও সাক্ষাত হয়েছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জলপ্রপাত মাধবকুণ্ডের সঙ্গে।
খুব সম্ভবত পাঁচ বছর পর মাধবকুণ্ড দেখেছি এবং এবার গিয়ে সেখানে বেশ কিছু পরিবর্তনও চোখে পড়েছে। সেসব অদল-বদল পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করতেই লিখতে বসা। ঈদ এবং পূজার ছুটি ছাড়াও অবশ্য মাধবকুণ্ডে যাওয়া হয়েছে। তবে যেহেতু বন্ধু-বান্ধবের কেউই এখন আর ছাত্রজীবনে নেই, তাই বেছে নেয়া হয় ঈদের ছুটি।
আমার দুই বন্ধু ফারহানা ও মিলি কেউই এর আগে দেখেনি মাধবকুণ্ডের অদ্ভুত জলধারা। তারা দুজনই আমাদের এবারের সফরের মূল উদ্যোক্তা। মূলত তাদের উৎসাহেই অন্য ব্যস্ত বন্ধুদেরও পাওয়া গেলো সফরসঙ্গী হিসেবে।
জীবনে প্রথম মাধবকুণ্ড দশর্নে অবশ্য মুগ্ধ হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি মিলি-ফারহানার জন্য। উল্টো হিমশীতল জলধারায় ‘তৃপ্তিস্নান’ না করতে পারার হতাশা সঙ্গী হয়েছে তাদের। প্রকৃতির এত কাছাকাছি গিয়েও তাদের এই অতৃপ্তি কিন্তু কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট। আরও সহজভাবে বললে ‘সিস্টেম-লস’।
পাহাড়তলীর আশ্চর্য এই জলপ্রপাত দেখার জন্য দর্শনার্থীরা টিকিট কিনেই ভেতরে ঢুকেন। শিশু-বৃদ্ধ সবারই ভেতরে ঢুকতে টিকিট লাগে। কিন্তু সবাই কি সমানভাবে প্রকৃতির এই অদ্ভুত সৌন্দর্যটাকে দেখার সুযোগ পান? উত্তর হলো: না। কারণ সেরকম কোনো ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষের নেই।
বরং টিকিটের অর্ধেক অংশটা দর্শনার্থীদের হাতে বুঝিয়ে দিয়েই দ্বায়িত্ব শেষ বলে মনে করেন তারা। ভেতরে গিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থায় যে যেভাবে পারে নেমে পড়ে পানিতে। ছেলে-পুরুষ, শৃঙ্খল-উশৃঙ্খল মানুষের অবাধ দাপাদাপিতেই শেষ হয়ে যায় অনেকের ‘ঝর্ণাস্নানের’ স্বপ্ন। সিলেটের চিরায়ত রক্ষণশীলতা ভেঙ্গে নারী-পুরুষের এমন ‘যৌথস্নানে’ অংশ নেয়া সম্ভব হয়ে উঠেনা ফারহানা-মিলিদের।
অথচ চাইলে গোসল করার জন্য বা ঝর্ণার পানিতে যাতে সবাই সমান সুযোগ পায় সেরকম কোন শৃঙ্খল ব্যবস্থা করে দিতে পারে কর্তৃপক্ষ।
বিপদ এখানেই শেষ নয়। প্রায় ২শ ফুট উপড় থেকে ঝর্ণার পানি ঠিক যে জায়টায় পড়ে সেখানটা খুবই বিপদজনক। উপড় থেকে প্রতি সেকেন্ডে ৫শ কিউসেক পানি ঝড়ে পড়ে নিচে। গত ক’বছর পানিতে ডুবে পর পর বেশ ক’টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে যাওয়ায় এখন সেখানে লোহার গ্রিল দিয়ে আলাদা করা হয়েছে।
কিন্তু দর্শনার্থীর সংখ্যায় তা পর্যাপ্ত নয়। আর নিরাপত্তা বলতে এটিই। কিন্তু লোহার ফাঁক দিয়ে অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলে যায় মৃত্যু-কুপের কাছাকাছি। অথচ এই গ্রিলটাই বানানো বা প্রতিস্থাপন করা যেতো আরও পরিকল্পিতভাবে।
আকর্ষণীয় এই জলপ্রপাতকে পুঁজি করে স্থানীয় অনেক ব্যবসা গড়ে উঠেছ এর আশপাশে। ‘পার্কিং ব্যবসা’ এর অন্যতম। মূল আকর্ষণ মাধবকুণ্ড প্রপাতের অন্তত ৩শ গজ বাইরেই আপনাকে পার্কিং-এর টিকিট কেটে ফেলতে হবে। অথচ গাড়ি পার্ক করার মূল যে জায়গাটা সেখানে ত্রিশটির বেশি গাড়ি জায়গা হয়না। অর্থাৎ সরকারি রাস্তায় গাড়ি রাখলেও পার্কিং ফি হিসেবে একটা ‘এমাউন্ট’ আপনাকে বুঝিয়ে দিতে হবে স্থানীয় একটা ‘তরুণ-গোষ্ঠির’ হাতে। সে টাকা বন বিভাগের কোষাগারে যাচ্ছে কি না বা কোথায় যাচ্ছে, কারা সেটা তুলছে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না।
সরকারি বলেই হয়তো অনিয়মই সেখানে নিয়ম হয়ে গেছে। ভেতরেই রয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের একটা রেস্টুরেন্ট। খাবার খেতে গিয়ে সেখানে আপনাকে শুধু ঠকতেই হয়। ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে আকর্ষনীয় মেন্যু বাছাই করবেন ঠিকই, কিন্তু যখন খাবার আসবে সামনে, সঙ্গে আসবে হতাশাও।
একশ নব্বই টাকার চিকেন ঝালফ্রাই অর্ডার দেওয়ার পর যা পরিবেশন করা হলো তা নিতান্তই ‘পুটি’ মাছের সেদ্ধ তরকারি। মুরগীর রানের মাংস খাবেন কিন্তু সাইজে কোনোভাবেই তা পুটি মাছের চেয়ে বড় নয়। আর স্বাদ? সরকারি হাসপাতালে পরিবেশন করা রোগীদের খাবারের স্বাদও হয়তো এর চেয়ে অনেক মজাদার।
গেইটের বাইরে লাইনের পর লাইন পানের দাঁড়িয়ে আছে পানের দোকান। বাহারি মিষ্টি পান বিক্রি হয় এসব দোকানে। সবই মসল্লাযুক্ত পান। আগে অবশ্য খাশিয়া পানের আড়ত হিসেবে পরিচিত ছিলো এ জায়গা। এখন আর পানের ‘বান্ডেল’ নয়, বেশি বিক্রি হয় সিঙ্গেল পানের খিল। দশ টাকা থেকে ত্রিশ টাকায় বিক্রি হয় প্রতি পিস পান। অবশ্য এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে ফেরার পথে ৩০টাকা দামের এক খিল ‘স্পেশাল পান’ শুধু আপনার ঠোটই রাঙ্গাবে না মনটাও ভরিয়ে তুলবে অন্য রকম আনন্দে।
সময়ের বিবর্তনে প্রতিনিয়তই পাল্টে যাচ্ছে সব কিছু। পাল্টানোর দৃশ্যগুলো সহজেই চোখে ধরা পড়ে। আগের মাধবকুণ্ডের সঙ্গে তুলনায় এখনকারটা অনেক বেশি ব্যবসায়িক। কিন্তু আগের চেয়ে বড় বেশি অপেশাদার। দেশের সবচে বড় এই জলপ্রপাত নিয়ে উন্নত কোনো চিন্তা ভাবনাও নেই সরকারের, যা খুবই দুঃখজনক। অথচ পর্যটন শিল্পের বিকাশে প্রতি বছর কাগজে কলমে কিংবা সেমিনারে কত শত পরিকল্পনার কথাই শুনি। কিন্তু পর্যটন এলাকায় গিয়ে নিজ চোখে যা দেখি তা শুধু হতাশই করে, স্বপ্ন দেখায় না।