তুমি আজ কত দূরে…তুমি আজ কত দূরে…। বিখ্যাত এই গানটির মতোই বলতে দ্বিধা নেই-‘সুশাসন’, তুমি আজ কত দূরে…।
সম্প্রতি গাজীপুরে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, সুশাসন থাকলেই বাজারে জিনিসপত্রের দাম স্থিতিশীল হবে।
তার মানে কি দাঁড়ালো স্বয়ং এই সরকারের মন্ত্রীও উপলব্ধি করেছেন সুশাসন নেই কোথাও। সুশাসন শব্দের ব্যাখ্যাটা আসলে কি রকম? কোন জিনিসের কি দাম হওয়া উচিত তা সরকারের যে নজরদারির ব্যাপার থাকা উচিত, তা নেই-এটাই মোদ্দা কথা। তা হলে তো যে যার মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নির্ধারণ করে বিক্রি করবেই। আর সেই সুযোগে পাইকারিবাজার থেকে খুচরা বাজারে চলবে স্বেচ্ছাচারিতা এটাইতো স্বাভাবিক।
যেমনটা ঘটছে গত সেপ্টেম্বর থেকে দেশের পেঁয়াজের বাজারে। ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিল। আর সেই সুযোগে পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল করার জন্য উঠেপড়ে লাগলো কালোবাজারিরা। রাতারাতি পেঁয়াজ সংকটের অজুহাতে লাফিয়ে লাফিয়ে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। পেঁয়াজের দাম বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড করে ফেলল। ৩০০ টাকায় কেনা হয়েছে পেঁয়াজ। অথচ যে পেঁয়াজের দাম হওয়া উচিত সর্বোচ্চ পঞ্চাশ টাকা।
গেল সেই সময়কার কথা। তারপর কি দেখা গেল। সরকার একটু শক্ত অবস্থানে গেল। পত্রপত্রিকায় দেখা গেল অনেক স্থানে পচা পেঁয়াজ ফেলে দেয়া হয়েছে বস্তায় বস্তায়। চট্টগ্রামে পানিতে ভাসতে দেখা গেছে বস্তায় বস্তায় পেঁয়াজ। কেউ কোনো কথা বললো না- কোথায় থেকে এল সেই পেঁয়াজ? অভিযান চালিয়ে কিছু দোকানিকে জরিমানাও করা হয়েছে- কেন বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছে তারা। এই পর্যন্তই।
এরপর পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমলেও আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী একদিন বললেন- পেঁয়াজের কেজি সহজে এক শ টাকার নিচে নামানো সম্ভব না। এই কথা বলার পর আবার ধেই ধেই করে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেল। কে আর থামায় তাকে!
এই হচ্ছে আমাদের ব্যবসায়ী নেতা বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি অবশ্যই ব্যবসা ভালো বোঝেন। একজন ব্যবসায়ী নেতাও তিনি। ব্যবসাটা কে কোন দিক দিয়ে করে নিয়েছে সাধারণ মানুষদের মধ্যে সবাই না বুঝলেও কেউ কেউ ভালোই বুঝেছেন।
এরপর মায়ানমার থেকে বড় বড় পেঁয়াজ এল। টিসিবি সে পেঁয়াজ বাজারে বিক্রি করা শুরু করলো। কিন্তু সেই পেঁয়াজ খুচরা বাজারেও চলে এল। এক শ’ চল্লিশ টাকা করে সে পেঁয়াজ মানুষ কিনতে বাধ্য হয়েছে।
পেঁয়াজের সাথে চালের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। বৃদ্ধি করা হয়েছে আদা চিনি লবনের দাম। কেউ কিছু বলছেও না।
নতুন পেঁয়াজ বাজারে ওঠার পর কিছুটা স্বস্থিতে আসতে শুরু করেছিল। দেশি পেঁয়াজ এক শ’ বিশ টাকা দরে কেনা শুরু করলেও যেই টিপু মুনশি বললেন রোজা উপলক্ষে দু লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানির কথা। সঙ্গে সঙ্গে কৃষিমন্ত্রী পাল্টা বললেন কৃষকের কথা মাথায় রেখে দামের ব্যাপারে।
পরদিনই আশি টাকা বৃদ্ধি করা হলো পেঁয়াজের দাম। এই হচ্ছে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী আর কৃষিমন্ত্রীদের জ্ঞান-গরিমার অবস্থা।
তাদের এত কথা পাবলিকেলি বলার দরকারটা কি? বুঝে আসে না। চুপচাপ তাদের কাজ করলেই সুযোগ সন্ধানীরা আর উছিলা পাবে না দাম বৃদ্ধি করার। বাজারে এখন দেশি পেঁয়াজ দেড় শ’ টাকা। কেন? মাঠে পেঁয়াজের অভাব নেই। কিছুটা কম এ জন্য যে, অনেক কৃষক লাভের আশায় পেয়াজ ছোট থাকতেই উঠিয়ে বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু সেটা কোনো বড় ঘাটতির ব্যাপার না।
গুদামে পেঁয়াজ ভরা। কিন্তু নেই নেই বলে সংকট সৃষ্টি করে কারা কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল কি একজনকেও এখন পর্যন্ত শাস্তি দিতে পেরেছেন? যা দেখে অন্য ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে থাকবে। খামোখা দাম বাড়াতে? পারেনি, কারণ ওই যে শুরুতেই বলেছি সুশাসনএর অভাব। স্বয়ং কৃষিমন্ত্রী বলেছেন একই কথা।
এই সুশাসনের বিষয়টি কে দেখভাল করবেন ? ব্যবসায়ীদের নেতা মন্ত্রী নাকি অন্য কেউ? মন্ত্রী ব্যবসায়ী নেতা হলে কেন সাধারণ মানুষের কথা ভাববেন? কারণ সাধারণ মানুষ তো তাকে ব্যবসায়ী নেতা বানান নি। তাকে ব্যবসায়ীরা নেতা বানিয়েছেন। যে কারণে এখন তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী। কিছু কামানোর রাস্তা তিনি করেই দেবেন- এটাই স্বাভাবিক।
সুশাসন থেকে দেশ আজ কত দূরে.. সেটা বোঝার দরকার আগে।
সাধারণ মানুষের সেই সুশাসন বোঝার দরকার নেই। তারা শুধু ভোটের সময় গিনিপিগ হয়ে ভোট দিতে যাবেন। বাকি কাজ করবে সরকার। তাদের দৈনন্দিন খরচের কথা মাথায় রাখার দরকার কি সরকারে? ভোটের সময় হলে দরদ উছলে পড়বে ব্যাস।
সুশাসনের জন্য যারা সংগঠন করে তাদেরও কোনো মাথা ব্যথা নেই-এই বিষয়ে কথা বলার। তারা জানে রাতে টেলিভিশনের টক শো-তে গিয়ে একটু অভিনয় করে একটা খাম নিয়ে চলে আসবে। পত্রিকায় ছবিসহ বিবৃতি দেবে। ব্যাস হয়ে গেল তাদের ‘দোকান’ খোলার সার্থকতা।
এই যে পেঁয়াজ নিয়ে যে অরাজকতা চলছে দেশে বর্তমানে, একজন বুদ্ধিজীবীও কি বিবৃতি দিয়েছেন? এত এত জাতীয় অধ্যাপক, ইমেরিটাস মানুষ আমাদের সমাজে বিবেকবান বলে পরিচিত। মঞ্চ ঝলমল করেন। তারা কই একটা আওয়াজও তো তারা দিলেন না।
সুশাসন সুশাসন বলে গলা ফাটিয়ে লাভ কি? সরকারের কাছে বিনীতি অনুরোধ, কেন আপনাদের একজন ব্যবসায়ী নেতাকে বাণিজ্যমন্ত্রী বানাতে হবে? কেন একজন ব্যবসায়ী নেতাকে খাদ্যমন্ত্রী বানাতে হবে?
তারা তো কখনো সাধারণ মানুষের কথা ভাববেন না। তারা ভাববেন নিজের আখের গোছানোর কথা।
আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কথা যিনি ভাবতে পারবেন সেই রকমের একজন মানুষকে এইসব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে দেয়া উচিত। যারা বোঝেন
একজন সাধারণ মানুষ ঘন্টার ঘণ্টা লাইনে দাড়িয়ে কতটা যন্ত্রণা নিয়ে ট্রাক থেকে এক কেজি পেঁয়াজ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)