জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জয়ী প্রার্থী সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও মোকাব্বির হোসেনের শপথের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছে সংসদ সচিবালয়। এই ইস্যু নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এবং আইনগত বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে আলোচনা চলছে। দেশের সংবিধান ও আইনে বিষয়টি নিয়ে আসলে কী বলা আছে?
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এবং ৬৬ অনুচ্ছেদের আলোকে অনেকে অনেক ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। ওই দুই অনুচ্ছেদে আসলে কী লেখা আছে?
৭০ অনুচ্ছেদ: কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরুপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি-(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।
৬৬ অনুচ্ছেদ: (১) কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক হইলে এবং তাহার বয়স পঁচিশ বৎসর পূর্ণ হইলে এই অনুচ্ছেদের (২) দফায় বর্ণিত বিধান-সাপেক্ষে তিনি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন।
(২) কোন ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি
(ক) কোন উপযুক্ত আদালত তাহাকে অপ্রকৃতিস্থ বলিয়া ঘোষণা করেন।
(খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হইবার পর দায় হইতে অব্যাহতি লাভ না করিয়া থাকেন;
(গ)তিনি কোন বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন।(ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাহার মুক্তি লাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।
(ঙ) তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগ সাজশ কারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন যেকোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হইয়া থাকেন।
(চ) আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করিতেছে না, এমন পদ ব্যতীত তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন; অথবা
(ছ) তিনি কোন আইনের দ্বারা বা অধীন অনুরূপ নির্বাচনের জন্য অযোগ্য হন।
৩। (২ক) এই অনুচ্ছেদের (২) দফার (গ) উপ-দফাতে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোন ব্যক্তি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হইয়া কোন বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করিলে এবং পরবর্তীতে উক্ত ব্যক্তি-
(ক) দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে, বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ত্যাগ করিলে; কিংবা (খ) অন্যক্ষেত্রে, পুনরায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করিলে- এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধন কল্পে তিনি বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন না।
(৩) এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধন কল্পে কোন ব্যক্তিকে বল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী হইবার কারণে প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলিয়া গণ্য হইবেন না।
(৪) কোন সংসদ-সদস্য তাহার নির্বাচনের পর এই অনুচ্ছেদের (২) দফায় বর্ণিত অযোগ্যতার অধীন হইয়াছেন কিনা কিংবা এই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোন সংসদ-সদস্যের আসন শূন্য হইবে কিনা, সে সম্পর্কে কোন বিতর্ক দেখা দিলে শুনানিও নিষ্পত্তির জন্য প্রশ্নটি নির্বাচন কমিশনের নিকট প্রেরিত হইবে এবং অনুরূপ ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হইবে।
(৫) এই অনুচ্ছেদের (৪) দফার বিধানাবলী যাহাতে পূর্ণ কার্যকর তা লাভ করিতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতাদানের জন্য সংসদ যে রূপ প্রয়োজন বোধ করিবেন, আইনের দ্বারা সেই রূপ বিধান করিতে পারিবেন।
৭০ অনুচ্ছেদের অধিকতর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিষয়টি আসলে শপথ নেয়ার পরের ঘটনার জন্য প্রযোজ্য। লক্ষণীয় যে এখানে “পদত্যাগ করলে” বলা হয়েছে, “বহিস্কার করলে” বলা হয়নি। শপথ না নেয়ার পরেই মূলত প্রশ্ন উঠবে দলের বিপক্ষে ভোটদানের ব্যাপারটা।
এছাড়া ৬৬ অনুচ্ছেদের ৪ দফায় ৭০ অনুচ্ছেদের আলোকে ‘পদ শূন্য হবে কিনা’, সেটা নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠলে সেটার নিষ্পত্তি করবে নির্বাচন কমিশন।
এর বাইরে অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়; যেসব আসনে বিরোধী দলের লোক নির্বাচিত হয়েছে সেসব আসনে ভোট সুষ্ঠু হয়নি এমন ধরা হয় না। ঐক্যজোটের নেতারাও নিশ্চয় বলছে না, ঐ দুটি আসনে ভোট কারচুপি হয়েছে। ভোটারদের মতামত সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ঐ দুটি সংসদীয় এলাকার বেশির ভাগ লোকেরা ভোটের মাধ্যমে জানিয়েছে তাদের প্রতিনিধি হিসাবে তারা সুলতান মনসুর বা মোকাব্বিরকে সংসদে পাঠাতে চায়।মানুষের মতামতই গণতন্ত্র এবং সংবিধানের প্রাধান্য মুখ্য বিষয়; সেখানে কোন আইন বা রিট করতে পারবে কি?
সংসদ নির্বাচিত হয়েছে সংসদে যাওয়ার জন্য এবং ঐ এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। যেহেতু ঐ এলাকার ভোট নিয়ে কোন প্রশ্ন নাই , বিতর্ক নাই তাহলে সংসদীয় গণতন্ত্রে কেন ঐ প্রতিনিধি শপথ নিতে চাইলে আইন বাধা হয়ে দাঁড়াবে? দল মনোনয়ন দিয়েছে প্রতীক দিয়েছে একটা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। সেটা হলো ঐ সংসদীয় এলাকা থেকে তিনি যেন নির্বাচিত হয়ে ঐ এলাকার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। দলের এই মনোভাবতো তারা সফল করেছে এবং নৈতিকভাবেও তারা নিজেরা শপথ নিতে রাজী আছে। তাহলে দলের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত কেন আইন সিদ্ধ হবে?
সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদ মানেই জনগণ। তো জনগণের মালিকানা নিশ্চিতের ইচ্ছায় যারা শপথ নিবেন তাদেরকে কেন আইনের মার প্যাঁচে ফেলে শপথ নিতে বা রিট করা হবে। বিএনপি বা ঐক্যজোটতো এই সরকারকে মেনেই নিয়েছে। এই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যাপারে আলোচনা করতে গেছে, নানাসময় নানা দাবি করছে সরকারের বিভিন্নজনকে উল্লেখ করে। এই অবস্থায় আইনের দোহাই দিয়ে বা শুধুমাত্র বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করে ওই দুই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির শপথে বাধা দেয়া উচিত হবে কি?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)