চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সুভাষ দা’র মুখে শুনি শেখ কামালের কথা

আবাহনীর ক্লাব লিমিটেডের প্রিয় মুখ সুভাষ সোম, আমাদের প্রিয় সুভাষ দা। সেই ৭৪ সাল থেকে ক্লাবের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সে সময় আবাহনীর প্রাণপুরুষ শেখ কামালের হাত ধরেই তিনি ক্লাবের ব্যবস্থাপনা পদে যোগদান করেছিলেন। আবাহনীর ঘাস, ধূলোর সাথে এই মানুষটির আত্মিক ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আজ অব্দি আবাহনীতেই আছেন, ছেড়ে যাননি। আবাহনীর শত সহস্র স্মৃতিময় ঘটনার তিনি প্রত্যক্ষদর্শী, যেনো কালের সাক্ষী। বুকের গহীনে ধরে রেখেছেন কত কথা। তাঁর স্মৃতি জুড়ে বঙ্গবন্ধু, শেখ কামাল, আবাহনীর জয়-পরাজয়সহ নানা ঘটনাবলী। সব যেনো পরতে পরতে ক্রমিক অনুযায়ী সাজানো। অতীত থেকে আজ- ক্লাবের অনেক দুঃখ কষ্টের কথা কেউ না জানলেও তিনি জানেন। আবাহনীর হিসেব-নিকাশ, খরচাপাতি, খেলোয়াড়দের আহার-রুচি থেকে শুরু করে সবকিছুই তাঁকে এখনও নখদর্পণে রাখতে হয়।

শুরু থেকে আজ অব্দি স্মৃতির পাহাড় নিয়ে ঘুরছেন একাত্তর পরবর্তী বরিশালের গৌরনদী থেকে ঢাকায় আসা সুভাষ সোম। তাঁর হাজারো স্মৃতির মাঝে অমলিন বঙ্গবন্ধু পুত্র শহীদ শেখ কামাল। একেবারে তরুণ বয়সে প্রধানমন্ত্রীর সন্তান তারুণ্যদীপ্ত আধুনিক ক্রীড়া সংগঠক শেখ কামালের সাথে পরিচয়, তাঁর আহবানে আবাহনীতে যোগদান, শেখ কামালের স্বপ্নের সারথী হওয়া-এসবতো আর হ্নদয় আঙিনা থেকে মুছে ফেলা যায় না। বরং এসব স্মৃতি নিত্য তাঁকে কাঁদায়, স্মৃতিকাতর করে। শেখ কামাল নিহত হওয়ার কয়েকঘণ্টা আগে শেষ দেখাও হয়েছিল তাঁর সাথে। হ্নদয়ে রক্তক্ষরণ তাই তাঁর সবসময় অনুভূত হয়। তবে বেশি অনুভব করেন ৫ আগস্ট শেখ কামালের জন্মদিনে আর তাঁর মৃত্যুদিবস ১৫ আগস্টে।

৭৫ এর ১৪ আগস্ট রাত ১১টা। শেখ কামাল ধানমন্ডিস্থ আবাহনী ক্লাবে যান। ক্লাব তখন ধানমন্ডি ১৯ নম্বর রোড শঙ্করের ভাড়া করা এক দ্বোতলা বাড়িতে। নিচে অফিস, স্টোর। দ্বোতলাতে খেলোয়াড়েরা থাকেন। সেসময় মারদেকা ফুটবল কাপ টুর্নামেন্ট খেলতে বেশিরভাগ খেলোয়াড় ক্লাব ছেড়ে চলে গেছেন। শেখ কামাল ক্লাবে গিয়ে ম্যানেজার সুভাষ সোমের সাথে নতুন মটর সাইকেল কেনার বিষয়ে আলাপ করেন। চুক্তিবদ্ধ ফুটবলারদের সে সময় মটরসাইকেল দিতে হতো। সুভাষ সোমকে আরও কিছু নির্দেশনা দিয়ে শেখ কামাল ক্লাবপ্রাঙ্গণ ত্যাগ করেন। পরের দিন সকালেই সুভাষ সোম খবর পান বঙ্গববন্ধুসহ শেখ কামাল পরিবারের সব সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। কী করবেন নিজেও বুঝতে পারছিলেন না। সুভাষ সোম জানান, পুরো বিষয় নিয়ে যখন বুঝতে পরছিলেন না কী করবেন, ঠিক এমন অবস্থায় সকালে একটি বাইকে চড়ে সামরিক পোশাকে আবাহনী ক্লাবে আসেন শেখ জামালের বন্ধু লেফটেন্যান্ট কাদের। তিনি বলেন, দ্রুত সবাইকে ক্লাব থেকে চলে যেতে হবে। যে কোনো সময় ফারুক-রশিদের অনুগতরা এসে ক্লাবে হামলা করতে পারে। সুভাষ সোম ক্লাবের বলবয়সহ অন্যান্যদের নিয়ে ক্লাব ত্যাগ করেন। কিছুক্ষণ পরেই কিছু সেনা আসে আবাহনী ক্লাবে। সেনারা আবাহনী ক্লাবের কাগজপত্র নিয়ে যায়, আলমারী ও অন্যান্য আসবাবপত্র ভেঙে ফেলে। শেখ কামালের সাথে শেষ দেখা, ১৫ আগস্ট পরবর্তী দিনের পর দিন নিরাপত্তাহীন থাকা ৭৫ এর সেই ঘটনা আজো ভুলতে পারেননি সুভাষ সোম।

৭৪ সালে শেখ কামাল তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন ক্লাবে। আবাহনী ক্লাবে যোগদানের আগে সুভাস সোম মুক্তিযুদ্ধেও পরপরই এগ্রো ম্যাক নামে একটি কোম্পানীতে চাকরি নেন। এই কোম্পাণীর কর্ণধর ছিলেন আজমল কবীর রুমি এবং আবুল খায়ের লিটু। এ দুজনই ছিলেন শেখ কামালের বন্ধু। এখানে আরও সম্পৃক্ত ছিলেন সাখাওয়াত মোবিন চৌধুরী সাহান এবং কাজী আনোয়ারুল হক তারেক। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে অফিস ছিল। ঐ অফিসেই শেখ কামালের সাথে প্রথম পরিচয় হয় সুভাষ সোমের। একসময় শেখ কামাল তাকে আবাহনী ক্লাবের ম্যানেজার হিসেবে পাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। একসময় তিনি রাজি হন। সুভাষ সোম বলেন, ‘প্রথম দিন শেখ কামাল ভাই আমাকে বত্রিশ নম্বরে তাঁদের নিজস্ব বাড়িতে নিয়ে আসেন। নিচে একটা রুমে যেখানে বসতে দিলেন সেই রুমে দেখি আবাহনীর সব ট্রফি আর কামাল ভাই-এর খেলাধূলোর সরঞ্জাম। বুঝতে বাকি থাকলো না যে এই রুমটি তিনি এ কাজেই বরাদ্দ রেখেছেন। আসলে ঐ দিন আমাকে আরও আশ্বস্ত করার জন্যে তিনি তাঁর নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে সেদিন আমার পা রাখাটাও ছিল স্বপ্নের মতো। ঐদিনই আমি খেলাধূলোর প্রতি তাঁর প্রেম-ভালোবাসা আর স্বপ্নের পরিধি বুঝতে পারি। যতদিন তিনি বেঁচেছিলেন খেলাধূলো, সাংষ্কৃতিক সব কার্যক্রমেই তাঁকে বড় বেশি আমি নিবিষ্ট থাকতে দেখেছি।’

সুভাষ সোম আরও বলেন, তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অকল্পনীয়, ঈর্ষণীয়। অল্প বয়সে আবাহনী ক্রীড়া চক্রের হাল ধরে দ্রতই এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৬। এত ক্রীড়া অন্তপ্রাণ আর চোখে পড়েনি। ক্লাবে আসতেন কখনই প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবে নয়। একেবারে সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে। নেভি ব্লু টিশার্ট ছিল তাঁর পছন্দের। ওটা পরেই আসতেন। সবার সাথে মিশতেন মনেপ্রাণে। উঁচু-নিচু বুঝতেন না। কোনো বৈষম্য ছিল না তাঁর মধ্যে। ছোটদের সাথে আদর মাখা সুরে কথা বলতেন, বড়দের সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। সবসময় গুনগুন করে গান গাইতেন। দেশের ফুটবলের উন্নতি কীভাবে করা যায়-এই ভাবনায় ডুবে থাকতেন। সুভাষ সোম জানান, নীতির প্রশ্নেও তিনি অবিচল থাকতেন সবসময়। এ কারণে সেসময় অনেকেই ক্লাবে ডোনেশন দিতে চাইলও তিনি তা গ্রহণ করেননি। বলেন, একাত্তর পরবর্তীতে মুসলিম লীগ নেতা সবুর খান বহুবার আবাহনী ক্লাবে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য শেখ কামালকে অনুরোধ করেন। কিন্তু শেখ কামাল বরাবরই তা অগ্রাহ্য করেন। বরং ক্লাবের আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে তিনি নতুন নতুন উদ্যোগের কথা ভাবতেন। সেই প্রেক্ষিতেই তিনি একসময় ‘আবাহনী সার্কাস দল’ নামে একটি সার্কাস দল গঠন করেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ বেশ কয়েকটি জায়গাতে সার্কাস শো হয়। সুভাষ সোম সার্কাস দলেরও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে ‘আবাহনী সার্কাস দল’ আর পুনর্জীবিত হয়নি।
সবশেষে সুভাষ সোম বলেন, এদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ধ্রুবতারা হয়ে এসেছিলেন শেখ কামাল। খেলাধূলো যাঁর ছিল ধ্যান-জ্ঞান। আবাহনীর আলোকজ্জ্বল পথের দিশারী তিনিই। ফুটবলকে অনেক উচ্চতায় নিতে চেয়েছিলেন। মানুষটা ছিল ভিন্ন। কিন্তু ঘাতকদের নিষ্ঠুরতার শিকার হন অতি অল্পবয়সেই। এখানেই শেষ নয় তাঁর মৃত্যুর পর নানান অপপ্রচার চালানো হয়। কথিত ব্যাংক ডাকাতির সাথে শেখ কামালের যোগসূত্র বিষয়ে বছরের পর বছর ধরে মিথ্যাচার চালনা হয়েছে। বিরোধীরা বারবার সেই মিথ্যাচারকে পুঁজি করেছে। কিন্তু এই ঘটনা সর্বাংশে মিথ্যা। সত্য ইতিহাস থেকে আড়াল করা যায় না। মানুষ একজন ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রেমিক শেখ কামালকেই জানতে পেরেছে। প্রশ্ন করে বলেন, ‘শেখ কামাল ভাই ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে। তিনি ব্যাংক ডাকাতি কেন করবেন? এটি ছিল পুরোটাই ষড়যন্ত্র এবং অপপ্রচার। তিনি ছিলেন উষ্ণ হ্নদয়ের এক উদার মানবিক মানুষ।’

সুভাষ সোম মনে করেন ৭৫ এ বঙ্গবন্ধুর সাথে শেখ কামালকে হত্যার মধ্যে দিয়ে ক্রীড়াঙ্গনের একটি উজ্জ্বলতমো নক্ষত্রকে হত্যা করা হয়। সেই নক্ষত্র আর কোনোদিন বাংলাদেশের আকাশে উদিত হবে না। সেই নক্ষত্র ক্রীড়াপ্রেমিকদের হ্নদয় আকাশেই থাকবে অনন্তকাল।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)