এক. আমি তাঁকে প্রথম দেখি আজিমপুর ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে ১৯৮৭ সালে। সেটা ছিল চাঁদের হাটের এক সাহিত্য সম্মেলন। সেখানে আরও অনেকেই ছিলেন। প্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলন, শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম, শিল্পী আফজাল হোসেন, ছড়াকার আবদুর রহমান, লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম ও আহমাদ মাযহার, সাংবাদিক-লেখক শাহ আলমগীর (মহাপরিচালক, পিআইবি), সাইফুল ইসলাম (সম্পাদক, যুগান্তর) সহ আরও অনেকে, সবার নাম মনে করতে পারছি না। সেই অনুষ্ঠানে সবাই কমবেশি কথা বললেন।
ইমাম ভাই বরাবরের মতো তার অসাধারণ বক্তৃতা দিয়ে উপস্থিত সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেললেন। মিলন ভাই, আফজাল ভাই, আলমগীর ভাই, সাইফুল ভাইসহ অন্যরা বক্তব্য রাখলেন ঠিকই, কিন্তু তারা সবাই তাদের বক্তব্যে ইমাম ভাইয়ের রেখে যাওয়া বক্তব্যের কথা উল্লেখ করে সবাই প্রায় একরকম অসহায় আর ধরা গলায় বললেন, অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা যেন এরপর থেকে অন্য বক্তাদের ইমাম ভাইয়ের আগে কথা বলার সুযোগ করে দেন। কারণ তাদের সব কথাই নাকি ইমাম ভাই আগে এসে বলে দিয়েছেন।
কিন্তু আশ্চর্য! ফরিদুর রেজা সাগর ভাইকে দেখলাম কথা বলতে। তিনি নিজের মতো করে কম কথায়, অল্প সময়ে তাঁর পরিমিত বক্তব্যে অনেক না বলা কথাই বলে দিলেন। তিনি কিন্তু ইমাম ভাইয়ের কথামালার প্রশংসা করলেন ঠিকই, কিন্তু নিজের গোছানো কথাগুলোও গুছিয়ে গুছিয়ে বলে দিলেন। সেদিন সাগর ভাইয়ের সব কথা হুবহু আজ আর মনে নেই, তবে তাঁর কথার মূল যে অংশ তা আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল: ‘আমাকে আমার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শুধুমাত্র আমার কাজটুকুই করে যেতে হবে’।
দুই. সেদিন চাঁদের হাটের সেই অনুষ্ঠানে আমি একজন নবীন লিখিয়ে হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। তখন দৈনিক খবরের চাঁদের হাটের পাতায় নিয়মিত গল্প লিখতাম। সেই পাতাটা যদিও ইমাম ভাই দেখতেন, কিন্তু এই পাতাকে কিভাবে আরও আকর্ষণীয় করা যায় তার রসদ জোগান দিতেন রিটন ভাই আর টুলু ভাই (আমীরুল ভাইয়ের ডাক নাম)। তখন চাঁদের হাটের পাতাটি কি লেখায়, কি ভাবনায়, কি মেক-আপে ছিল অসাধারণ। তখন দেশে প্রথম এসেছে ফটোকম্পোজ প্রযুক্তি। ফটোকম্পোজের কি এক অদ্ভুত জাদুমন্ত্রে তখন বের হতো ঝকঝকে ছাপার চাঁদের হাটের পাতা! আর সেই পাতায় আমার গল্প যেন আরও বেশি ঝকঝকে হয়ে ছাপা হতো!
তখনকার দিনে বেশ কয়েকটি শিশু পাতায় লেখা ছাপা হওয়া ছিল রীতিমত ভাগ্যের ব্যাপার। তখন যারা এসব পাতার দায়িত্বে ছিলেন তাঁরা সবাই ছিলেন জ্ঞানে, বিদ্যায়, লেখালেখিতে একেকজন দিকপাল (এখন অবশ্য সেসব দিন হয়েছে গত। গত দেড় দুদশকে দেশের পত্রিকা গুলোর শিশুপাতা গেছে রসাতলে…)। তাদের সামনে লেখা নিয়ে যেতে বুকের পাটা থাকতে হতো। তখন দৈনিক বাংলার ‘সাত ভাই চম্পা’, ইত্তেফাকের ‘কচিকাঁচার আসর’, সংবাদের ‘খেলাঘর’- আর সর্বশেষ একানব্বই- বিরানব্বইয়ের দিকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত ‘আসন্ন’ ছিল শিশুকিশোরদের জন্য তাক লাগানো পাতা। এসব পত্রিকা আর পাতায় নিজের গল্প ছাপা হলে লেখক হিসেবে শুধু বেঁচেবর্তেই যেতাম না, গৌরবও অনুভব করতাম।
তিন. আমার প্রথম গল্প ছাপা হয়েছিল দাদাভাইয়ের কচিকাঁচার আসরে ১৯৮৬ সালে। তারপর ইমাম ভাই, রিটন ভাই, টুলু ভাইদের নিবিড় সান্নিধ্য, সাহচর্য পেয়েছি। তখন আমি থাকি আমার নানি বাড়িতে, আজিমপুর কলোনিতে। চায়না বিল্ডিঙের পাশেই ছিল আমাদের দুই নাম্বার বিল্ডিং। বাবা-মা মারা যাবার পর আমরা– অনেকগুলো ভাইবোন– খড়কুটোর মতো ভাসতে ভাসতে এক সময় আমাদের ঠাঁই মিলেছিল নানির বাড়ি। এতটুকু ছোট্ট দুই রুমের এক বাসায় আট মামা খালাদের সঙ্গে আমরা এতগুলো মানুষ! আজিমপুর কলোনিতে থাকার সময়গুলো খুব এলোমেলো ছিল আমার। সারাদিন আড্ডাবাজি, নিজের মতো করে ঘুরে বেড়ানো। এরমধ্যে আমাদের ভাইবোনদের জীবনে ঘটল এক মারাত্মক দুর্ঘটনা। আমার ভাই রুমিটা একদিন নিজের সঙ্গে নিজে অভিমান করে জীবন থেকে পালিয়ে গেল। রুমি মারা যাবার পর সবাই আমার দিকে কেমন একটা মায়াময় দৃষ্টি নিয়ে তাকায়- আমি তা বুঝতে পারি কিন্তু কিছু বলি না। রুমি ছিল আমার পিঠা-পিঠি। সব মিলিয়ে তখন সত্যি সত্যি আমার চলছিল এক অস্থির সময়। সারাক্ষণ নিজের মধ্যে থাকি, নিজের মধ্যে নানা কিছু আঁকি, নিজের মধ্যে হেলায়-অবহেলায় বড় হয়ে উঠছি।
এর মধ্যে নিজের না বলা কথা লিখে জানিয়েছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে । এক সপ্তাহের মধ্যে দেখি আমাদের কলোনির ঠিকানায় আমার নামে এসেছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠি! চিঠিতে সুনীল গাঙ্গুলি আমাকে লিখেছেন, ‘ মাহবুব, জীবনে হতাশা থাকবেই কিন্তু মনে রেখো এই জীবনে যত দুঃখকষ্ট, পাওয়া না পাওয়া সবই এই এক জীবনে’…
চার. কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়া দারিদ্র আর একঘেয়ে রোগে রুগ্ন আমি তখন নিজের মতো করে জীবন দেখি। সব কিছুতে এক ধরনের ভালো না লাগা ব্যাপার কাজ করে সারাক্ষণ। কিন্তু ফরিদুর রেজা সাগর যাকে আমি চিনি না, জানি না সেদিন কেমন করে তিনি যেন আমার মধ্যে এক ধরনের আলোড়ন তৈরি করে দিয়েছিলেন। তিনি চাঁদের হাটের অনুষ্ঠানে একেবারে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রেখেছেন, কিন্তু যে কটা কথা বলেছেন তা আমাকে রীতিমত কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে। আমি সত্যি সত্যি সাগর ভাইয়ের সেদিনের কথা শুনে ভেতরে ভেতরে ভীষণভাবে আলোড়িত হয়েছিলাম। তিনি যে কথাগুলো সেদিন বলেছিলেন সে কথাগুলো যেন অল্পবয়সে পিতৃমাতৃহীন হয়ে ঠাঁই ঠিকানা হারিয়ে নানি বাড়িতে আশ্রয় নেয়া এক কিশোরকে নিজের ভেতর জাগিয়ে তোলার এক সাহসী মন্ত্র উচ্চারণ। আমি ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলের হল ঘরের ভেতর তাঁর কথা শুনে একা একা প্রথমবারের মতো শক্ত ভিতের সন্ধান পাই: আমাকে আমার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শুধুমাত্র আমার কাজটুকুই করে যেতে হবে।
পাঁচ. এরপর জীবন জীবিকার জন্য জীবনের দীর্ঘ সময় নানা পেশায় দলিত হয়েছি, মথিত হয়েছি। আহা! কি যে অপার আনন্দ ছিল সেইসব দলিত মথিত হওয়ার দিনে! পৃথিবীতে সব কিছুতে উপভোগ করার মানসিকতা তৈরি করতে পারলে খারাপ হয় না। আমি সেইদিকে সব সময় খেয়াল রাখতাম। সব কিছু থেকে নিজের আনন্দটা বের করে নিতে পারার বিষয়টা আমার মধ্যে নিরন্তর কাজ করে। সাংবাদিকতা, বীমা কোম্পানি, বাংলাদেশ টেলিভিশনে অনুষ্ঠান নির্মাণসহ স্ক্রিপ্ট লেখা, এনজিও, সম্পাদনার কাজ, বানান সমন্বয়ের কাজ, যথাযথ সম্মানীর বিনিময়ে নির্বিকারভাবে অন্যের বই লিখে দেয়া, সরকারি চাকুরি, দীর্ঘকাল বিদেশ বিভূঁই- এক জীবনে অনেক কিছুই দেখা হলো। এর মধ্যে সব সময়ই আমি কিছু মানুষের কথা, কিছু মানুষের অপ্রত্যাশিত ভালোবাসা, কিছু মানুষের অবহেলা-উপেক্ষাকে ভক্তি সহকারে মান্য করে চলেছি। জীবন চলার পথে এঁরাও তো আমাকে কতভাবেই না শিখিয়েছেন! কতভাবে ঋণী করে তুলেছেন!
ছয়. পরবর্তীকালে সাগর ভাইয়ের সঙ্গে পরিচিতি নিবিড় হয়েছে। এখনো ফোন করলে সাগর ভাই ধরেন। সাগর ভাই যে ভীষণরকম ব্যস্ত থাকেন তার মধ্যে আমার ফোন ধরেন দেখে মন ভালো হয়ে ওঠে। তিনি এত ভয়ানক রকমের ব্যস্ত থাকেন যে আমার মতো একজন মানুষের ফোন না ধরলে পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সাগর ভাই ফোনটা ধরেন- এখানেই তিনি সাগর ভাই। এখানেই তিনি অনন্য।
সাগর ভাই অজস্র ধরনের লেখা লিখেছেন। এখনো লিখছেন। তাঁর রয়েছে প্রচুর ভক্ত। তবে তাঁর লেখার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি তাঁর মতো করে তাঁর দেখার জগত নিয়ে লেখেন। বানানো বিষয় নিয়ে লেখেন না। তিনি আমার প্রিয় লেখকদের একজন। আমি তাঁর লেখা পড়ি। তবে তার চেয়েও বেশি যেটা করি সেটা হলো, দূর থেকে পড়ি তাঁকে। আজ আমার কিশোর বয়সে, আমার একা একা থাকার প্রাণপণ বেঁচে থাকার সংগ্রামে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন যিনি– সেই প্রিয় মানুষ, প্রিয়জন ফরিদুর রেজা সাগরের জন্মদিন আজ।
সাগর ভাই, জন্মদিনে আপনার প্রতি আমার ঋণটুকু স্বীকার করছি। সেদিন আপনার কথা শুনে আমি অমনভাবে আলোড়িত না হলে আমার তো অনেক কিছুই দেখা হতো না, শেখা হতো না।