১৯৯৪ সালে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’ হয়ে উঠা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব থেকে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির সর্বময় নেতা হয়ে ওঠার ইতিহাস এবং তার স্মারক স্মৃতি। জাতির ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার স্মৃতিও বহন করে চলেছে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠা বাড়িটি। বঙ্গবন্ধুর সকল স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য বাড়িটিতে নির্মাণ করা হয়েছে আরও একটি চারতলা ভবন।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নিয়ে মধুমতি নদীর ঘোলাজলে গ্রামের ছেলেদের সাথে সাঁতার কাটা, দল বেঁধে হা-ডু-ডু, ফুটবল আর ভলিবল খেলা দস্যি বালকদের নেতা ‘খোকা’ হয়ে উঠেছিলেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। গ্রামের মানুষের ‘মিয়া ভাই’ এবং শহুরে বাঙালিদের ‘মুজিব ভাই’ তার ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের গুণে অবহেলিত, নিপীড়িত বাঙালি জাতিকে পরম আরাধ্য স্বাধীনতা এনে দিয়ে বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির জনক হিসেবে।
কিন্তু ‘কোন বাঙালি তার বুকে গুলি চালাতে পারে না’ আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান শেখ মুজিবকে তারই কিছু রাজনৈতিক সহকর্মীর বিশ্বাসঘাতকায় কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে সপরিবার খুন হতে হয় তার ধানমণ্ডির নিজ বাড়িতেই।
ধানমণ্ডি লেকের পাড় ঘেঁষা তিন তলা ওই বাড়ি। ১৯৬১ সাল থেকে আমৃত্যু নিজের এই বাড়িতেই গোটা পরিবার নিয়ে থেকেছেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবার বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই বাড়িটিই ছিল জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দও বিভিন্ন সময়ে এখানে সাক্ষাৎ করেছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার প্রায় ছয় বছর পর ১৯৮১ বাড়িটি বুঝে পান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবনের বিভিন্ন পর্যায় ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টায় অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের গ্যালারিগুলোকে। বৃহস্পতিবার থেকে মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকা জাদুঘরের প্রবেশমূল্য ৫টাকা। জাদুঘরে ঢুকেই লিফটের সাহায্যে দর্শনার্থীদের সোজা চলে যেতে হবে নতুন ভবনের চতুর্থ তলায়। এখান থেকেই শুরু।
চতুর্থ তলায় গিয়ে গ্যালারিতে ঢুকতেই চোখে পড়বে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন বক্তৃতায় করা বঙ্গবন্ধুর স্মরণীয় উক্তিগুলো। তারপরে পর্যায়ক্রমে সাজানো বঙ্গবন্ধুর শৈশব স্মৃতি। টুঙ্গিপাড়ার পৈতৃক বাড়ি, গিমাডাঙ্গা ও মিশনারি স্কুল, ফুটবল হাতে বন্ধুদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছবি। আরেকটু সামনে যেতেই চোখে পড়বে তার ইতিহাসের পাতায় উঠে আসা ছাত্রজীবনে রাজনীতির বিভিন্ন পর্যায়ের স্মারক, ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪’র যুক্তফ্রন্ট গঠন, ‘৬৬’র ছয় দফাসহ স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন সংগ্রামের বিভিন্ন ইতিহাসের স্মারক।
তৃতীয় তলাকে সাজানো হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে। ১৯৭০ সালের নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, মুজিবনগর সরকার গঠন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রসহ পত্রিকার পাতায় উঠে আসা বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম এবং বক্তব্য-বিবৃতির ইতিহাস। রয়েছে বাঙালির বিজয় এবং বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিভিন্ন ছবিও।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর সরব উপস্থিতি তুলে ধরতে ২য় তলাটিকে সাজানো হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে। এখানে রয়েছে তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে তার রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত বৈঠক, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্মেলনে যোগদান, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন বাংলায় ভাষণ দেওয়ার আলোকচিত্র। এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর পাসপোর্টটিও।
নতুন ভবনে প্রদর্শিত বঙ্গবন্ধুর শৈশব, ছাত্ররাজনীতি জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্য দেখা শেষ করার পরই আসলে শুরু হয় আসল পর্য। এই পর্বের পরতে পরতে জড়িয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু নিজে।
নীচতলায় যেতেই প্রথমে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর বৈঠকখানা। এখানে বসে তিনি জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছাড়াও বৈঠক করতেন দলীয় ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের সঙ্গে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গেও কথা বলতেন এখানে বসে। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের বড় বড় দুটি ছবি টাঙানো হয়েছে বৈঠকখানার ভেতরে।
সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই থমকে যেতে হয়। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গুলির দাগ, রক্তের ছিটা, রক্তমাখা জামাকাপড়। একটু এগোতেই দোতলা থেকে নীচে নামার মূল সিঁড়ি। এই সিঁড়িটিই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে কলঙ্কজনক ঘৃণ্য এক অধ্যায়ের। ঘাতকের বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে এখানেই পড়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মহান স্বাধীনতার স্থপতির রক্তের দাগ এখনও লেগে আছে সেখানে। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর ঠিক যে জায়গাটি তিনি পড়েছিলেন সেখানে সেখানে নীরবে-নিভৃতে শোভা পাচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। যে পতাকার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই কালরাতে এই বাড়িতে ঘাতকের হাতে নিহত হন, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্ণেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক।
প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে হত্যা করে শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্তসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খান।
বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় সে সময় প্রাণে বেঁচে যান।
বঙ্গবন্ধুর রক্তমাখা পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি, মৃত্যুর পড় তাকে জড়িয়ে রাখা কাপড়, দাফনের আগে তাকে গোসল করানোর পর যে তোয়ালে দিয়ে তাকে মোছানো হয়েছিল সেই তোয়ালে, তার মৃতদেহ বহন করা কফিন সবকিছু সংরক্ষণ করা হয়েছে সিঁড়ির পাশের কক্ষটিতে যেটি ছিল বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানার থাকার ঘর।
নিজে ইট বিছিয়ে, দেয়ালে পানি দিয়ে সন্তানদের নিয়ে কাজ করে পরম মমতায় যিনি এই বাড়িটি গড়ে তুলেছিলেন সেই বেগম মুজিবের রক্তাক্ত শাড়িটিও সংরক্ষণ করা হয়েছে কক্ষটিতে। রয়েছে পরিবারের নিহত প্রায় সবারই কোন না কোন স্মৃতি।
বর্বর এ হত্যাকাণ্ডের বিচার পদে পদে বাধা মুখে পড়ে। ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশের কারণে বিচার শুরু করা যায়নি দীর্ঘ সময়। তাই হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর দায়মুক্তি আইন বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। একই বছরের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ জনের মধ্যে পাঁচজন সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মুহিউদ্দিন আহমদ (আর্টিলারি), বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিনের (ল্যান্সার) ফাঁসি কার্যকর হয়েছে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে।
বাকি সাতজনের মধ্যে এম রাশেদ চৌধুরী, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, মোসলেমউদ্দিন ও আব্দুল মাজেদ বিদেশে পালিয়ে আছেন। আব্দুল আজিজ পাশা পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ৪২ তম শাহাদাৎ বার্ষিকীর আগের দিন বুধবার ৩২ নম্বরে গিয়ে দেখা গেল জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে পুরো এলাকা নিরপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে। চলছে শোক দিবস পালনের প্রস্তুতি। ১৫ আগস্ট প্রথম প্রহর থেকেই জাতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের নিহত সদস্যদের।