মহান আল্লাহ তা‘আলা। যিনি মানব-জ্বীন, আসমান-জমিন, চন্দ্র-তারকা ইত্যাদি ইত্যাদি সৃজন করেছেন। তবে আল্লাহ তা‘আলা কেবল মানুষ ও জ্বীন জাতিকে তাঁর ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। যেমনটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলছেন, “আমি জ্বীন ও মানব জাতিকে কেবল আমার ইবাদত করার জন্য সৃজন করেছি” (যারিয়াত : ৫৬)।
আমরা যদি আমাদের জাগতিক নিয়ম-নীতির দিকে লক্ষ্য করি আরো পরিষ্কার হবো। সাধারণতঃ যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ছেন, তার মূল উদ্দেশ্য থাকে দেশের একজন ‘প্রসিদ্ধ সাংবাদিক’ হওয়া, যিনি কম্পিউটার নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নিচ্ছেন, তার উদ্দেশ্য থাকে ভালো মানের একজন ‘কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ হওয়া। অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তির প্রত্যেক কাজের পেছনে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে। তাহলে আল্লাহ তা‘আলা অহেতুক কেন মানুষ সৃষ্টি করবেন? বরং প্রতিটি কাজ মানুষের উপর আরোপের পেছনে এক বা একাধিক উদ্দেশ্যকে সংরক্ষণ করেন। পবিত্র কুরআনুল কারিমে ঘোষিত হয়েছে, “মানুষ কি মনে করে, তাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ছেড়ে দেয়া হবে?” (কিয়ামা: ৩৬)। আরো এসেছে, “তোমরা কি ভেবেছো তোমাদের অহেতুক সৃষ্টি করেছি?” (মুমিনুন : ১১৫)।
দয়াময় আল্লাহ তা‘আলা সিয়াম তথা রোজাকে ফরজ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং এর হুকুমটি জারি করেছেন। আমরা সকলে জানি, ইসলামের ৫টি বুনিয়াদী বিষয় তথা ফরজ কাজের মধ্যে সিয়াম বা রোজা হল একটি। পবিত্র কুরআনে এসেছে, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা খোদাভীতি অর্জন করতে পারো” (বাকারা : ১৮৩)।
আল্লাহর হুকুমকে তামিল করার জন্যই ঈমানদার-মুমিনগণ রোজা পালন করে থাকেন। অন্যদিকে রোজাকে বিজ্ঞান সম্মত বলেছেন আধুনিক বিজ্ঞানীগণ। সব মিলে আল্লাহ রোজাকে ফরজ করেছেন মানুষকে কষ্ট দেওয়ার জন্য নহে, বরং সফলকাম করার জন্য। কুরআনে ঘোষণা হয়েছে- “আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কোনো কাজ চাপিয়ে দেন না। সে যা ভালো কাজ করেছে তার ফল পাবে এবং যা খারাপ করেছে তার ফল তারই” (বাকারা : ২৮৬)।
মুসলমানদের উপর সিয়াম সাধনার কার্যাদেশের পেছনে দু’ধরনের উদ্দেশ্য পরিলক্ষিত হয়। প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য ও পরোক্ষ উদ্দেশ্য। আর প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্যসমূহ হলো-
(১) তাকওয়া অর্জন: মহান আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং কুরআনে বলছেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা খোদাভীতি অর্জন করতে পারো” (বাকারা: ১৮৩)। তাকওয়া মানে আল্লাহর ভয়। আল্লাহর ভয় একজন মানুষের ভেতর থাকলেই, সেই মানুষটি কোনো দিন বা কোনো সময় অন্যায়, অপরাধ, নিষিদ্ধ কাজ, পাপাচার, চুরি বা শরিয়ত- বিরোধী কোন কাজ করতে পারে না। মুসলমান ইফতারের সময় প্রচুর ক্ষুধার্ত থাকেন, সামনে রকমারি ইফতার সামগ্রী, কিন্তু একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাকে ভয় করার কারণেই সূর্য অস্ত যাওয়া তথা মাগরিবের আযানের পূর্ব পর্যন্ত ভক্ষণ করছে না। এটা তাকওয়ার এক উজ্জ্বলতর উদাহরণ।
(২) কুরআনময় জীবন গঠন: মাহে রমজানে মুসলমানগণ সিয়াম পালন করে থাকেন, অন্যদিকে এই মাহে রমজানেই পবিত্র কুরআনুল কারিম নাজিল হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলছেন, “এই সেই রমজান মাস, যাতে নাজিল হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের দিশারি এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী” (বাকারা: ১৮৫)। কুরআন নাজিল করে আল্লাহ পাক মানুষকে সত্যের রোডম্যাপ প্রদান করেছেন। আর কুরআন অনুযায়ী জীবন-যাপন তথা কুরআনময় জীবন হলেই একজন মানুষ নিজেকে সফল দাবি করতে পারবে।
(৩) ইবাদতে সময় বৃদ্ধি করা:ধ বান্দার কাজ বন্দেগী করা, গোলামের কাজ গোলামী করা। মাহে রমজানে আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দা তথা গোলামদেরকে বন্দেগীর বিনিময় কয়েক দফায় বৃদ্ধি করে দেন। একটি ভালো কাজের বিপরীতে ১০-৭০০ গুণ পর্যন্ত বিনিময় প্রদান করা হয়ে থাকে। আর এ কারণে বান্দারা ইবাদত-বন্দেগীতে অধিক ব্যয় করে থাকেন।
আর সিয়াম সাধনার পরোক্ষভাবে কিছু উদ্দেশ্য আমরা খুঁজে পাই। অনাথ, গরীব, ফকির, মিসকিন তথা এ জাতীয় লোকজনের কষ্টের বাস্তবতা আমরা সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অনুভব করতে পারি। ধৈর্যের একটি অনুশীলন মঞ্চায়িত হয় মাহে রমজানে। শরীরে সারা বছর একটি নীতিতে খাদ্য প্রদান করে এসেছি, মাহে রমাদানে আমরা ভিন্ন রীতি অবলম্বন করে খাদ্য প্রদান করি, এতে বৈজ্ঞানিকভাবে বহু উপকারিতার কথা বর্ণিত হয়েছে।
প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমাকে এমন একটি কাজের নির্দেশ দিন, যার দ্বারা আমি লাভবান হতে পারি। তিনি বললেন, “তুমি রোজা রাখো, কেননা এর সমকক্ষ আর কোনো ইবাদত নেই” (নাসায়ী শরীফ)। মূলত আল্লাহ তার বান্দাদেরকে সিয়াম সাধনা কর্ম আরোপিত করার মাধ্যমে একটি সুমহান মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে চান।
আসুন, সিয়াম সাধনাকে কেবল আল্লাহর হুকুম মনে করে, মানবজীবনে তা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করি। তাহলেই দুনিয়াতে শান্তি ও পরকালে মুক্তি নিশ্চিত হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফিক দান করুন, আমিন।