রমজান মাসে রোযা পালন ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধান। এ ফরজটি যথাযথভাবে আদায় করার জন্য রয়েছে কতিপয় শর্ত শরায়েত। যার অনুপস্থিতিতে কখনো রোযা ভঙ্গ হয়, আবার কখনো রোযার মৌলিক উদ্দেশ্য বিনষ্ট হয়। যদি কখনো রোযা ভঙ্গ হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে কাজা কিংবা কাজা ও কাফফারা উভয়টির আদায় আবশ্যক হয়ে পড়ে। রোযার কাজা বলতে বোঝায়, ভঙ্গ হওয়া বা ছুটে যাওয়া সেই রোযাটি রমজান ব্যতীত অন্যকোনো মাসে আদায় করে দেয়া। আর কাফফারা হলো ধারাবাহিক (মাঝখানে গ্যাপ না দিয়ে) ৬০ দিন রোযা রাখা, অথবা ৬০ জন মিসকিনকে দু’বেলা পেটপুরে খাইয়ে দেয়া। (ফতোয়ায়ে রেজভিয়া, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৫৯৫)।
রোযাভঙ্গের কারণসমূহ
১. খানাপিনা, সহবাসের কারণে রোযা ভঙ্গ হয়। তবে যদি তখন রোযাবস্থায় থাকার কথা স্মরণে থাকে। এমতাবস্থায় কাজা ও কাফফারা উভয়টিই আদায় করতে হবে। (বাহারে শরিয়ত, খণ্ড: ৫ম, পৃষ্ঠা: ১০১, ১০৭)। সুবহে সাদিক হওয়ার পরবর্তী সময়ে সুবহে সাদিক আসে নি মনে করে সহবাস, খানাপিনার কারণে বা জবরদস্তির শিকার হয়ে রোযা ভেঙে ফেললে কাজা আদায় করা লাগবে। (আদ দুররুল মুখতার, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৪৩০ ও ৪৩৬)
২. হুক্কা, সিগারেট, তামাক সেবনের ফলেও রোযা ভঙ্গ হয়। পান, চিনি খেলেও ভেঙে যাবে। (বাহারে শরিয়ত, খণ্ড: ৫ম, পৃষ্ঠা: ১০১)
৩. ঐসকল চিনিজাতীয় বস্তু খেলেও রোযা ভেঙে যাবে, যা মুখে রাখলে গলে ভেতরে চলে যায়। (বাহারে শরিয়ত, খণ্ড: ৫ম, পৃষ্ঠা: ১০২)
৪. ছোলা পরিমাণ বা তারচেয়ে বড় বা সামান্য ছোট কোনো বস্তু মুখে রেখে গিলে ফেললে রোযা ভঙ্গ হবে। (আদ-দুররুল মুখতার, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৪২২)
৫. রোযাবস্থায় দাঁত ফেললে যদি রক্ত বেরিয়ে কণ্ঠনালি পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তাহলে রোযা ভেঙে যাবে এবং কাজা আদায় করতে হবে। যদিও এমনটা ঘুমন্ত অবস্থায় হয়। (রদ্দুল মুখতার, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৪২২)
৬. কুলির পানি যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে কণ্ঠনালি পর্যন্ত পৌঁছে যায় কিংবা নাকে পানি দিতে যেয়ে তা মস্তিষ্কে পৌঁছায়, তাহলে রোযা ভঙ্গ হবে। তবে তা সেক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, যদি রোযাবস্থায় থাকার কথা স্মরণে থাকে। (আলমগীরী, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২০৪)
৭. ঘুমন্ত অবস্থায় কিছু পান করলে, খেয়ে ফেললে কিংবা মুখ খোলা থাকার কারণে পানির ফোটা কণ্ঠনালি পর্যন্ত পৌঁছে গেলে রোযা ভাঙবে। (আলমগীরী, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২০৪- আল জাওহারাতুন নাইরাহ, পৃষ্ঠা: ১৭৮)
৮. চোখের অশ্রু মুখে নেমে যাবার পর গিলে ফেললে তা যদি এক দুই ফোটার অধিক হয় এবং সেটির লবনাক্ত স্বাদ অনুভূত হলে রোযা ভেঙে যাবে। ঘামের ব্যাপারেও অনুরূপ বিধান। (আলমগীরী, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২০৩)
৯. স্ত্রীকে চুম্বন, স্পর্শ, মিলন করলে কিংবা আলিঙ্গনের পর বীর্যপাত ঘটে গেলে রোযা ভেঙে যাবে। (আলমগীরী, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২০৩)
১০. রোযাবস্থায় থাকার কথা জেনেও ইচ্ছাকৃতভাবে মুখভর্তি বমি করলে সাধারণত রোযা ভেঙে যায়। এমনকি তা মুখভর্তি না হলেও। তবে এমনটি অনিচ্ছাকৃত হয়ে থাকলে ভঙ্গ হবে না। (আদ দুররুল মুখতার, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৪৫০)। অনিচ্ছাকৃত হবার পর রোযা ভেঙে গেছে মনে করে কিছু খেয়ে নিলে কাজা আদায় করা আবশ্যক। অনুরূপ বিধান অনিচ্ছাকৃত খানা-পিনা, সহবাস পরবর্তী কিছু খেয়ে ফেলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। আর রোযা ভাঙে নি– জেনেও খেয়ে ফেললে কাজা ও কাফফারা দুটোই আদায় করতে হবে। (আদ দুররুল মুখতার, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা:৪৩১ এবং রদ্দুল মুখতার, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৪৩১)।
১১. পানাহারের কাজ করে এমন ইনজেকশন গ্রহণ করলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। শরীরের শক্তিবর্ধক গ্লুকোজ জাতীয় ইনজেকশন ব্যবহারে রোযা ভঙ্গ হবে। কেননা খাবার যেই কাজ করে এক্ষেত্রে অনেকটা একই কাজ করছে এটি। তবে শুধুমাত্র অপারগতায় চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ইনসুলিন, পেনিসিলিন জাতীয় ইনজেকশন নেওয়া হয়, তাহলে রোযা ভঙ্গ হবে না।
১২. মহিলাদের হায়েয বা নিফাস হলে অর্থাৎ মাসিক রক্তস্রাব শুরু হলে অথবা সন্তান প্রসব করলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে পরবর্তীতে রোযা কাজা করে নিতে হবে।
রোযার মাকরুহসমূহ
১. মিথ্যা বলা, চোগলখোরি, গীবত, গালি দেয়া, অনর্থক কথাবার্তা, কাউকে কষ্ট দেয়া– ইত্যাদি যা শরীয়তে নাজায়েজ ও হারাম, এমন কাজগুলো করার কারণে রোযা মাকরুহ হয়। (বাহারে শরীয়ত, খণ্ড: ৫, পৃষ্ঠা: ১১০)
২. অকারণে কিছু চেখে দেখা বা চিবিয়ে নিলে মাকরুহ হবে। (আদ দুররুল মুখতার, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৪৫৩)। যদি স্বামী বদস্বভাবের হয়। আর তরকারি মজাদার না হলে অত্যাচার করে তাহলে রোযা অবস্থায় স্ত্রী তরকারির স্বাদ চাখতে পারবে। তবে চাখার সাথে সাথে থুতু নিক্ষেপ করে ফেলে দিবে। (ফাতাওয়ায়ে কাযীখান, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৯৭- ফাতাওয়ায়ে হক্কানিয়া, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ১৫৬- আলমগীরী, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১৯৯)
৩. রোযাবস্থায় স্ত্রীকে চুম্বন, জড়িয়ে ধরা এবং শরীর স্পর্শ করা মাকরুহ৷ যদিও বীর্যপাত ও সহবাসের আশংকা থাকুক বা না থাকুক। এছাড়া স্ত্রীর জিহ্বা বা ঠোঁটে চুম্বন করাও মাকরুহ। (রদ্দুল মুখতার, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৪৫৪)
৪. রোযা অবস্থায় টুথপেষ্ট/ মাজন ব্যবহার করা মাকরূহ। টুথপেষ্টের কোন অংশ পেটের ভিতর চলে গেলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। (আহসানুল ফাতাওয়া, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ৪২৯)
৫. গরগরাসহ কুলি করা এবং নাকে অধিক পরিমাণে পানি পৌঁছানো। (আলমগীরী, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১৯৯-২০০)
৬. অধিক পরিমাণে থুথু মুখে জমিয়ে রেখে গিলে ফেলা অপছন্দনীয় কাজ। এরফলে রোযা মাকরুহ হবে। (আলমগীরী, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১৯৯)
৭. অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে যদি পূর্বে থেকেই রোযা ভাঙনের প্রবল ধারণা থাকে, এমন পরিশ্রমে রোযা মাকরুহ হয়ে থাকে। (দুররুল মুখতার, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৪৬০)
৮. শেষ সময়ের দিকে সাহরী খাওয়া মুস্তাহাব। কিন্তু সেটা যদি এত দেরীতে হয় যে, সকাল হয়ে যাবার শংকা জাগে, এক্ষেত্রেও মাকরুহ হবে। (আলমগীরী, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২০০)
৯. যেকোনো প্রকারের অশ্লীলতায় লিপ্ত হওয়া মাকরুহ। (রদ্দুল মুখতার, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৪৫৪)
১০. গোসল ফরজ হয়েছে, এমন অবস্থায় নাপাক থেকে সারাদিন অতিবাহিত করলেও মাকরুহ হবে।
১১. ঠোটে লিপিস্টিক লাগালে যদি মুখের ভিতর চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে তাতে মাকরুহ হবে।
উল্লেখ্য যে, রোযা মাকরুহ হয়ে গেলে কাজা ও কাফফারার কোনোটিই দিতে হয় না। তবে এটি অপছন্দীয় কাজ বলে রোযার সওয়াবে কমতি আসবে।