গত এক ঘণ্টা সমাজ বই নিয়ে বসে আছে নজির। ক্লাস ফাইভে পড়ে সে। গত তিন বছরে অনেক কিছু বদলে গেলেও নজিরের ক্লাস বদলায়নি। গণিতের সাথে শত্রুতা তার বহুদিনের। ক্লাস ফোর পর্যন্ত তবু এর ওর খাতা দেখে, অঙ্ক মুখস্ত করে…TTP. মানে টেনেটুনে পাস করেছে।
আজকের সন্ধ্যায় সমাজ বই নিয়ে বসার পেছনে কারণটা ভয়াবহ। মা খুন্তি নিয়ে ঘুরছেন। তেল-মশলা মাখানো গরম খুন্তি। একবার রান্নাঘরে যান, আবার ফিরে এসে দেখেন নজির কি করছে।
বইয়ের একটা লাইন গত এক ঘণ্টায় কম করে দুইশ বার পড়েছে সে। ‘‘এ্যা এ্যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ…এ্যা এ্যা বিনোদনের অভাব’’
এবার পড়ার সময় নিজেই একটু থামে নজির।
‘আচ্ছা আঙ্কেল, সিনেমা কি বিনোদন না?’
আমি হেসে বলি, হ্যাঁ।অবশ্যই।
কে জানতো, এই ছোট্ট জবাব ডালপালা মেলবে বহুদূর!
নজির এবার চিন্তাবিদের ভূমিকায়। অঙ্কে গোবর গনেশ হলেও সমাজ বইয়ের হিসেব মেলাতে তার দেরি হয় না। গত পরীক্ষায় ১০০ তে ৪৩ পেয়েছে সে। কম কথা?
মনে মনে হিসেব মেলায় নজির, ‘‘বিনোদনের অভাব জনসংখ্যা বাড়ার কারণ। আর বিনোদন মানে তো সিনেমা। তাহলে, সিনেমা বেশি দেখলে বাচ্চা কম হবে? তাহলে বাচ্চা হবেটা কিসে? সহজ হিসাব। যেটা বিনোদন না সেটা করলেই। তার মানে পড়ালেখা। নিশ্চিত পড়ালেখা করলেই বাচ্চা হয়। কালই সারা স্কুলকে জানাতে হবে। সবার অজানা রহস্য সে বের করে ফেলেছে।’’
‘‘ওঃ মা গো’’
চিন্তা করতে করতে চোখটা যে কখন একটু লেগে এসেছিল টেরই পায়নি। মায়ের খুন্তি ট্রিটমেন্ট পিঠে পড়ায় ঘুম ভাঙলো। আবার ওই একই লাইন আওড়াতে লাগলো নজির…
পরদিন সকাল। নজিরের জীবনে নোবেল জেতার মতো দিন। বন্ধু মহলে (এখন যদিও সবাই ক্লাসে তার বছর তিনেকের জুনিয়র) অপার রহস্য আবিস্কারের জন্য আজকের হিরো সে। রাতের মধ্যে আরও আবিস্কার করলো, একা পড়লে হবে না। ছেলে-মেয়ে দুজন বসে পড়াশোনা করতে হবে একসাথে!!
এরপর পরীক্ষা এসে যায়। নজিরবিহীন ঘটনা ঘটায় নজির। অঙ্কে পাস। বাকি সব বিষয়ে পাস। শুধু সমাজে ফেল! তার মত সমাজবিদ কিভাবে? কেন?
আজ এসএসসি পাস করেছে নজির। ব্যবসায়ী বড়লোক বাবা খাসি আর বিরিয়ানীর বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। হাজারখানেক লোকের দাওয়াত। বাবা যা পারে নি ‘একটু’ দেরিতে হলেও পেরেছে ছেলে। কি বড় অর্জন।
এত বড় অর্জন যার, সে বাসায় নেই। খোঁজও মিলছে না।
নজিরের নজর তখন রূপালী পর্দায় আটকানো। হলে সিনেমা দেখছে সে। নায়ক মান্না। পুলিশ অফিসার। তার বাবা নামকরা সন্ত্রাসী। টানটান উত্তেজনা।
এবার নজিরই বলুক তার কথা…
ইস্। আমার বাবা যদি সন্ত্রাসী হতো! তাহলে আমিও তো মান্না ভাইয়ের মতো পুলিশ হতে পারতাম! বলেই চোখটা ছলছল করে ওঠে তার।
বেশি ভাবনার সময় পায় না। আব্বার দোকানের কর্মচারি ইলিয়াস আর রফিক ঠিকই তাকে খুঁজে বের করে ধরে নিয়ে আসলো বাসায়।
বাসায় ঢুকে বিরিয়ানির ঘ্রাণ ভুলিয়ে দিল সব চিন্তা। সব।
এত আনন্দের মাঝেও বিশাল গ্যাঞ্জাম। বড় ভাই কোথা থেকে কাকে যেন বিয়ে করে এনেছে। আমার নতুন ভাবী। চেহারা যথেষ্ট ভালো। কিন্তু আব্বার মনে হয় দেখতে খারাপ ছেলের বৌ দরকার ছিল! তা না হলে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করছিল কেন!
পরে জানতে পেরেছি মোড়ের দোকানের চাওয়ালার মেয়েকে বিয়ে করাতে এই রাগারাগি!!!
কি আজব! জসীম ভাই মানে নায়ক জসীম তো সেদিনের দেখা সিনেমায় দর্জির মেয়ে শাবানা আপাকে বিয়ে করলো! কই কেউ তো কিছু বলেনি। দর্শকরা সিটি বাজিয়েছে। তালি দিয়েছে।
আব্বা নিশ্চয়ই ওই সিনেমা দেখে নি। আচ্ছা কোনো সিনেমাই কি দেখেছে? বিনোদনের অভাব!
খবর পেয়ে আমার চার বোন শ্বশুরবাড়ী থেকে ছুটে এসেছে। বাসা ভর্তি গ্যাঞ্জাম। কিন্তু আমার মনে নজিরবিহীন প্রশান্তি।
কারণটা মিনি। মেজ বোনের ননদ। এসব ঝগড়া ফ্যাসাদ তাকে ছুঁতে পারে না।
আমি মেজো আপার বড় ব্যাগদুটো টানতে টানতে বারদুয়েক তাকালাম তার দিকে।আমার দিকেও খেয়াল নেই!
এরপর টানা সাতদিন সালমান শাহ্ এর সিনেমা দেখে তালিম নিলাম। মিনির হৃদয়ে ঠাঁই চাই।
মনে মনে ছক কষলাম। খরচ আছে এসবের। সানগ্লাস কেনা, মাথার হ্যাট, জামার উপরের দুটো বোতাম ছিঁড়তে হবে, চুল কাটা, ইমিটেশনের একটা চেইনও পড়তে হবে। আর গোলাপ।
শেষেরটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, জসিম থেকে ওয়াসিম, মান্না থেকে সালমান…. সবাই গোলাপের আশ্রয় নিয়েছে ভাব বিনিময়ে।
হঠাৎ এক রাতে চিঠি লিখতে বসলো এসএসসিতে বাংলায় ‘৫৩’ পাওয়া নজির। ১০১ বারের চেষ্টায় যা লিখলো, তা এরকম….
মিনি,
কালতো ছিলাম ভালো, আজ আমার কি হলো, এ কথা কইতে পারি না। পাথরের পৃথিবীতে কাঁচের হৃদয়। এ মন আমার পাথর তো নয়। অনেক সাধনার পরে আমি ‘চাইলাম’ তোমার মন।
ইতি, নজির শাহ্।
যদিও নজির শাহ্ তার আসল নাম না। নায়ক-নায়ক ভাব আনতে এই ব্যবস্থা।
পরদিন সকালে। আর চিন্তা-ভাবনা নয়। ব্রাশে পেস্ট মাখাচ্ছিল মিনি। নজির হঠাৎ এসে ব্রাশ পেষ্ট কেড়ে নিয়ে মিনির হাতে চিঠিটা আর গোলাপটা দিয়ে দৌঁড়ে পালালো।
যেতে যেতে কানে এল, ‘প্লাস্টিকের গোলাপ দিয়ে কি করবো আমি!!!’
কি বোকা এই মেয়ে! আসল গোলাপ কেউ দেয়! ওটাতো একদিনেই শেষ! প্লাস্টিকের গোলাপ রবে আজীবন।
ইস্। পিঠটাও যদি প্লাস্টিকের হতো! বিশ্বাসঘাতক মিনি। চিঠিটা সরাসরি আমার মা’র হাতে দিয়েছে। বাসার এমন কোনো ব্যক্তি নেই যে চিঠিটা পড়েনি। পিঠের ওপর এখন মায়ের ট্রিটমেন্ট চলছে।
খারাপ লাগছে না। সিনেমায় এমন মার সব নায়কই খায়…. জ্ঞান হারানোর আগে নজির স্পষ্ট দেখতে পেল, মিনি কাঁদছে।
এরপর সিনেমার মতো ফাস্ট ফরোয়ার্ড। গানের মধ্যে সাইকেল চালাতে চালাতে কৈশোর থেকে মধ্যবয়েসে পৌঁছায় নায়ক-নায়িকা।
বয়েস বাড়ার সাথে সাথে বিনোদনের অভাব হতে থাকে নজিরের। অর্থাৎ সিনেমার জগতের ভূত নামে। ব্যাবসায় মুখ গোঁজে। সফলও হয়। মিনির সাথে প্রেম না হলেও পারিবারিকভাবে বিয়েটা হয়।
নায়কের মতো প্রেম করাটা হলো না নজিরের। মিনিকে অর্জন করে নিতে হলো জীবনে সফল হয়ে। ‘পারিবারিকভাবে’। জীবনটাকে বড় বিস্বাদ লাগে। সফল হয়েও ব্যর্থতার বিষাদ। বার বার মনে আসে সমাজ বইয়ের ওই দুটো শব্দ… ‘বিনোদনের অভাব’