গৌরব হারিয়েছে বাংলা চলচ্চিত্র। বছরের পর বছর ব্যর্থ হতে হতে চলচ্চিত্র পড়েছে অস্তিত্ব সংকটে। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ২৮ জেলায় নেই কোনো সিনেমা হল। ঈদ কিংবা শাকিব খানের সিনেমা বাদে বাকি যেসব সিনেমা হল সচল রয়েছে সেগুলোয় ছবি মুক্তি পেলে ভিড়-হাউজফুল দেখা যায় না। পরিবার নিয়ে দর্শক তো সিনেমা হলে যাওয়াই ভুলে যেতে বসেছে! নানা কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রবিবার সন্ধ্যায় এফডিসিতে ইমন-মাহির ‘ব্লাড’ ছবির মহরতে কেন মানুষ সিনেমা হল বিমুখ হলো, কেনই বা এখনকার সিনেমা চলছে না; সেই ব্যাখ্যা দিলেন হাজারও চলচ্চিত্রের খল-অভিনেতা মিশা সওদাগর।
জনপ্রিয় এ অভিনেতা বলেন: চলার মতো ছবি বা প্রডাকশন কি আমরা লঞ্চ করতে পারছি? যে সমস্ত গুণাবলী থাকলে একটা ছবি চলবে সেইসব কি আমরা ছবির মধ্যে দিতে পারছি? গত ১০ বছর কেউ বলতে পারবে যে এই ছবিটাতে শিল্পী, পরিচালক, টেকনিশিয়ান, প্রযোজক প্রত্যেকেই তাদের সেরাটা দিয়ে চলার মতো সমস্ত গুণাবলী দিয়েছিলেন কিন্তু চলে নাই? আমরা এখনও ফর্মুলার বাইরে। দুই আর দুই চার হয় সবার। আর কিছু মানুষের দুই আর দুই বাইশ হয়। সবার হয় না।
প্রয়াত চিত্রপরিচালক দিলীপ বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করে মিশা বলেন: তার কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওস্তাদ আপনার ৯৫ পারসেন্ট ছবিই সফল। কিভাবে এটা সম্ভব হয়? তিনি বলেছিলেন, এই কথাটা আমাকে তেমন কোনো শিল্পী জিজ্ঞেস করেনি। তুই করেছিস আমি খুশি হয়েছি। তারপর উনি বলেছিলেন, যখন একটা স্ক্রিপ্ট নেই সেটাই হলো ওই ছবির প্রপার্টি। সবচেয়ে মূল্যবান এটা। স্ক্রিপ্টটা যদি ঠিকমতো থাকে তবে এটাই হবে সবচেয়ে বড় নায়ক-নায়িকা, এটাই সবচেয়ে বড় অ্যাসেট। স্ক্রিপ্ট ঠিক করে শিল্পী যদি ঠিকভাবে সংলাপ দিতে পারে, সঠিকভাবে অভিনয় করে তবে অবশ্যই ছবি চলবে।
শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা বলেন: ছবি চলে না, ছবি চলে না বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তুলে দিচ্ছি। কিন্তু যে ছবিটা চলার কথা ছিল তাও চলেনি এমন নাম কেউ বলতে পারবে? একসময় তাহলে ছবি চলতো কিভাবে? তখন সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখা ছাড়া কোনো কাজ ছিল না। কিন্তু দর্শকের হাতে এখন স্মার্ট ফোন। তারমানে হাতে পুরো দুনিয়াটাই আছে। শুধু একটা সিনেমা না, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সিনেমা এখন দর্শকদের হাতে। অনলাইন, বিভিন্ন অ্যাপ, টিভি চ্যানেলসহ ছবি দেখার মাধ্যম এখন একাধিক। এজন্য দর্শক এখন এগিয়ে গেছে। মানুষকে সবসময় রিচ কালচার আকর্ষন করবেই।
তিনি বলেন: একসময় প্রচার-প্রচারণা না করেই টানা ২৯ শো হাউজফুল দিয়েছি। কিন্তু এখনকার নায়ক-নায়িকারা রাস্তায় বের হয়েও একটা শো হাউজফুল দিতে পারে না। আরেকটা বিষয় এখন বেশি শোনা যায়, ছবিতে থাকবে নতুন লুক। আরে লুক কি? গল্প-স্ক্রিপ্টে লুক কি থাকবে সেটা আগে জানো। মুক্তির পর শুধু শুধু আওয়াজ শুনি। কিন্তু মানুষ সিনেমা হলে গেলে বুঝে যায় কার দম কতো! শুক্রবার রিলিজের পর তিনদিন না যেতেই সিনেমা হল থাকে ফাঁকা। এসব কিছুর আসল কারণ হচ্ছে, আমরা ঠিকভাবে স্ক্রিপ্ট এবং ভালো গল্পে জোর দিচ্ছি না। যেকটা ছবি গত কয়েক চলেছে সবগুলোর গল্প এবং ছবির সঙ্গে জড়িতরা নিজেদের বেস্টটা দিয়েছেন বলেই সম্ভব হয়েছে।
আমি বাংলাদেশের মিশা সওদাগর পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সিনেমায় অভিনয় করা লোক হয়ে বলছি, ছবি চলবে কেন? স্ক্রিপ্টটা শিল্পী রপ্ত করে? তারা রপ্ত না করে চরিত্রের মধ্যে ঢুকতে না পারে। ভালো অভিনয় করতে না পারে। তাহলে অভিনয় ডেলিভারি দেবে কিভাবে? যুগ বদলে গেছে । কাজেই এখন তথাকথিত গল্প, এনক্লাইমেক্স, নায়ক-নায়িকার কলেজ পড়ুয়া প্রেম, বাবাকে আটকে রাখা এসব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রতিটা দর্শক এখন বুদ্ধিমান এবং সচেতন। হল বিমুখ এই দর্শক ফিরিয়ে আনা কঠিক। এজন্য প্রচুর পড়াশুনা করে গল্প ঠিক করতে হবে। গবেষণার দরকার হতে পারে।
মিশা সওদাগর বলেন: পরিচালক হচ্ছেন ক্যাপ্টেন। তিনি যদি চান ছবি চালাবেন তাহলে অবশ্যই ছবি চলবে। তবে তাকে সেভাবেই সিরিয়াস হয়ে সবকিছুই নির্দেশনা দিতে হবে। আগে পঞ্চাশটি প্রডাকশন হাউজ ছিল, এখন পাঁচটি হাউজ নেই যে তারা নিয়মিত ছবি বানাবে। কেন বানাচ্ছে না? কারণ, আমরা বানানোর মতো পরিবেশ দিতে পারছি না। আর মাল্টিপ্লেক্সের দর্শক আমাদের নয়। তারা মার্কেটে ঘুরতে যায়, শপিংয়ে যায়; এর ফাঁকে সিনেমা দেখে। তারা কিন্তু রেগুলার সিনেমা দেখে না। কিন্তু ড্রাইভার, কাজের মানুষ, কৃষক যারা আয়ের একটা অংশই ঠিক রাখে সিনেমা দেখার জন্য; ছবি ভালো লাগলে তালি দেয়, খারাপ লাগলে গালি দেয় তারাই হচ্ছে প্রকৃত বাংলা ছবির দর্শক।