চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সিনেমার গানে কণ্ঠনন্দিনী সামিনা চৌধুরী

সত্তর-আশির দশকে সিনেমার স্বর্ণযুগে ‘প্লেব্যাক’ ইন্ড্রাস্ট্রিতে রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, আবিদা সুলতানা, শাম্মী আখতাররা যখন অমূল্য ধন তখন আশির প্রারম্ভে আবির্ভাব ঘটে সামিনা চৌধুরীর। ব্যতিক্রম এক সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী। মেঘ, বৃষ্টি আর অভিমানে ভরা সুরভিত এক কণ্ঠনন্দিনী।

কণ্ঠে যেনো মণিমুুক্তো হীরে দিয়ে সাজানো। প্লেব্যাকের অনন্য নায়ক মাহমুদুন্নবীর রক্তের যোগ্য উত্তরাধিকার হয়ে আসেন। প্লেব্যাকে মাহমুদুন্নবী তখনও ভীষণ উজ্বল।

তখন সিনেমায় কবরী, শাবানা, ববিতা, সূচরিতাদের আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা। সিনেমায় তাঁদের লিপে রুনা, সাবিনা, আবিদারাই অনবদ্য। আনন্দ-বিরহ, প্রেম-রোমান্স, হাসি-কান্না সব গানেই তাদের জয়জয়কার। তাদের গাওয়া অনেক গানই সিনেমার চেয়েও জীবন্ত হয়ে সঙ্গীত শ্রোতাদের হ্নদয়কে নাড়া দিয়ে চলেছে। এমন ক্ষণে রুনা, সাবিনার মাঝে নিজেকে দ্রতই আলাদা করে আবির্ভূত হন তরুণী সামিনা চৌধুরী। ‘প্লেব্যাক’ আঙিনায় এসেই কণ্ঠের জাদু দিয়ে স্পর্শ করেন সিনেমা দর্শক আর সঙ্গীত পিপাসুদের মন।

১৯৮২ সাল। দেশে তখন সামরিক সরকারের শাসন চলছে। আন্দোলন-সংগ্রাম চারিদিকে। সেসময় রাজনৈতিক বক্তব্য নির্ভর ছবি ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ তৈরি করলেন প্রখ্যাত পরিচালক আমজাদ হোসেন। সিনেমার মূলচরিত্রে জনপ্রিয় অভিনেত্রী ববিতা এবং অভিনেতা বুলবুল আহমেদ। সঙ্গীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী। এই ছবিতে ববিতার লিপে সামিনার গাওয়া গান ‘একবার যদি কেউ ভালবাসতো আমার নয়ন দুটি জলে ভাসতো’ যেনো অন্য এক রুপ লাভ করে। সামিনা হ্নদয় থেকে উৎসারিত কণ্ঠে এই গান উপহার দিয়ে প্রমাণ করে দিলেন রক্তেই তাঁর সুর, আর কিছু নেই। এই গান কালজয়ী এক গান হয়ে খ্যাত হয়ে আছে। কথা-সুর আর কণ্ঠে গানটি অপরাজেয়, অমর অপূর্ব এক সৃষ্টি। যে গানের সীমানা সামিনা নিজেও কোনোদিন আর পেরুতে পারবেন না।

৮৩ সালে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, কানাডার যৌথ প্রয়োজনায় নির্মিত হলো ‘দূরদেশ’ ছবি। ভারতের উষা খান্না আর বাংলাদেশের গোলাম হোসেন লাতুর সঙ্গীত পরিচালনায় এই ছবিতে বড় বোন ফাহমিদাকে সাথে নিয়ে গাইলেন ‘ভাইটি আমার তুমি কেঁদ না’। এই গানে পাওয়া গেল সামিনার মমতাময়ী কণ্ঠের মর্মময় ছোঁয়া। সেই রেডিওর যুগে অনুরোধ আসর আর বিজ্ঞাপন তরঙ্গে এই গানটির মনোযোগী শ্রোতার সংখ্যা বাড়তে থাকলো হু হু করে।

বছর পরেই যেনো মূল বিস্ফোরণটা ঘটালেন সামিনা। ৮৪ সালের ৩ আগস্ট মুক্তি পেল বেলাল আহমেদ পরিচালিত ত্রিভুজ প্রেমের এক অনবদ্য ছবি ‘নয়নের আলো’। সৃষ্টিশীল সঙ্গীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। এই ছবিতে দুটি গানে কণ্ঠ দিলেন সামিনা। সামিনা আর এন্ড্রুকিশোরের গাওয়া ‘আমার বুকের মধ্যেখানে মন যেখানে হ্নদয় যেখানে’ এবং সামিনার একক কণ্ঠে ‘আমি তোমার দুটি চোখের দুটি তারা হয়ে থাকবো’ এই গান দুটি যেনো আছড়ে পড়লো টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। সিনেমায় ‘আমার বুকের মধ্যেখানে মন যেখানে হ্নদয় যেখানে’ মিষ্টি এই গানটিতে অনবদ্য লিপ করলেন নবাগত কাজরী এবং রোমান্টিক হিরো জাফর ইকবাল এবং দ্বিতীয়টিতে লিপ করলেন ডাগর চোখের হার্টথ্রব নায়িকা সুবর্ণা মোস্তফা। এই গান দুটি আজো আগের মতোই নতুন, প্রাণময় এবং সুরভিত।

এই একই বছরে সিনেমাতে সামিনার গাওয়া আরও একটি গান সবার মন জয় করে নিল। এবছর বরেণ্য পরিচালক মোস্তফা আনোয়ারের পরিচালনায় মুক্তি পেল ‘আঁখিমিলন’ ছবিটি। ছবির সঙ্গীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। সামিনা এন্ড্রু কিশোরের সাথে যৌথকণ্ঠে গাইলেন ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’। সিনেমায় এই গানে অসাধারণ লিপ করলেন ইলিয়াস কাঞ্চন এবং সুইট সুচরিতা। সামিনার এই গান জয় করে নিল গ্রামবাংলার লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণীদের মন। আজো এই গানটি সেই আগের মতোই প্রাণবন্ত হয়ে আছে। এই ছবিতে সাবিনা ইয়াসমিনের সাথে তিনি আরও গেয়েছিলেন ‘ শোনরে বুবু শোন’ এই গানটিও। এরপর সামিনা যে প্লেব্যাক করেন সেগুলো সেভাবে শ্রোতাদের মনে রেখাপাত করতে সক্ষম হয়নি। ফেরারী বসন্ত, কাবিন, সুখ, দুশমন দুনিয়াসহ আরও কিছু ছবিতে গাওয়া গান অনুল্লেখ্যই বলা চলে।

বেশ পড়ে ৯৩ সালে মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত ‘প্রেম দিওয়ানা’ ছবিতে ফিরে আসেন শেখ সাদী খানের সুরে ‘চন্দ্র সূর্য সবই আছে আগের মতো’ এই গানটি নিয়ে। চমৎকার গাইলেন। হ্নদয়ের সব সুর ঢেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এরপর ২০০৬ সালে দিদারুল আলম বাদলের পরিচালনায় ‘না বলো না’ ছবিতে যেনো সেই পুরনো সামিনাকে দেখা গেল। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে গাইলেন ‘ নদী চায় চলতে তারা চায় বলতে’, এন্ড্রু কিশোরের সাথে গাইলেন ‘গানে গানে চেনা হলো’। সুরের প্রাণময় ঝর্ণায় ভিজিয়ে দিলেন সিনেমা দর্শকদের।

২০০৬ সালে মুক্তি লাভ করে সামিয়া জামান পরিচালিত ‘রাণীকুঠীর বাকী ইতিহাস’। এই ছবিতে এসআই টুটুলের সুরে কবীর বকুলের লেখা ‘আমার মাঝে নেইতো আমি’ গানটি আসিফের সাথে অন্যরকম মুগ্ধতা নিয়ে করেন। প্রাণবন্ত সুরে নিজেকে উজাড় করে দেন। এই গান গেয়ে তিনি পান জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার। বরাবরই রাগভিত্তিক গানে তিনি ব্যতিক্রম। এখনও রাগভিত্তিক গানকেই বড় বেশি মান্য করেন।

সামিনা চৌধুরী আমাদের এক দরদী মিষ্টি কণ্ঠ, এক অমূল্য সম্পদ। বড্ড দরদ দিয়ে গান করেন তিনি। গানে অভিমান থাকলেতো কথাই নেই। তাঁর গাওয়া অসংখ্য আধুনিক গান আমাদের হ্নদয়কে জুড়িয়ে দেয়। কিন্তু সেই তুলনায় প্লেব্যাকে তিনি খানিকটা উপেক্ষিতই থেকে গেছেন। আশির দশকের প্রারম্ভে সিনেমার প্লেব্যাকে তাঁর যে অসাধারণ সূচনা ছিল কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি। আমাদের সঙ্গীত জগতের এই অমূল্য ধনকে আমরা ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারেনি এটি বলা বাহুল্য। প্লেব্যাকে তাঁকে ঠিকমতো কাজে লাগানো গেলে তাঁর কাছ থেকে নিশ্চিত আরও অনেক মোহনীয় সব গান পাওয়া যেত। সামিনা চৌধুরীর জন্মদিন ছিল গতকাল ২৮ আগস্ট। আগামীতে তিনি আরও নতুন গান উপহার দেবেন সেই প্রত্যাশা থাকলো। শুভকামনা রইলো এই কন্ঠনন্দিনীর জন্য।