চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সাহসে-প্রজ্ঞায় চাঁদপুরের এসপি শামসুন্নাহার

‘ছোটবেলা থেকেই চ্যালেঞ্জিং কিছু করার ইচ্ছা ছিল। চাইতাম এমন একটা চাকুরি যেখানে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকবে, নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে। সেজন্য ছোট থেকেই লালন করেছিলাম ব্যরিস্টার হবার স্বপ্ন। কিন্তু সে স্বপ্ন ম্লান হয়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পর। সেখানে আমার আইন বিভাগে পড়ার সুযোগ হয় না। ভর্তি হই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে।’

নিজের জীবনের কথা বলছিলেন চাঁদপুরের এসপি শামসুন্নাহার। দেশের সর্বোাচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়ার সুযোগ হলেও পড়তে পারেননি কাঙ্খিত বিষয়ে। অার তাই প্রথম-প্রথম মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়। তবে খুব অল্প সময়েই সহপাঠীদের ভালবাসা আর শিক্ষকদের সহযোগিতায় আপন করে নেন বিভাগটিকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে থাকাকালে যোগ দেন বিএনসিসির বিমান শাখার ক্যাডেট হিসেবে। ১৯৯৩ সালে বিএনসিসির পক্ষ থেকে যশোরে যান। সেখানে বিমানবাহিনীর পাইলটদের ইউনিফর্ম, নিয়ম-শৃঙ্খলা, জীবন-প্রণালী দেখে মুগ্ধ হন। তখন থেকেই মনে মনে ভাবতে থাকেন এমন একটা চাকুরি করবেন যেখানে ইউনিফর্ম পরা যাবে। কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে।

‘মূলত ইউনিফর্মটাই আমাকে বেশি আকৃষ্ট করে,’ হেসে বলেন এই কর্মকর্তা।

যেই ভাবা সেই কাজ। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কথা। বিস্তর খোঁজ নেন এ বিষয়ে। তারপর দেরি না করে নিতে থাকেন প্রস্তুতি। ১৯৯৬ সালে অনার্স পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরই অংশ নেন ২০ তম বিসিএস পরীক্ষায়। প্রথম পছন্দই ছিল পুলিশ। অবশেষে আসে বিসিএস পরীক্ষার ফলাফলের সেই কাঙ্খিত দিন। সেদিনের কথা মনে হলে এখনও আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন এই কর্মকর্তা। ফল প্রকাশের সময় তিনি ছিলেন ৮ মাসের গর্ভবতী। মনের মধ্যে অবিরাম ঘোরাফেরা করছিল নানা দুশ্চিন্তা। আর তাই ফল প্রকাশের পর যখন ভবিষ্যতে শক্ত মজবুত অবস্থানের হাতছানি পান তখনই ভেসে যান অনন্দে।

বর্তমানে তিনি কর্মরত আছেন চাঁদপুরের পুলিশ সুপার হিসেবে।

ফরিদপুরে জন্মগ্রহণকারী এই পুলিশ কর্মকর্তা ব্যক্তি জীবনে দুই সন্তানের জননী। স্বামী মো. হেলাল উদ্দিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ব্যবসায়ী। বাবা শামসুল হক ও মা আমেনা বেগমের প্রথম সন্তান শামসুন্নাহার। তার অন্য তিন ভাই-বোনও নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। মেজ ভাই ডাক্তার, সেজ ভাই হাইকোর্টের আইনজীবি। ছোট বোন স্কুলের শিক্ষক।

শামসুন্নাহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৬ সালে স্নাতক ও ১৯৯৮ সালে  স্নাতকোত্তর শেষ করার পর ২০০৫ সালে এমফিল-ও করেন। ২০০৭ সালে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করেন এমবিএ। ২০০৯-২০১০ সালে জাতিসংঘ মিশনের মাধ্যমে পূর্ব তিমুরে জাতীয় পুলিশের মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। জাতিসংঘের উচ্চপদে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য ৭ বার পেয়েছেন জাতিসংঘ শান্তি পদক। দুইবার পেয়েছেন আইজিপি ব্যাজ।

পরপর দু’বার জাতীয় পুলিশ প্যারেডে নেতৃত্ব দিয়েও ইতিহাস গড়েছেন শামসুন্নাহার। দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠতার জন্য ২০১৭ সালে পেয়েছেন পুলিশের সর্বোচ্চ পদক প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল।

শামসুন্নাহার বলেন, ‘সবা্র কাছ থেকে শুনতে পেতাম পুলিশের চাকুরি অনেক কঠিন। এটা শুধু ছেলেরাই পারে। মেয়েদের পক্ষে এ গুরুদায়িত্ব পালন করা অসম্ভব। কিন্তু কর্মজীবনে প্রবেশের পর দেখেছি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। নেই কোন অসুবিধা। এমনকি মেয়েরা কোন কোন ক্ষেত্রে এ পেশায় পুরুষদের চেয়ে অনেক ভাল করছে।’

অপরাধ  নিয়ন্ত্রণ, দক্ষতা, ও কর্তব্যনিষ্ঠতার জন্য চাঁদপুরবাসীর নিকট অত্যন্ত প্রিয় তিনি। নারী ও শিশু সহায়তায় গড়েছেন সেল। চাঁদপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতিতে নিয়েছেন নানামুখি পদক্ষেপ। কমিউনিটি পর্যায়ে পুলিশের কার্যক্রমকে বিস্তৃত করেছেন যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনার জন্য কাজ করে। অনেক সময় চলে যান তিনি নিজেও। মাদক, বাল্যবিবাহ ও জঙ্গিবাদ মুক্ত সমাজ গড়তে তিনি দেশব্যাপী গণজাগরণ তৈরা করতে চান। এ লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন অবিরত।

সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও সমান বিচরণ রয়েছে তার। তিনি বিটিভির তালিকাভুক্ত সংগীত শিল্পী। অংশ নেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ করেন দর্শক-শ্রোতাদের।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে চ্যানেল অাই অনলাইনের মাধ্যমে সকল নারীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা  নারীরা শুধু রক্ত মাংসের পিণ্ড নই। নিজেদেরকে অবহেলিত ভাবার কোন অবকাশ নেই। আমরা সব কাজ করতে পারি। নিজেদের খাদ্যের সংস্থান করতে পারি, করতে পারি বাবা-মা সন্তানদের জন্য। প্রয়োজনে আমরা স্বামীদেরও খাদ্যের সংস্থান করতে পারি। আমরা ঘরে-বাইরে সব জায়গায়ই সমানভাবে কাজ করতে পারি।’

‘নারী মুক্তির একমাত্র উপায় হল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা,’ সেজন্য মেয়েরা যে যে অবস্থানেই থাকুক না কেন সেখান থেকেই তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পরামর্শ তার।

অভিভাবকদের উদ্দেশে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘কন্যা শিশুদের কোনভাবেই অবহেলা করা যাবে না। একটি ছেলেকে আপনারা যেমন সবকিছু দিয়ে সাপোর্ট দেন মেয়েদের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই হতে হবে। তাহলেই মেয়েরা এগিয়ে যাবে।’

এসপি শামসুন্নাহার মনে করেন, নারী পুরুষের বৈষম্য যদি একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে মূলোৎপাটন করা যায় তাহলেই একটি সুখি-সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলা সম্ভব।