মাত্র কয়েকদিন আগে অন্তত সাত কোটি টাকা ব্যয় করে বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগ-বিপিএলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করা হলো। হিন্দি সিনেমার দুই তারকা সালমান খান আর ক্যাটরিনা কাইফ বিপুল টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশে এসে মঞ্চ মাতিয়ে গেলেন। এখন প্রতিদিন বিকেলে চলছে বিপিএলের খেলা। দেশি-বিদেশি নামি-দামি ক্রিকেটাররা চার-ছয়ের ঝড় তুলছেন। মিডিয়া ব্যস্ত সেই খেলার বিস্তৃত প্রতিবেদন উপস্থাপনে।
অন্যদিকে প্রকৃতিতে এখন হালকা শীতের পরশ, বাজারে শাক-সবজির বাহারী সমাবেশ, দিকে দিকে প্রমোদ-ভ্রমণ আর পিকনিক উদযাপনে দেশের দর্শনীয় স্থানগুলোতে চলছে উপচে-পড়া ভিড়। মধ্যবিত্ত হৃদয়ে নিতান্তই শান্তির সুবাতাস। দেশের ‘দৃশ্যমান নাগরিক’রা যখন আকণ্ঠ সুখের সাগরে নিমজ্জিত ঠিক তখনই এই খবরটি আমাদের মুখে যেন অনেকটাই চুনকালি লেপে দিল! পাওনা বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার জন্য খুলনায় আমরণ অনশনে অসুস্থ হয়ে প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলের শ্রমিক আবদুস সাত্তার (৫৫) মারা গেছেন! যে দেশে চার-পাচঁ কোটি টাকা ব্যয় করে মাত্র দশ মিনিটের পারফরম্যান্সের জন্য ভিনদেশি দুজন নায়ক-নায়িকাকে আনা হয় ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, সেখানে মাত্র কয়েক হাজার টাকা পাওনার জন্য অনশন করতে গিয়ে মারা যান একজন দরিদ্র নাগরিক! এটা কি কোনো ন্যায় এবং ইনসাফের দেশ হতে পারে? এখানে শ্রমিক স্বার্থ বড়, নাকি বিপিএল বড়?
খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলের শ্রমিকরা মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ (পিপিপি) বাতিল, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের পিএফ গ্র্যাচ্যুইটির টাকা প্রদান, শ্রমিকদের সাপ্তাহিক মজুরি নিয়মিত পরিশোধ, পাট মওসুমে পাট কেনার অর্থ বরাদ্দসহ শ্রমিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ১১ দফা দাবিতে ১০ ডিসেম্বর থেকে আমরণ অনশন শুরু করেছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের ডাকে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক এ কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন। শ্রমিকরা বলছেন, তাদের নিয়মিত বেতন দেয়া হয়নি এবং এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের দাবিতে তারা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন। আন্দোলনে থাকা পাটকলগুলো হচ্ছে- ক্রিসেন্ট জুট মিল, খালিশপুর জুট মিল, দৌলতপুর জুট মিল, প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিল, স্টার জুট মিল, আলিম জুট মিল, ইস্টার্ন জুট মিল, কার্পেটিং জুট মিল ও জেজেআই জুট মিল।এর আগেও শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধের দাবিতে তারা ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। সরকার, সংশ্লিষ্ট পাটকল কর্তৃপক্ষ কেউ তাদের কথা কানে তোলেনি। অবশেষে পেটের খিদেতে অস্থির শ্রমিকরা আমরণ অনশনের কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হন।
চারদিন ধরে তারা অনশনে আছেন। কিন্তু মিডিয়ায় বিষয়টি নিয়ে কোনো মাতামাতি নেই। কোনো রাজনৈতিক দলের উল্লেখযোগ্য কোনো নেতাও সেখানে উপস্থিত হননি, তাদের খোঁজখবর নিতে যাননি। নিজেদের অস্তিত্বের তাগিদে আন্দোলনে শামিল হওয়া পাটকল শ্রমিকদের অনশনস্থলে ঝুলছে কেবল সারিসারি স্যালাইন। ‘হাড়-হাভাতের দল’ হলে কী হবে, তারা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। কোথাও কোনো তালভঙ্গ নেই। না খেয়ে থাকতে থাকতে যারা মূর্ছা যাচ্ছেন, তাদের ধরাধরি করে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। যারা কাহিল হয়ে পড়ছেন, তাদের স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। আজানের সময় এই দুর্বল হয়ে পড়া শ্রমিকরা স্যালাইন খুলে নামাজ আদায় করছেন। নামাজ শেষে আবার বসে পড়ছেন অনশনে। হাজার হাজার শ্রমিক তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া ও পাওনা আদায়ে গত চারদিন ধরে অনশনে বসে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কারও মধ্যে কোনো বিকার দেখা যায়নি।
পাটমন্ত্রী সেখানে যাননি। সেখানকার এমপি বাহাদুরও তাদের খবর নেননি। দেশের শ্রমিক নেতারাও তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করার প্রয়োজন বোধ করেননি। সবাই আছেন যে যার স্বার্থ আর ধান্দায়! ওদিকে পেটের দায়ে অনশনে অংশ নেওয়া শ্রমিকদের একজন ইতিমধ্যে মারা গিয়েছেন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন অনেকেই। স্যালাইন দেওয়া শ্রমিকের সংখ্যাও কেবলই বাড়ছে। কিন্তু দেশে বর্তমানে হাজার হাজার কোটি দুর্নীতি আর লুটপাট হচ্ছে। সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের বহরও কমছে না। অথচ পাটকল শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার চরম উপেক্ষা দেখাচ্ছে। শ্রমিকরা কতটা অসহায় হলে এই প্রচণ্ড শীতে কাঁথা-বালিশ নিয়ে দিনরাত অনশন কর্মসূচি পালন করে, সেটা বোঝার মতো কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না নির্দয় সরকারের মধ্যে। শ্রমিকরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, অথচ সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ের ব্যক্তিরা নিজ নিজ বাসগৃহে কম্বলের ওম উপভোগ করছেন!
এক মুঠো ভাতের জন্য খুলনায় পাটশিল্পের শ্রমিক অনশনে মরছে। আর ক্ষমতাসীনরা রাজধানীতে বসে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি আর প্রবৃদ্ধি মাপছেন। ঢাকা শহরকে সাজানো হয়েছে বিজয় দিবস উদযাপনের জন্য। কিন্তু কেউ প্রশ্ন করছে না, এ তবে কিসের বিজয়, কার বিজয়? যে শ্রমিক নিজের পাওনা চাইতে গিয়ে অনশনে অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন, তাকে আমরা কোন বিজয় উপহার দিতে পারলাম? কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে আয়োজিত বিপিএল আর সালমান-ক্যাটরিনার নাচ কার জন্য? খেতে না পাওয়া পাটকল শ্রমিকদের জন্য? মৃত ওই পাটকল শ্রমিকের জীবনে সালমান-ক্যাটরিনার নাচ মস্ত প্রহসন ছাড়া কী? আমরা কি তবে এমন প্রহসনের বিজয়ও উদযাপন করব? সরকার কি তবে এই হাজার হাজার শ্রমিককে কেবলই ‘বিবেকভর্তা’ উপহার দেবে?
এই দেশে শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মুজরি নেই, প্রাপ্য পাওনা পরিশোধের বাধ্যবাধকতা নেই। জীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তাও নেই। অনিরাপদ পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকরা জীবন্ত পুড়ে মরছে। এ সপ্তাহেই ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হিজলতলা এলাকায় প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামক একটি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জন শ্রমিক দগ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় অন্তত ১২জন শ্রমিক মারা গেছেন। বাকিরা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। ঢাকা শহরে গত কয়েক বছরে আগুনে পুড়ে মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে অনেক তোলপাড় হয়েছে। অনেক উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কারখানার মালিকরা আইনের প্রতি বুড়ো আঙ্গুল দেখালেও তাদের আইন মানাতে বাধ্য করা যায়নি।
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ৭৮.ক ধারায় ব্যক্তিগত সুরক্ষা যন্ত্রপাতি ব্যবহারের বাধ্যবাধকতায় বলা হয়েছে, শ্রমিকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা ব্যতীত নিয়োগকারী কাউকে কর্মে নিয়োগ করতে পারবে না এবং কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য নিয়োগকারী প্রত্যেক শ্রমিককে কাজের ঝুঁকি সম্পর্কে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করবেন। কিন্তু বিষাক্ত গ্যাসে শ্রমিক মৃত্যুর এ ঘটনায় এটি প্রতীয়মান হয় যে, সেখানে শ্রম আইনের বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে আমরা কী করব? সংশ্লিষ্ট ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান, নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ এবং সারাদেশে শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে শ্রম আইন বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানাব? কিন্তু তাতে কারও টনক নড়বে? সরকার উদ্যোগী হবে?
পরিশেষে চাইব, লাগাতার অনশনে অসুস্থ হয়ে পাটকল শ্রমিকের মৃত্যু কিংবা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় কেরানীগঞ্জে প্লস্টিক কারখানায় বেশ কয়েকজন শ্রমিকের পুড়ে মরার ঘটনা সরকার, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের বিবেককে নাড়া দিক! শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য হিস্যা ও জীবনের নিরাপত্তা যদি আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না হয়, তাহলে আর কিসের স্বাধীনতা, কিসের গণতন্ত্র?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)