চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

সার্চ কমিটি: নির্বাচন কমিশন ও আগামী নির্বাচন

অবশেষে নানা বিতর্কের মধ্যে আইন অনুসারে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ নতুন সার্চ কমিটি গঠন করলেন। আমার কাছে নামগুলি দেখে এই সার্চ কমিটিকে তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে। কিন্তু বিরাজমান পরস্পরের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও পারস্পারিক অশ্রদ্ধাবোধের রাজনীতির আবহে সন্দেহ থেকেই যায় হয়তো তাঁরা প্রভাবশালীদের চাপের মুখে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন উপহার দিতে চায়, চাপমুক্ত থেকে অথবা চাপ উপেক্ষা করে সংবিধান সম্মতভাবে নবগঠিত সার্চ কমিটি একটি নিরপেক্ষ ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি তালিকা প্রস্তুত করে পাঠাবেন রাষ্ট্রপতির কাছে। যাতে তিনি বাছাই করে যে কমিশন নিয়োগ করবেন তা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং সে কমিশন দু’বছর পর অুনষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হন। অনুরূপ অনুরোধ রাষ্ট্রপতির কাছেও থাকলো কারণ তিনিই নির্বাচন কমিশন নিয়োগে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী।

বস্তুত: আমার অভিজ্ঞতায়, নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী সৎভাবে কাজ করলে কোন মহলের চাপের কাছে নতি স্বীকার না করলে কমিশন সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অবশ্যই জাতিকে উপহার দিতে পারবেন। যেমন পেরেছেন ১৯৫৪ ও ১৯৭০ সালে। তবে ঐ দুটি নির্বাচনে গণ আন্দোলনের জোয়ার এবং জনমত প্রবল থাকায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কোন ইথি উথি করা সম্ভবও ছিল না। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে প্রবল গণ-আন্দোলনও একটি আবশ্যিক শর্ত। আসা করি তা অচিরেই গড়ে উঠবে।

বিরোধী দলসমূহ অবশ্যই বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারবে না বলে অভিমত প্রকাশ করে আসছেন। তাঁরা চাইছেন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠিত করে (এই সরকার তার মেয়াদের ছয় মাস আগে পদত্যাগ করে) তার মাধ্যমে নির্বাচন হলেই কেবল নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচিত অনুষ্ঠিত করতে পারবে, যেমন পেরেছিল আওয়ামী লীগের উদ্যোগে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলনের পটভূমিতে।

এই দাবির উৎপত্তি হয় স্বৈরাচারী এরশাদের আমলে। তখন বিএনপিও এই দাবির সাথে কণ্ঠ মিলিয়েছিল। শেষ তক তা গঠিত হলো এবং জাতি প্রত্যাশিত সুষ্ঠু নির্বাচন ১৯৭০ সালের পর প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেল।

ঐ নির্বাচনের ফল অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে বিএনপি ১৯৯১ সালে ক্ষমতাসীন হন। কিন্তু পাঁচ বছর মেয়াদ শেষে আবার যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে তার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি বিরোধী দলগুলি উত্থাপন করলো তখন বিএনপি তা মানতে অস্বীকৃতি জানায় কিন্তু আন্দোলনের চাপে তা মানতে বাধ্য হয়।

১৯৯৬ এ নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দীর্ঘকাল পর সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্জন করে ক্ষমতাসীন হয় কিন্তু তার কার্যকালের মেয়াদ শেষ হলে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও তার মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রবল আপত্তি জানায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দাবি মানতে বাধ্য হয় বিএনপির নেতৃত্বে সংগঠিত আন্দোলনের পটভূমিতে।

অত:পর জারি হয় সেনা সমর্থিত জরুরী অবস্থা নবগঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক। এই সরকার দুর্নীতির অভিযোগ এনে দুই নেত্রী এবং দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াকে কারারুদ্ধ করেন। সংবিধানে জরুরী অবস্থার মেয়াদ সর্বোচ্চ ছয় মাস লেখা থাকলেও এই সরকার তা না মেনে টানা দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর একটি সাধারণ নির্বাচন দেন ২০০৮ সালে এবং তাতে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে আওয়ামী লীগ ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়। এই ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেন সকল বিরোধীদলের চরম বিরোধিতা সত্বেও। আজ এক যুগ ধরে যে সকল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তার সবকটিতেই আওয়ামী লীগ ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে চলেছে যা দেশবাসীর মনে সন্দেহের উদ্রেক করেছে। সন্দেহের কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না, ভোটাররা ভোট দিতে পারছেন না, ভোটের আগের রাতেই পুলিশ দিয়ে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন জো হুরহুর করে শির দাঁড়াহীনভাবে ঐ ভোট মেনে নিয়ে যথার্থ বলে তাতে সিল মেরে দিচ্ছে….ইত্যাদি।

সরকার পক্ষ যদিও তা অস্বীকার করে চলেছে এবং নির্বাচনগুলি যথার্থভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে দাবী করছে। কিন্তু এখন ভোটাররাও তা মানতে নারাজ। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলিতে দেখা গেল মানুষ স্পষ্টতই ভোট বিমুখ এবং তাই সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হতে পারলেও ই.ভি.এম. এ ত্রুটির ফলে বহু কেন্দ্রে ভোটাররা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। নির্বাচন কমিশন সে নির্বাচনও ‘যথার্থ বলে আখ্যায়িত করে বিদায় নিতে চলেছে।

সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও বিরোধী দলগুলিকে যোগদান করাতে ব্যর্থ হয়েছে। এর পরেও সরকারি দল মনোনীত প্রার্থীরা শতকরা ৪০ ভাগের মত আসনে নির্দলীয় প্রার্থীর বিজয়ী হয়েছে। সরকারের জনপ্রিয়তায় যে বিপুল ধ্বস নেমেছে-এটা তার স্পষ্ট প্রমাণ।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনী প্রথাকেও কলুষিত করা হয়েছে। মান্ধাতার আমল থেকে এই নির্বাচনগুলি নির্দলীয় ভাবে অনুষ্ঠিত হতো এবং তার বিরুদ্ধে কোন মহলেরই কোন ক্ষোভ বা বিরোধিতা কদাপি পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু অকস্মাৎ অতি উৎসাহী হয়ে সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলিও দলীয় মনোনয়নে ও দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হওয়ার আইন জারি করে। সম্প্রতি তার কুফলও দেখা গেল। সরকারি দলের প্রার্থী সংখ্যা ক্রমবর্ধমান কিন্তু মনোনয়ন তো পান একজন। বাকীরা তখন বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই নিজ দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্ত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এবং সরকারি দল মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে নির্বাচিতও হচ্ছেন বহুক্ষেত্রে। এর বিষাক্ত পরিণতি হলো দলগুলির মধ্যে অভ্যন্তরীন কোন্দল ও রেষারেষি এবং শক্রতা ও কলহ বৃদ্ধি পেলো, অবৈধ টাকার খেলা তৃণমূল পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাল মারামারি, খুনোখুনি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেল। বহিষ্কার পাল্টা বহিষ্কার চলতে থাকলো।

এখন তাই, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অবিলম্বে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সকল পর্যায়ে অতীতের পদ্ধতি পুন:প্রবর্তন করার জন্যে দলীয় মনোনয়ন ও দলীয় প্রতীক ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে সবাই। আমি নিজেও সে দাবী জানাচ্ছি।

ভোটকেন্দ্রে ই.ভি.এম. ব্যবহারও চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতাও তিক্ত। তাই এ ব্যবস্থা নিয়ে বিরোধীদলগুলির সাথে ঐকমত্যের ভিত্তিতে করণীয় নির্ধারণ করা বাঞ্ছনীয়।

নির্বাচনে টাকার খেলা, অস্ত্রের খেলা, সাম্প্রদায়িক প্রচারণা আজ প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যস্ত ছড়িয়ে পড়েছে। যেমন নির্বাচন কমিশন, তেমনই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব আইন-বিরোধী ঘটনাগুলি প্রতিরোধে এগিয়ে না এসে চোখ বুঁজে থেকেছেন। বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের মধ্যেই নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে প্রকাশ্যেই ভিন্নমত প্রকাশ করতে বহুবার মানুষ দেখেছে।

ভোট কেন্দ্রে সকল প্রার্থীর প্রতিনিধি থাকার বিধান আইনে থাকলেও বহুক্ষেত্রে বিরোধী দলের প্রতিনিধিদেরকে বের করে দেওয়া হয়েছে অথবা ভোটকেন্দ্রে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি এবং খালি মাঠে সরকারি দলের প্রার্থীদের মনোনীত প্রতিনিধি কর্তৃক নিজেরাই ব্যালট কেটে বা বোতাম টিপে নিজ দলীয় প্রার্থীর সপক্ষে ভোট দেওয়ার অভিযোগ বহু কেন্দ্র থেকে উত্থাপিত হয়েছে এবং রিটার্নিং অফিসার বা পোলিং অফিসাররা বিরোধী প্রার্থীদের বা তাদের এজেন্টদের লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হলেও তা আমলে না নেওয়ার অভিযোগও বিস্তর। দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলিতেও এমন খবর নির্বাচন কালে প্রকাশিত হতে দেখা যায়।

রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচন কমিশনে রেজিষ্ট্রেশন পদ্ধতি সর্বত্র আছে। বাংলাদেশেরও থাকবে কিন্তু এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে রেজিষ্ট্রেশন সংক্রান্ত বিধিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। স্মরণে রাখা প্রয়োজন, রাজনৈতিক দল গঠন একটি সাংবিধানিক অধিকার। যদি তা-ই হয় তবে রেজিষ্ট্রেশনে কঠোরতা কেন? যেমন নতুন কোন দল রেজিষ্ট্রেশন চাইলে তার সকল জেলা উপজেলায় কমপক্ষে ২০০ জন সদস্য, সর্বত্র কমিটি এবং অন্তত ৪০টি জেলায় দলীয় অফিস এবং কেন্দ্রসহ সকল স্তরের কমিটিতে কমপক্ষে ৩০ ভাগ নারী সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক করা-এই সাংবিধানিক অধিকারের সুষ্পষ্ট পরিপন্থী। আবার অন্তত একজন নতুন দলের মনোনয়ন ও তার প্রতীকে নির্বাচিত হতে হবে-এমন বিধান বাধ্যতামূলক এটা হাস্যকর। নতুন দলের সদস্য কম থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সর্বস্তরে সদস্য সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া অযৌক্তিক। সুতরাং দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত অন্তত একজন সংসদ সদস্য থাকার বিধান ও অফিস, সদস্য সংখ্যার বাধ্যবাধকতাও তুলে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। দল গড়লে সরকার বা ধনীরা টাকা দেবে এমন তো নয়। সুতরাং দল গড়ে তার রেজিষ্ট্রেশন চাওয়ামাত্র দেওয়ার বিধান করা প্রয়োজন।

আর একটা অযৌক্তিক নিয়ম আজও প্রচারিত রয়েছে। শুধুমাত্র সংসদ নির্বাচনের আগে বর্ণিত শর্তগুলি পূরণ সাপেক্ষে নতুন দলের রেজিষ্ট্রেশন দেওয়া হয়। অথচ সারা বছর ধরে সংসদের উপনির্বাচন এবং ইউনিয়নস্তর পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তাহলে যে দলগুলি সংসদ নির্বাচনগুলির পরে গঠিত হয় তারা কিভাবে উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকারি নির্বাচন উপনির্বাচনগুলিতে অংশ গ্রহণ করবে? তাই সারা বছরই রেজিষ্ট্রেশনের বিধান বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত নির্বাচন কমিশনের জন্য।

এবারে নানাস্তরের কমিটিতে নারী সদস্য কমপক্ষে ৩০ ভাগ রাখা যৌক্তিক হলেও তিনটি দল যেমন আওয়ামী লীগ, বি.এন.পি ও জাতীয় পার্টি এই তিনটি ক্ষমতার ভিত্তিক দল ছাড়া অন্য কোন দলের পক্ষেই বাস্তবে তা সম্ভব নয়। প্রকৃত পক্ষে ঐ তিন দল বাদে রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্ত অথবা ৩৭টি দলের কমিটিগুলিতে তা নেই- নেই নির্ধারিত সংখ্যক অফিস এবং সদস্যও। তাই এগুলি বিধান দলীয় গঠনতন্ত্রে রাখা এবং আগামী ৩০ বছরের মধ্যে কার্যকর করার বিধান করা হোক।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)