কোনো কিছু সম্পর্কে ধারণা না থাকলে কথায় কথায় অনেক সময় মজা করেই কেউ কেউ বলে-“আচ্ছা ওই জিনিসটা খায় না মাথায় দেয়?” সেই বিষয়টা ইদানিং বেশি মনে হচ্ছে-‘সামাজিক দূরত্ব’ শব্দটা ঘনঘন ব্যবহৃত হওয়ার পর থেকে।
সরকারসহ সেবামুলক প্রতিষ্ঠান এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো প্রচার করেই চলেছে করোনা থেকে মুক্তি পেতে বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। হ্যান্ডস্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। মাস্ক অবশ্যই পরতে হবে। কোনো অবস্থাতেই নাকে-মুখে-চোখে হাত স্পর্শ করানো যাবে না। বাইরে থেকে এসে সোজা বাথরুমে ঢুকে পরনের কাপড় ধুয়ে ফেলে সম্ভব হলে গোসল করতে হবে।
কিন্তু গত দুমাসে আমরা ঘরে থাকতে থাকতে যেন হাঁপিয়ে উঠেছি। সরকার যেই মাত্র সীমিত পরিসরে সবকিছু খুলে দিতে শুরু করেছে অর্থনীতির চাকাকে গর্তে পুরোপুরি পড়ে যাবার আগমুহুর্তে, তখনই কিসের সামাজিক দূরত্ব? সবকিছু যেন ভুলে যেতে বসেছি। কি ব্যাংক, কি পোস্ট অফিস বা রাস্তাঘাট। সবখানেই গা ঘেঁষে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কতদিন পর দেখা হল, এরকম কষ্ট নিয়ে যেন কথা বলা শুরু করেছে সবাই।
ডাকঘর সঞ্চয় ব্যুরো, মিরপুরের বিশেষ শাখায় যাই ৩ জুন। সকাল ৭টায় গিয়ে দেখি চল্লিশজন মানুষ সিরিয়াল নিয়ে বসে আছে। তারা সকাল ৬টায় এসে বসে আছে। আসতেই পারে। দুই মাস কোনো টাকা ওঠাতে না পারায় অনেকের সংসার চালাতে টানাটানি পড়ে গেছে। তাদের অনেকের সংসারের একমাত্র উপার্জন এই সঞ্চয়পত্রের মুনাফা। একজন তো বলেই ফেললেন তার ঘর ভাড়া বাকি পড়েছে।
ধীরে ধীরে মানুষ বাড়তে থাকে। বিশেষ শাখার কর্তৃপক্ষ খুবই সতর্কতার সঙ্গে তাদের কাজ সম্পাদন করার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু যারা মুনাফা তুলতে এসেছে তারা কেউ সামাজিক দূরত্ব তো মানেইনি, কেউ কেউ বলেছে মরলে মরুম, কিসের দূরত্ব? কারো কারো মুখে মাস্ক থাকলেও মুখের নিচে তা নামিয়ে কথা বলতে দেখা গেছে। গা ঘেঁষে কথা বলতে দেখা গেছে অনেককেই।
এখন কথা হলো এরা সবাই যে অল্প শিক্ষিত, এমন না। কথাবার্তায় বোঝা গেল অনেকেই পড়াশোনার শেষ স্টেজ পার করা। চাকরি-বাকরি করছেন কেউ, কেউ ব্যবসা বাণিজ্য করছেন। কেউ শিক্ষকতা করছেন। কেউ বা পেনশনের টাকায় সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। দুঃখের বিষয় হলো অনেকেই করোনার বিষয়ে সচেতন। কিন্তু সিরিয়ালে দাঁড়ানোর সময় সেই সচেতনাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে কার আগে কে যাবে-সেই প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
সামাজিক দূরত্ব বলতে এখন আর কোনো বিষয় নেই। কি শিক্ষিত, কি অর্ধশিক্ষিত। এভাবে চলতে থাকলে একসময় সেই কথার মতোই কারো কারো কাছ থেকে প্রশ্ন আসতেই পারে-“সামাজিক দূরত্ব কি খায় না মাথায় দেয়?”
তারপরও যেন বলি-সামাজিক দূরত্ব প্রয়োজন আমাদের নিজের জন্যে। পরিবারের জন্যে। সমাজের জন্যে। সর্বোপরি দেশের জন্যে।
যেভাবে করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা আর মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, সামাজিক দূরত্ব খায়ও না মাথায়ও দেয় না-এটা আমাদের করোনা থেকে রক্ষাকবচ হিসেবেই দেখতে শেখাবে একদিন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)