বাঙালি হিন্দুর সর্বপ্রধান এবং সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। আনন্দময়ী দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গার আগমন বার্তায় বর্তমানে চরাচর আনন্দমুখর। আমরা দুর্গাপূজা বললেও আসলে এই পূজা মা-দুর্গার একার নয়। সঙ্গে আরও অনেকেই আছেন।
মা দুর্গা আসেন সবাইকে নিয়েই৷ ভাল-মন্দ, শত্রু-মিত্র, গাছ-প্রাণী সঙ্গে নিয়েই৷ চালচিত্রে শিব আছেন, তো পায়ের নিচে অসুর। কলাগাছ বউ তো পেঁচা, হাঁস, ইঁদুর, ময়ূর বাহন। হাসিকান্না, সুজন-দুর্জন, পশুপক্ষী-উদ্ভিদ সমাহারে আমাদের জীবন-পথ চলাটাকেই সহজ করে চিনিয়ে দিতে চান।
পৌরাণিক কাহিনি থেকে দুর্গা পূজার শুরু। কিন্তু ক্রমে দুর্গা যেন আমাদের ঘরের মেয়ে হয়ে উঠেছে। সাধারণ মেয়ে, তবে দাপুটে। এই দাপুটে মেয়ের কত নাম! এক অঙ্গে বহুরূপ। এক রূপে বহুনামে চিহ্নিত আমাদের মা দুর্গা।
শরৎঋতুতে আবাহন হয় বলে দেবীর আরেক নাম শারদীয়া। এছাড়া মহিষাসুরমর্দিণী, কাত্যায়নী, শিবানী, ভবানী, আদ্যাশক্তি, চন্ডী, শতাক্ষী, দুর্গা, ঊমা, গৌরী, সতী, রুদ্রাণী, কল্যাণী, অম্বিকা, অদ্রিজা এমন কত নাম আছে মায়ের। ঠিক নানী-দাদীরা যেমন আমাদের আদর করে একটা নামে ডাকে, মামারবাড়িতে আদিখ্যেতা করে অন্য নামে ডাকা হয়। আবার বাবার দেওয়া একটা নাম, মায়ের দেওয়া একটা নাম, স্কুলের জন্য একটা ভালো নাম । মা দুর্গারও তেমনি অনেক নাম। সে তো আমাদেরই ঘরের মেয়ে !
আমরা যদি চণ্ডীর দেবীনির্মাণের ব্যাখ্যা ধরি, নানা শক্তি সমন্বয়ে আজকের ভাষায় তিনি একটি বিশেষ কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বানানো যন্ত্র, একজন নারীবেশী যুদ্ধাস্ত্র ছাড়া কিছু নন। অসুরের মধ্যে পুরুষের তথাকথিত নারীশরীরের লোভ সঞ্জাত করেছিলেন পৌরাণিকরা। তাই দুর্গা নামের যুদ্ধাস্ত্রটি স্ত্রী রূপে শোভিত, এক পুরুষকে প্রলোভন দেখাবে বলেই। যদিও আমাদের ঘরের মেয়ে বা লৌকিক দুর্গার সঙ্গে পৌরাণিক কাহিনির তেমন কোন মিল নেই। লৌকিক দুর্গা আমাদের ঘরের মেয়ে, চলতি তথাকথিত মেয়েলি সব বৈশিষ্ট্য তাঁর অধিকার।
মা’কে যেমন একাহাতে অনেক কাজ করতে হয়, ঠিক যেমন মা দুর্গাকে দশহাতে যুদ্ধ করতে হয়েছিল মহিষাসুর বধের সময়। সব দেবতারা অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল মা দুর্গাকে। অনেকগুলো দৈত্য, দানব, অসুরকে তিনি মেরেছিলেন। আমরা শুধু মহিষাসুরের নামটাই জানি। রক্তবীজ, চন্ড, মুন্ড, শুম্ভ, নিশুম্ভ, ধূম্রলোচন, মধু, কৈটভ আর মহিষাসুর, মোট ন’জন অসুরকে মা দুর্গা বধ করেছিলেন।
এই এক একজন দুষ্টু অসুর আসলে সমাজের খারাপ লোকেদের প্রতীক। ধরে নেয়া যায়, অসুরের একজন চোর, একজন ডাকাত, একজন মিথ্যেবাদী, একজন হিংসুটে, একজন মেয়েদের ওপর অত্যাচার করে, একজন অসৎ, একজন খুনি, একজন প্রতারক আর একজন নিষ্ঠুর লোক। এরা সকলেই দুষ্টু আর সমাজের জন্য ক্ষতিকারক মানুষ। তাই বছরে একবার মা দুর্গাকে স্মরণ করে আমরা এইসব অশুভ শক্তির বিনাশ করার চেষ্টা করি।
আমরা যেমন ঘর-সংসার, স্বামীসন্তান, আত্মীয় পরিজন ছাড়া কোনো কিছু চিন্তা করতে পারি না, আমরা দুর্গার ক্ষেত্রেও তাই দেখতে চেয়েছি। লৌকিক দুর্গা আমাদের মাঝে দেখা দেন সপরিবারে। বাঙালির আপন মনের মাধুরী মেশানো দুর্গা তার সন্তান কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীকে নিয়ে কৈলাশ থেকে হিমালয়ের ঘরে বাপের বাড়ি আসেন। বাঙালির ঘরে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসার মতো আনন্দ। যেমন পরিবারে সবাই আপন, সেরকম জগজ্জননীর বিশ্বসংসারে আমরা শিক্ষিত, অশিক্ষিত, খেটে খাওয়া মানুষ, ব্যবসায়ী-বৈশ্য, শাসনকর্তা-সবাই বিশ্বজননীর সন্তান- সরস্বতী, কার্তিক, লক্ষ্মী ও গণেশের মতো সবাই আপন। সন্তানদের কল্যাণের জন্য মা দুর্গা সর্বদাই উদগ্রীব। তাই ১০ দিক থেকে সন্তানদের রক্ষা করার জন্য তিনি ১০ হাতে ১০ অস্ত্র ধরেছেন।
তবে বাঙালি যেভাবে দুর্গা পূজাকে আত্মস্থ তথা জীবনের অঙ্গ হিসাবে গ্রহণ করেছে, তেমন ভাবে আর কেউ করতে পারেনি। মাতৃরূপে বা শক্তিরূপে মা দুর্গা যেমন বাঙালির অন্তর জুড়ে বিরাজ করছেন, তেমনি কন্যারূপে উমা বাঙালির সংসারে এক অভূতপূর্ব আবেগের সঞ্চার করেছে। কথিত আছে, গিরিরাজ হিমালয় ও তাঁর স্ত্রী মেনকা কন্যা উমা বা পার্বতীকে বিয়ের পর কৈলাসে শিবের ঘরে পাঠিয়েছিলেন । বৎসারান্তরে সেই কন্যাকে দেখার জন্য মা মেনকার ব্যাকুল প্রার্থনা যেন প্রতিটি বাঙালি পরিবারের সর্বজনীন প্রার্থনায় পরিণত।
ঘরের মেয়ে ঘরে আসবে–তাই বাঙালির ঘরে ঘরে দেখা দেয় আনন্দের শিহরণ। আমাদের এই দুঃখ-দৈন্যের ঘরে শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ে আসবে মাত্র চার দিনের জন্য–তাই আর সমস্ত দুঃখ ভুলে ঘরে ঘরে আনন্দের পসরা সাজায়, নতুন জামা কাপড় পরে দুঃখকে বিদায় দিয়ে আনন্দময় হয়ে উঠে বাংলার আকাশ-বাতাস। এভাবে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সামাজিক উৎসবে পরিণত করার ঘটনা পৃথিবীতে আর কোথাও পাওয়া যাবে না।
মা দুর্গাকে বরণ করে নেবার জন্য বাঙালির আগমনী সঙ্গীত আমাদের জীবনপ্রবাহে মিশে যাওয়া এক অবিচ্ছেদ্য ধারা। এর তাৎপর্য হৃদয় দিয়ে, গভীর বোধ দিয়ে অনুভব করতে হয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)