গণমাধ্যমে পরিবর্তন আসার সাথে সাথে বিজ্ঞাপনের ধরন এবং মানে এসেছে পরিবর্তন। পুরনো পণ্যের বিজ্ঞাপন নতুন মাধ্যমে এসেছে নতুন রূপে।
মাধ্যম আর পরিস্থিতিভেদে এই সফল বিবর্তনের ধারায় বিজ্ঞাপনের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রেডিও-টিভিতে বিজ্ঞাপন
১৯২০’র দশকের প্রথম দিকে প্রথম রেডিও স্টেশনগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই সময় রেডিও সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী ও বিক্রেতারা এমন কিছু অনুষ্ঠান সম্প্রচারের জন্য পাঠাতেন যেন আরও বেশি রেডিও বিক্রি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাডিসন এভিনিউ স্টেশন প্রথম বিজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসেবে রেডিওর গুরুত্ব তুলে ধরেছিল। যুক্তরাজ্যে প্রথম প্রথম সরকারি স্টেশনে বিজ্ঞাপনের সুযোগ না থাকলেও ১৯৫৪ সালে বাণিজ্যিক টেলিভিশন এবং ১৯৭২ সালে বাণিজ্যিক রেডিও স্টেশন অনুমোদনের পর থেকে সেসব মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের ব্যাপক প্রসার হতে থাকে।
বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি রেডিও ও টেলিভিশনে জনসেবামূলক, সমাজ সচেতনতামূলক এবং সরকারি বার্তা প্রকাশক বিজ্ঞাপনও প্রচারিত হতে থাকে।
শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট ওয়ার অ্যাডভার্টাইজিং কাউন্সিল গঠনেরও নির্দেশ দেন, যা সরকারের পক্ষ থেকে দেশটির পাবলিক সার্ভিস অ্যাডভার্টাইজিংয়ের সবচেয়ে বড় মাপের নমুনা।
১৯৩০’র দশকে চরম অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিজ্ঞাপন ব্যবসা ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে। তবে এ দশকের শেষের দিকে কর্পোরেট বিজ্ঞাপন নির্মাতারা সফলভাবে বাজারে ফিরে আসতে সক্ষম হন। তারা ভোক্তার মনোভাবকে মতামত জরিপ ও মার্কেট রিসার্চের মাধ্যমে নির্ণয় করতে শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অন্যান্য ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের বাজারে মন্দা দেখা দিলেও সরকারি ও যুদ্ধ বিষয়ক বার্তামূলক বিজ্ঞাপনের কারণে এসব বিজ্ঞাপনের বাজার ছিল রমরমা। তবে অন্যান্য বিজ্ঞাপনেও জাতীয়তাবাদী ধারণার ব্যবহার কমবেশি চলতে থাকে, যার প্রয়োগ আমরা আজও দেখি।
যুদ্ধের পর ধ্বংস কাটিয়ে ওঠার চেষ্টার মাঝে আবাসন ব্যবস্থা, ঘরের সরঞ্জাম, আসবাব, পোশাক ও যানবাহনের বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিপুল সংখ্যায়। এ সময় টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের ব্যাপক প্রসার দেখা যায়। এসব জিনিস ছাড়াও অবকাশ যাপনের জন্য ট্যুরিজম কোম্পানি ও হোটেল-মোটেলের বিজ্ঞাপনও বড় আকারে দেখা যেতে থাকে।
১৯৮০’র দশকে ক্যাবল টিভির আগমনের পর বিজ্ঞাপনের পরিসর আরও বেড়ে যায়। তখন বিভিন্ন পুরনো থিমের পাশাপাশি অপ্রাপ্তবয়স্কদের ধূমপান, মদ্যপান এবং বর্ণবাদের মতো নেতিবাচক বিষয়গুলোও বিজ্ঞাপনের অংশ হয়ে উঠতে থাকে।
অনলাইন বিজ্ঞাপন
ডট কমের আবির্ভাবের পর ১৯৯০’র দশক থেকে বিজ্ঞাপনের বিরাট একটি অংশ শুধু অনলাইন বিজ্ঞাপন নিয়েই কাজ করছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসংখ্য ওয়েবসাইট চলছে শুধু বিজ্ঞাপন থেকে আয় করা অর্থ দিয়ে।
অনলাইন বিজ্ঞাপনের সুবিধা হলো অন্যান্য বিজ্ঞাপনের চেয়ে এগুলো দেয়া যেমন সহজ, তেমনি খরচ তুলনামূলকভাবে কম। তাছাড়া অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে অনলাইন বিজ্ঞাপনের সাহায্যে দেশ-বিদেশের অনেক বেশি সম্ভাব্য ক্রেতার কাছে পৌঁছানো সম্ভব।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বিজ্ঞাপন এর ভবিষ্যৎ কী, জানতে চাইলে বিজ্ঞাপনী সংস্থা এক্সপ্রেশনস লিমিটেড’র ডিরেকটর অ্যান্ড ক্রিয়েটিভ হেড ত্রপা মজুমদার বলেন, সত্য একটু হালকাভাবে বললে বলতে হয় ভবিষ্যৎ বিজ্ঞাপনেরই। কারণ পুরোটাই তো বাজার অর্থনীতির যুগ। বাজার অর্থনীতিতে বিজ্ঞাপনের অবস্থান সবকিছুর কেন্দ্রে। কেননা প্রচারেই প্রসার। ব্যবসার প্রসারের জন্য প্রচার মানুষকে করতেই হবে। আর তার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে বিজ্ঞাপন।
তিনি বলেন, ‘যদি বিস্তৃতির দিক থেকে বিজ্ঞাপনের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করি, তাহলে এর ভবিষ্যৎ অতি উজ্জ্বল। আর গুণগত দিক থেকে যদি বলি, বিজ্ঞাপনে আসলেই আমাদের দেশে গর্ব করার মতো অগ্রগতি হয়েছে। কারণ অনেক বিজ্ঞাপনই এখন শিল্পের পর্যায়ে চলে গেছে।’
‘অর্থাৎ বিজ্ঞাপনগুলো শুধুই যে পণ্য বিক্রি করছে তা না। পাশাপাশি এর শিল্পিত উপস্থাপন এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, দর্শকরা ক্রেতা বা ভোক্তা হোক না হোক, সে বিজ্ঞাপনটা আলাদাভাবে দেখছে। যেভাবে মানুষ একটা নাটক দেখে বা গান শোনে বা ছবি দেখে সেভাবেই বিজ্ঞাপন আলাদা নজর কাড়তে পারছে অডিয়েন্সের। কাজেই শিল্পমানও বিজ্ঞাপনের অনেকটাই বেড়েছে।’
প্রসারের মাধ্যম
ভবিষ্যতে বিজ্ঞাপনের প্রসারের সবচেয়ে বেশি সুযোগ অনলাইন মাধ্যমে বলে মন্তব্য করেছেন ত্রপা মজুমদার। তার মতে, অবশ্যই বিজ্ঞাপনের ভবিষ্যতের অনেক বড় একটা অংশ জুড়ে থাকবে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন: প্রথমত, অনলাইনে অডিয়েন্সের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। আর দ্বিতীয়ত, মানুষের ব্যস্ততা বাড়ছে ফলে কোনো একটি মাধ্যমের জন্য আলাদা সময় বের করার মতো সুযোগ কমে যাচ্ছে।
‘মানুষ এমন মাধ্যমেই অভ্যস্ত হচ্ছে যেটি সে অন্য কাজের সাথেও ব্যবহার করতে পারে। এ কারণেই অনলাইনের জনপ্রিয়তা এত বেশি। আমি চলতে চলতে, পড়তে পড়তে, ঘুরতে ঘুরতে বা কিছু দেখতে দেখতেই অনলাইনে যে কোনো বিষয় ব্রাউজ করে ফেলতে পারি।’
‘আর যে মাধ্যমে অডিয়েন্স বেশি স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞাপনও সেদিকেই ঝুঁকতে বাধ্য হবে,’ বলেন ত্রপা।
তৃতীয় কারণ হিসেবে বিজ্ঞাপনের মূল্য ও দর্শক-শ্রোতার কাছে তা পৌঁছানো সংক্রান্ত তথ্যের সহজলভ্যতার বিষয়টি তুলে ধরেন ত্রপা মজুমদার। তিনি বলেন, অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায় এখন পর্যন্ত অনলাইন প্লাটফর্মে বিজ্ঞাপন দিতে কম খরচ হয়। কিন্তু বিজ্ঞাপনে রিচ বা অডিয়েন্সের কাছে ছড়িয়ে পড়ার হার অনেক ক্ষেত্রেই সে তুলনায় বেশি।
‘এছাড়া অনলাইনে মনিটরিং, ট্র্যাকিং ও ইভ্যালুয়েশনের প্রক্রিয়াটি অনেক সহজ। অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিলে আমি সহজেই দেখতে পারি কতজন লোক আমার বিজ্ঞাপনটি দেখেছে বা কতজন বিজ্ঞাপনের আধেয়টি পড়ছে অথবা কতজন এ নিয়ে মতামত দিচ্ছে, যা অন্যান্য মাধ্যমে তুলনামূলকভাবে অনেক কঠিন।’
আর এ কারণেই সময়ের সঙ্গে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বেড়েই চলেছে বলে জানান বিজ্ঞাপন জগতের অন্যতম এই ব্যক্তিত্ব।