সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে চলতি বছরের বহুল প্রতীক্ষিত ‘সাপলুডু’ চলচ্চিত্রের টিজার। টানটান উত্তেজনায় ঠাসা চলচ্চিত্রটির টিজার প্রকাশের পর পরই সোশাল মিডিয়ায় হইচই। প্রশংসা করছেন সর্ব সাধারণ। সবাই বলা বলি শুরু করছেন, ‘সাপলুডু’র জন্য অপেক্ষা করাই যায়!
ছবিটির পরিচালক পরীক্ষিত নির্মাতা, গোলাম সোহরাব দোদুল। গত দুই দশক ধরে বাংলা নাটকে দাপুটে একটি নাম। ছোট পর্দায় তার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা। কিন্তু সিনেমায় এই প্রথম! যদিও ‘সিনেমায় প্রথম’ বলায় আপত্তি আছে দোদুলের। কারণ এখন পর্যন্ত তিনি প্রায় ২৫টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। বহু আগেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। সময় ও সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তবে সব বাধা উপেক্ষা করে তিনি আসছেন। সবাইকে ‘খেইল’ দেখাতে!
‘সাপলুডু’ নির্মাণ অভিজ্ঞতা, মুক্তির পরিকল্পনা, ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে নির্মাতার ভাবনা। এসমস্ত কিছু নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের সাথে বলেছেন দোদুল…
‘সাপলুডু’র টিজার প্রকাশ করলেন। সোশাল মিডিয়ায়তো প্রচুর বাহবা পাচ্ছেন!
হ্যাঁ। দেখলাম। সবাই খুব প্রশংসা করছেন টিজারটির। খুব ভালো রেসপন্স পাচ্ছি।
‘সাপলুডু’ নিয়ে নেক্সট পরিকল্পনা কী?
মাত্র ফার্স্টলুক দিলাম। এখন ছোট ছোট করে ক্লিপ, কিংবা ছবির ইন্টারেস্টিং কিছু বিষয় পয়েন্ট আউট করে প্রমোশনাল কাজের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। কারণ সিনেমাটা সম্পর্কে মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে, কৌতুহলী করে তুলতে এগুলোর বিকল্প নেই। মানুষকে এমন ভাবে কৌতুহলী করে তুলতে চাই যে, মানুষ নিজে নিজেই বলে এই সিনেমাটা অবশ্যই দেখতে যাবো। সার্বিক ভাবে বলতে আপাতত ছবির প্রমোশনাল বিষয়গুলো নিয়েই কাজ করছি।
‘সাপলুডু’ শুটের সময় কোনো স্থিরচিত্র বা ক্লিপ প্রকাশ হতে দেখা যায়নি। এমনকি টিজার প্রকাশের আগে ছবিতে কোন চরিত্রের কী লুক এটাও দেখা যায়নি। তার মানে সিনেমার শুরু থেকেই আপনার মধ্যে এই প্রমোশনাল পরিকল্পনা মাথায় ছিলো?
হ্যাঁ। আমি কঠোর ভাবে এগুলা ফলো করেছি, মেইনটেইন করেছি। কারণ হয় কি, ধরুন একটা মানুষ যখন সিনেমা দেখতে যায় তখনতো দর্শক হিসেবে তারও একটা বাজেট থাকে। টিকেট কেটে সিনেমাটা দেখবে, দুপুরে লাঞ্চ করবে কিংবা তিন ঘন্টা একটা সিনেমা দেখার জন্য এরকম আরো খরচের বিষয় দর্শকের থাকে। সে যে খরচ করে সিনেমাটা নিজের বাজেট দিয়ে দেখতে হলে গেল, আমার কাছে মনে হয়েছে দর্শকের সেই কৌতুহলের জায়গাটাকে রেসপেক্ট করা উচিত। সিনেমা দেখতে যাওয়ার আগেই যদি তাকে সব দেখিয়ে দেই, তাহলে কি সেই ইন্টারেস্টটা সে পাবে? আর ফেসবুক এমন একটা জিনিষ, কেউ যদি একটা ক্লিক করে ছবি তুলে ফেলে তাহলে সেটা তার পোস্ট দিতে ইচ্ছে করবেই। সে কারণে আমি শুটিং স্পটে মোবাইল, ক্যামেরা সবকিছু বন্ধ রাখতে অনুরোধ করেছি সবাইকে। কারণ, ছবি তোলা মানেই সেই জোনটা প্রকাশ পেয়ে গেল, আর্টিস্টের লুক প্রকাশ হয়ে গেল। তো এসব যদি সিনেমা হলে যাওয়ার আগে দর্শকের মাথায় থেকে যায়, তাহলে তার কাছে খুব একটা নতুন কিছু আমি দিতে পারবো না। মানে কেউ আগে দেখে ফেললে হয় কি, ছবিটায় আর নতুনত্ব থাকে না।
সিনেমার শুট মানেতো আর্টিস্ট, ক্রু সব মিলিয়ে বিরাট বহর। কিন্তু এতো বহরের মাঝেও কেউ ছবি তুলেনি, এটা মেইনটেইন করলেন কীভাবে?
সাপলুডুতে বাংলাদেশের সব কিংবদন্তি আর্টিস্টরা কাজ করেছেন। তারিক আনাম, জাহিদ হাসান, লাভলু ভাইরা ছিলেন। মিম-শুভ,শতাব্দীরা ছিলো। তো, শুটে যাওয়ার আগে তাদের সবার সাথে আমি গ্রুমিং করেছি। রিহার্সেল করেছি কয়েকবার করে। বেশ কয়েকবার সবাই একসাথে বসেছি। ছবির বিষয় আশয় নিয়ে আলাপ করেছি। তো ওইসময় আমি সবাইকে বিনয়ের সাথে বলেছি, আমাদের মোবাইল ফোনটা শুটিং সেটে বের করবো না। ছবি তোলার বিষয়টি শুটের আগে সবাইকে বারণ করা হয়েছিলো। বিশেষ করে শুটিংয়ের লুকে, গ্যাটাপে ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষেধ ছিলো। আমার এমন আবদার সবাই খুব অ্যাপ্রিসিয়েট করেছে, বিষয়গুলো মেনে নিয়েই তারা কাজ করেছেন। এবং শুটিং যতোদিন হয়েছে তারমধ্যে কোনোদিন এমন অনুরোধের ব্যত্যয় ঘটেনি। এরজন্য তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।
আপনি আগে কোনো সিনেমা নির্মাণ করেননি। ‘সাপলুডু’ আপনার প্রথম ছবি হতে যাচ্ছে। অথচ সিনেমার পূর্বাপর নিয়ে আপনার যে সুদূর পরিকল্পনা, এটাতো বিস্ময়ের…?
এটা উত্তর দেয়ার আগে আমি একটা কথা বলি, সবাই জানে ‘সাপলুডু’ আমার প্রথম সিনেমা। এটা সত্য, আমার পরিচালনায় এটা প্রথম। কিন্তু সিনেমার সাথে আমি বহুদিন। অলমোস্ট ২৫টি সিনেমায় আমি কিন্তু অভিনয় করেছি। শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পী হিসেবে আমি একবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছি, এগুলো কিন্তু কেউ জানে না। আমার গ্রুমিং কিন্তু সিনেমার সাথে। বহু আগে থেকেই।
কোন ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন?
ছবির নাম ‘লাখে একটা’। কাজী কামাল পরিচালিত ছবি ছিলো এটি। ব্যাসিকেলি আমি কিন্তু ফিল্মেরই মানুষ। ছোটবেলা থেকেই জেনে দেখে আসছি, সিনেমা কীভাবে তৈরী করতে হয়, কীভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাতে হয়। এটা কিন্তু আমি নতুন করে শিখছি না।
সিনেমা নির্মাণে আসতে এতো দেরী করলেন কেন?
আমি সিনেমার পরিবেশে বড় হওয়া মানুষ। আমি বড় হয়ে সিনেমাটা যখন বানাবো এমন প্ল্যান করছি, তখন নাটকটাই এতো বেশী হাইলাইট হলো যে সিনেমাটা আর আগের জায়গায় থাকলো না। স্বর্ণযুগটা শেষ হয়ে গেল। এ কারণে তখন আমার সিনেমাটা বানানো হলো না। কিন্তু আলটিমেটলি সিনেমা বানানোর জন্যই কিন্তু আমি তৈরী হয়েছি।
আপনার ‘সাপলুডু’র বেশির ভাগ কাস্টিং-ই দেখা গেছে ছোট পর্দার নিয়মিত মানুষদের। কিন্তু টিজারে তাদের যেভাবে উপস্থাপন করলেন, দেখে মনেই হয়নি তারা বড় পর্দায় নিয়মিত নন। তাদের সিনেমাটিক লুক নিয়ে যদি বলেন?
আমার ছবির আর্টিস্টদের লুক সেটাপের জন্যই আলাদা দুজন লোক ছিলো। ক্যারেক্টার প্লে করার আগে আমরা লুক ডিজাইন করেছি। অমুক অমুক লুকটাকে আমরা কীভাবে দেখবো, এটা নিয়ে বিস্তর এক্সপেরিমেন্ট করেছি। তখন আমরা আমাদের আর্টিস্টদের উপর সেই লুকটা বসানোর চেষ্টা করেছি। বিশেষ করে শতাব্দী, জাহিদ ভাই বা তারিক ভাইয়ের লুকটা আগে ডিজাইন করে তাদের সেলফের সাথে মিলানো। এ সবকিছুই কিন্তু গ্রুমিংয়ের অংশ। আর এ কারণেই যাদেরকে সব সময় ছোট পর্দায় দেখে অভ্যস্ত দর্শক ঠিক তাদেরকে লুকের কারণে বড় পর্দায় ডিফারেন্ট লাগবে। নতুন লাগবে। কে কোন পর্দার, তারচেয়ে বড় কথা হলো লুক সেটাপ ইজ ভেরি ইম্পোর্টেন্ট। যেরকম জনি ডেপ! একেক ছবিতে একেক রকম লুকে তাকে দেখা যায়। আমরা জানি যে এই ছবিতে জনি ডেপ, কিন্তু তারপরও শুধু লুকের কারণে তাকে ভিন্ন লাগে।
‘সাপলুডু’কে কোন জনরার ফিল্ম বলতে চাইছেন?
অ্যাকশান-থ্রিলার।
সে ক্ষেত্রে ‘সাপলুডু’র গল্প নিয়ে কোনো ক্লু দিতে চান?
না, এই মুহূর্তে আমি চাইলে বলতেই পারি। কিন্তু গল্পটা যদি আমি একটু বলেই ফেলি সেক্ষেত্রে আমার মনে হয়, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে দর্শকের।
‘সাপলুডু’ নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?
শুধু আমার ছবি বলে নয়, বাংলা ছবি নিয়েই আমার বহু প্রত্যাশা। সামনে মোস্তফা কামাল রাজের ছবি আসছে, সেই ছবির জন্যও আমি শুভ কামনা জানাই। আমি চাই রাজসহ আরো যারা সামনে ছবি নিয়ে আসছেন, সবার ছবি সুপার হিট হোক। তাহলে আমি নিজেও খুব অনুপ্রেরণা পাবো। আমার বন্ধু বান্ধব, কলিগসহ আরো অনেকেই সামনে ছবি বানানোর প্ল্যান করছেন, আমি মনে প্রাণে চাই তাদের সবার ছবি নিজস্ব একটা ভাষা তৈরী করুক, দর্শক দেখুক। সেটাই এই ইন্ডাস্ট্রির জন্য ভালো।
আর সাপলুডু নিয়ে আমার প্রত্যাশা বলতে গেলে, যারা সিনেমা ভালোবাসেন তারাতো আসবেই, আমি চাই যারা সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যে বাংলাদেশি সিনেমা আমরা পছন্দ করি না। তারা আমাদের টিজার, ট্রেলার দেখুক। দেখার পর তারা এসে আমাদের বলুক যে, আমরা একটা আন্তর্জাতিক মানের ছবি বানানোর জনয্ প্রস্তুত আছি কিনা!
আমি একদমই চাই না ‘সাপলুডু’ কান ফেস্টিভালে যাবে। আমি একদমই চাই না এই ছবি দিয়ে আমি অনেক প্রেস্টিজিয়াস ফিল্ম ফেস্টিভালে নাল গালিচা সংবর্ধনা পাবো! সংবর্ধনা দিয়ে আমার জীবনে কিচ্ছু আসবে যাবে না। বরং আমার এই ছবি দিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে যদি দুই পয়সা আয় হয়, ইন্ডাস্ট্রি যদি একটু ঘুরে দাঁড়াতে পারে, এই ছবি দিয়ে যদি দশটা মানুষের কাজের যোগার হয় তাহলেই আমি খুশি। আমার ছবিটা যদি বিন্দু মাত্র এই ইন্ডাস্ট্রিতে কন্ট্রিবিউট করতে পারে, তাতেই আমি খুশি। আমার পুরস্কারের কোনো দরকার নাই।
ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে আপনার ভাবনা তারিফ যোগ্য…
এই ছবির জন্য যদি কান উৎসবে গিয়ে দুটো ছবি তুলতে পারি, সেটা আমার ব্যক্তিগত অর্জন হবে। এটা আমি অস্বীকার করছি না। নব্বই দশকে আমার দেশের ছবির বাজেট প্রায় কোটি টাকার কাছাকাছি ছিলো। সেই সময়ের বাজেটকে যদি এই সময়ের কারেন্সি দিয়ে হিসেবে করেন, তাহলে এখন আমাদের ছবির বাজেট আশি কোটি হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু সেই জায়গাতো নাই এখন। তো এটা আমরা হারিয়েছি কেন? এখন জরুরী সেই জায়গাটা পুনরুদ্ধার করা।
শুভ কামনা আপনার নির্মিত প্রথম ছবির জন্য…
আপনাকেও ধন্যবাদ।