দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ‘সাগরকন্যা’ খ্যাত পটুয়াখালী জেলার ‘কুয়াকাটা’ পর্যটন এলাকার আকর্ষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ২০১৫ সালের আগে যারা কুয়াকাটা গিয়েছেন আর যারা সম্প্রতি কুয়াকাটা গিয়েছেন, তাদের অভিজ্ঞতার অনেক ফারাক। মারাত্মক খারাপ যোগাযোগ-পরিবহন ব্যবস্থা আর ২/৩টি ফেরি পার হয়ে যাওয়ার আগের সেই ঝক্কি এখন আর নেই। অনেক পর্যটক কুয়াকাটার রাস্তাকে বিমানের রানওয়ের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপালী ইউনিয়নে অবস্থিত ‘কুয়াকাটা’ বিগত বছরগুলোর তুলনায় কয়েকগুণ পর্যটক আকর্ষণ করতে পারছে।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সরাসরি বাস যোগে পটুয়াখালি ও বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে কুয়াকাটায় যাওয়া যায়। স্থানভেদে বাসের মান অনুসারে ভাড়া নির্ধারিত রয়েছে। ঢাকার গাবতলি থেকে বাস পাওয়া যায়। কুয়াকাটার কাছেই দেশের অন্যতম সমুদ্রবন্দর ‘পায়রা’ অবস্থিত হওয়ায় সেখানকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। পরপর ৩টি বড় সেতু হওয়াতে সরাসরি পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে কুয়াকাটা।
এছাড়া বরিশাল ও পটুয়াখালীগামী বিলাসবহুল লঞ্চে করে বরিশাল-পটুয়াখালী গিয়ে স্থানীয় বাসে করে কুয়াকাটা যেতে হয়। কয়েকটি নদী পাড়ি দিয়ে লঞ্চে করে কুয়াকাটা যাত্রা পর্যটকদের ভ্রমণে নতুনমাত্রা এনে দিচ্ছে। যাত্রার কমপক্ষে ৫/৭দিন আগে থেকে ওইসব লঞ্চের টিকেট বুকিং দিয়ে রাখলে ভাল।
সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখার মতো সমুদ্র সৈকত শুধুমাত্র কুয়াকাটাতেই আছে, সে বিবেচনায় এটি বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় সমুদ্র সৈকত। কক্সবাজার ঘুরে গিয়ে কুয়াকাটা ভ্রমণ করলে অনেককিছুই হয়তো কল্পনার সৈকতের সঙ্গে মিলবে না, কিন্তু বন আর সাগরের সংমিশ্রণে কুয়াকাটা আসলেই অন্যরকম।
থাকার হোটেল, খাবার হোটেল আর দর্শনীয় স্থানগুলো প্রায় একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে অবস্থিত। ৪০০ টাকা থেকে শুরু করে প্রায় ১০ হাজার টাকা মানের অনেক থাকার হোটেল রয়েছে কুয়াকাটা সাগর সৈকতের একদম কাছে। আর খাবার হোটেলগুলোর প্রায় সবগুলোই সৈকত থেকে মাত্র ২/৩ মিনিটের হাটা পথ। টুরিষ্ট পুলিশের সক্রিয় তৎপরতায পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে এ এলাকার আকর্ষণ বাড়ছে।
কুয়াকাটা শহর আর সমুদ্র সৈকত একটি বেড়ি বাঁধ দিয়ে আলাদা করা আছে। বেড়ি বাঁধের মুখেই রয়েছে কুয়াকাটার বিভিন্ন দর্শণীয় স্থানের নাম ও দূরত্বের নির্দেশনা। কোন স্পটে কীভাবে যেতে হবে, তাও সাঙ্কেতিক চিহ্নের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া আছে সেখানে। সেই তালিকা দেখে একজন পর্যটক খুব সহজেই ঘুরে দেখতে পারেন কুয়াকাটার সব দর্শনীয় স্থান। তালিকার বাইরেও কিছু আকর্ষণীয় স্পট রয়েছে কুয়াকাটায়, স্থানীয় গাইড আর সৈকতের পাশে ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় সেগুলোও ঘুরে আসতে পারবেন পর্যটকরা। তবে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ও থাকার হোটেলকে মাথায় রেখে ডানে-বামে অবস্থিত স্পটে সকালে না বিকেলে দেখতে বের হবেন তা ঠিক করে নিন।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক কুয়াকাটা ও তার পার্শ্ববর্তী দর্শনীয় স্থানগুলো…
কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত বেশ পরিচ্ছন্ন। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে কুয়াকাটা সৈকতের পূর্ব প্রান্তে গঙ্গামতির চরের বাঁক থেকে সূর্যোদয় আর কুয়াকাটার পশ্চিম সৈকতে লেবুর বনের পাশে তিন নদীর মোহনা সূর্যাস্ত দেখার সবচেয়ে ভাল জায়গা।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের জোয়ারের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় ভাঙনের কবলে পড়ে সৈকত লাগোয়া দীর্ঘ নারিকেল গাছের সারি এখন নেই বললেই চলে। তার পরিবর্তে কিছু তালগাছ ও ঝাউগাছ এখন সৈকতের শোভা বাড়াচ্ছে। তবে সৈকতে জেলেদের মাছ ধরার নৌকা আর বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকা ম্যানগ্রোভ গাছগুলো দেখে পর্যটকরা আনন্দ পাবেন।
খুব সকালে মোটরসাইকেল যোগে গঙ্গামতির চরে গেলে সূর্যোদয় দেখতে পাওয়া যাবে। স্থানীয় মোটরসাইকেল চালক কাম গাইডরা বেশ নিরাপদে নিয়ে যাবেন ওই স্পটে। আগে থেকে ঠিক করে রাখলে ফজরের আযানের পর পরই গাইডরাই পর্যটকদের ফোন করে জাগিয়ে নিয়ে যান ওই স্পটে। আধাঁর থাকতে থাকতে রওয়ানা দিতে হয় ওখানে, ভয়ের খুব একটা কারণ নেই। সকালে প্রায় হাজারখানেক পর্যটক প্রতিদিন সূর্যোদয় দেখতে সেখানে হাজির হন।
আর বিকেলেও একই বাহনযোগে লেবুর বনের পাশে তিন নদীর মোহনায় সূর্যাস্ত দেখা। ‘আন্ধার মানিক’, ‘পায়রা’ আর ‘শিব বাড়িয়া’ এই তিন নদীর মোহনায় যেতে অসংখ্য সাদা ঝিনুকের ‘ঝিনুক বিচ’, রাখাইন লেম্বুনের নামানুসারে ‘লেম্বুন ঠোটা’ থেকে লেবুর বন দেখে নিতে পারবেন।
লেবুর বনে কোনো লেবু গাছ না থাকলেও রয়েছে কেওয়া আর গেওয়া গাছের দারুণ সব স্পট। সূর্যাস্তের কমপক্ষে ২/৩ ঘন্টা আগে সেখানে না গেলে অনেক কিছুই না দেখা থেকে যেতে পারে।
গ্রুপ ছবি, সেলফি আর হাতের মধ্যে অস্ত যাওয়া সূর্য ধরার ছবি তোলার পোজ দিতে দিতে সূর্যাস্ত দেখে পর্যটকরা ফিরে আসেন লেবুর বনের পাশের টং হোটেলগুলোতে। সেখানে কাঁকড়া আর সামুদ্রিক মাছের গরম গরম ফ্রাইয়ের স্বাদ নিয়ে থাকেন তারা। একটু দামাদামি না করলে পরে আফসোস থেকে যায়।
কুয়াকাটার ঝাউবন, লাল কাকড়ার দ্বীপ আর নির্জন সৈকত দর্শনের জন্য সকালের দিকে (১০টার পরপরই) বেরিয়ে পড়েন পর্যটকরা। ওইসময় ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়া রোদ পোহাতে বেরিয়ে আসে। তবে মোটরসাইকেলের শব্দ আর পর্যটকদের পদচারণায় তারা গর্তে ঢুকে যায়। তবে গাইডরা জানে কীভাবে পর্যটকদের কোথায় লাল কাকড়া দেখাতে হয়।
কাঁকড়ার বাসা, সৈকতে তাদের শিল্পকর্ম আর লাল কাকড়ার সঙ্গে ছবি তোলার আগে-পরে কাউরার চর আর গঙ্গামতির চর ঘোরা হয়ে যাবে।
পাশেই রয়েছে ২/৩টি বৌদ্ধ মন্দির আর কিছু দূরে রাখাইন পল্লী। মোটরসাইকেলে করে ওইসব এলাকা ঘোরাটাও একটা বিশেষ অভিজ্ঞতা। প্রায় ৫৫০ জনের মতো মোটরসাইকেল চালিত গাইড আর দুইশতাধিক হলুদ পোশাকধারী ফটোগ্রাফার আছে কুয়াকাটাতে। ৫০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে একটি মোটরসাইকেলে করে কুয়াকাটার সব স্পট ঘুরে আসা সম্ভব। তবে সকালে সূর্যোদয়ের সময়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা আলাদা খরচ করতে হয়। একটু দরদাম করেই থাকেন পর্যটকরা।
রাখাইন পল্লীতে গিয়ে তাদের তাঁত-বুনন সরঞ্জাম দেখা আর শোরুম থেকে প্রয়োজনীয় পোশাক কিনতে পারবেন। তবে তাদের সঙ্গে একটু সামলে কথা বলতে হয়, মেজাজের দিক থেকে তারা একটু অন্যরকম। রাখাইন পল্লীতে যেসব পণ্য পর্যটকরা দেখে থাকেন, তার প্রায় শতভাগ জিনিস কুয়াকাটা শহরের বিভিন্ন মার্কেটে আরেকটু কমদামে পাওয়া যায়। তবে রাখাইনদের হাতে বুনানো কিছু পণ্য তাদের স্পেশাল।
আর কুয়াকাটা শহরের একদম মাঝেই রয়েছে কুয়াকাটার সেই কুয়া, যার নামে এলাকার নামকরণ। মূলত সেটি একটি বৌদ্ধ বিহারের মধ্যে অবস্থিত। টিকেটের বিনিময়ে সেখানে প্রবেশ করে ছবি/সেলফি তুলে কিছুটা উঁচু সিড়ি বেয়ে বৌদ্ধ মন্দির ঘুরে দেখতে বেশ লাগবে।
কুয়া আর বিহারের পাশেই রয়েছে অনেকগুলো মার্কেট, সৈকতের কোল ঘেঁষা মার্কেট ছাড়াও সেখানে পাবেন পোশাক-আশাক, ঝিনুক পণ্য, আচারের নানা দোকান। তবে শুটকি মাছ কিনতে পর্যটকদের অবশ্যই যেতে হবে সৈকতের পাশের শুকটি মার্কেটে নয়তো কিছুটা দূরে শুটকি পল্লীতে।
শহরের মধ্যেই রয়েছে ‘ইলিশ পার্ক’, এটা একটি রেষ্টুরেন্ট কাম মিনি মিউজিয়াম। ওই পার্কে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে বাঘ, সিংহ, হরিণ, কুমির, বক, কচ্ছপ, জিরাফসহ নানা প্রজাতির জীবজন্তুর ভাস্কর্য। পার্কের মূল ফটকের পাশেই রাখা হয়েছে কুয়াকাটার নানা পেশাজীবীদের কৃষ্টি, রাখাইনদের বৈচিত্র্যময় জীবন-জীবিকার ফটো গ্যালারি।
পার্কের চারদিকে রয়েছে নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের প্রতিকৃতি। পার্ক সাজানো হয়েছে ফুল ও ফলের গাছ দিয়ে। রয়েছে পাঁচটি গোল ঘর, ইলিশ ক্যাফে, লেক, ফিশ মিউজিয়াম, ফটোগ্যালারি, সাম্পান মঞ্চ, জুস কর্নারসহ লাইভ এনিমেল ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য। স্থানীয় এক সংবাদকর্মীর উদ্যোগে তৈরি ওই পার্কে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতে পারেন পছন্দমতো।
কুয়াকাটা সৈকতের কাছেই আরেকটি আকষর্ণীয় স্পট হচ্ছে টেংরাগিরি রিজার্ভ ফরেষ্ট যা স্থানীয়ভাবে ‘ফাতরার বন’ নামে পরিচিত। এই বন একসময় সুন্দরবনের অংশ ছিলো। এই বনে ঢুকে এর ম্যানগ্রোভ গাছগুলো আর খাল-খাঁড়ি সুন্দরবনের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে পারবেন পর্যটকরা।
একটি স্থানীয় ট্যুর অপারেটরের সাহায্য টিকেট করে ছোট ছোট ট্রলারে চেপে ওই বনে যেতে হয়। যাওয়া-আসা-ঘোরাঘুরি মিলিয়ে প্রায় ৪/৫ ঘন্টার একটি উপভোগ্য সময় কেটে যাবে।
গাইড ও নৌকার মাঝির সাহায্য ছাড়া বা দলছুট হয়ে বনে ঢোকা মোটেই নিরাপদ না। পথ হারানোর ভয়সহ নানা ক্ষুদ্র আকৃতির প্রাণির মুখোমুখি হয়ে পড়াটা অস্বাভাবিক নয়। মনে রাখা উচিত, এটি কোনো কৃত্রিম স্পট ও পাবলিক প্লেস না। সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়েই সেখানে যাওয়া উচিত।
গাইডের সঙ্গে বনের ভেতর দিয়ে ম্যানগ্রোভ গাছের শ্বাসমূল আর কাঁটা ঝাড় পেরিয়ে বনের পাশেই সাগর সৈকতে গিয়ে ছবি তুলে আর কিছুটা সময় বসে থাকতে পছন্দ করেন পর্যটকরা। ট্রলার ঘাট থেকে একটু নামলেই রয়েছে ফাতরার বনের একমাত্র মিঠা পানির পুকুর, একটি মসজিদ আর একমাত্র খাবার হোটেল। অনেক পিকনিক পার্টি সেখানে আসে পিকনিকে, তারা নিজেদের মতো করে সেখানে রান্না করে খাওয়া-দাওয়া সাড়েন।
তবে যারা কুয়াকাটা থেকে সেখানে যাবেন, তাদের উচিত কিছু শুকনো খাবার আর পানি সাথে নেওয়া। খুব ছোটো শিশু সঙ্গে থাকলে তার খাবারও সঙ্গে নেওয়া উচিত। আগে সেখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণসহ সুন্দরবনের প্রায় সব প্রাণি থাকলেও এখন তা শুধু স্মৃতিতে। তবে শেয়াল, শুকোর, সাপসহ প্রচুর কাঠবিড়ালি আছে সেখানে। পর্যটকদের পদচারণায় যদিও তাদের দেখা পাওয়া খুব একটা যায় না। তবে ওইসব প্রাণিদের পায়ের ছাপ দেখতে পাওয়া যায় খাঁড়ির পাশে অথবা বনের মাঝের নীচু জলার পাশে।
ট্রলারে করে বনের মাঝে খাল ও খাঁড়িতে ঢুকলে নানা পাখি আর বনোফুলের সমাহার চোখে পড়ে। দিনের আলো থাকতে থাকতে সেখান থেকে ফিরে আসতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন গাইড ও স্থানীয় বন বিভাগ।
খুব পরিকল্পিতভাবে ঘুরলে ১/২ দিনের মধ্যে কুয়াকাটার সব স্পট দেখা সম্ভব। তবে একটু সময় নিয়ে গেলে ভাল লাগার মাত্রা অনেক বেড়ে যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পর্যটন কর্তৃপক্ষ কুয়াকাটার মান উন্নয়নে বিশেষ নজর দেওয়াতে বিদেশী অনেক পর্যটক আসছেন সাগরকন্যা কুয়াকাটার সৌন্দর্য উপভোগে। বর্ষার পর থেকে পুরো শীতকাল ফ্যামিলি ট্যুরসহ বিভিন্ন পিকনিক পার্টির ভ্রমণপ্রেমীরা সেখানে ভিড় করে থাকেন। এছাড়া ভর বর্ষায় সেখানের সাগরের উত্তালচিত্র উপভোগেও ছুটে যান অনেকে। কক্সবাজার সৈকতের মতো চোরাবালি টাইপ কিছু না থাকায় জোয়ারভাটা দুসময়েই পর্যটকরা সৈকতে নেমে থাকেন। আর পানির লবনাক্ততায়ও রয়েছে ভিন্নতা, বছরের অর্ধেক সময় লবন আর অর্ধেক সময় মিঠা পানি থাকে কুয়াকাটার সমুদ্রে।
দেশের একেক অঞ্চলের, একেক স্পটের ভিন্নতার কারণে পর্যটকদের কাছে বন আর সাগরের মিশ্রণে কুয়াকাটা ভাল লাগবে।
ছবি- লেখক