কুয়েতের আদালতে ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় লক্ষীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলের সংসদ সদস্য পদ হারাতে হবে কি না, দেশের সংবিধানে তা স্পষ্ট নয়। কারণ বাংলাদেশ সংবিধানে যে অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্য পদ হারানোর কথা বলা হয়েছে, তাতে বিদেশের কোনো আদালতের কারাদণ্ডের কথা বলা হয় নি। যদিও বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব থাকলে সংসদ সদস্য পদে থাকতে পারবেন না সে কথা বলা হয়েছে স্পষ্ট করে। সংবিধান অনুযায়ী বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে নির্বাচন কমিশন আর সাংবিধানিক জটিলতা দেখা দিলে বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৬৬ (২) অনুচ্ছেদে কোন ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এবং থাকার যোগ্য হবেন না যদি-
(ক) কোন উপযুক্ত আদালত তাঁকে অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা করেন;
(খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় হতে অব্যাহতি লাভ না করে থাকেন;
(গ) তিনি কোন বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন;
(ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হলে;
(ঙ) আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না এমন পদ ছাড়া তিনি প্রজাতন্ত্রের কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশের কোন আদালতে দণ্ডিত হলে সদস্যপদ খারিজ হবে কি না তা অস্পষ্ট। যেখানে ৬৬(২)(গ) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে বিদেশী নাগরিকত্ব থাকলে তিনি সংসদ সদস্য হতে পারবেন না এবং হলেও থাকতে পারবেন না।
অবশ্য এ নিয়ে কোন বিরোধ দেখা দিলে তার মিমাংসা করবে নির্বাচন কমিশন। সংবিধানের ৬৬(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কোন সংসদ সদস্য তার নির্বাচনের পর এই অনুচ্ছেদের (২) দফায় বর্ণিত অযোগ্যতার অধীন হয়েছেন কি না কিংবা এই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোন সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হবে কি না সে সম্পর্কে কোন বিতর্ক দেখা দিলে শুনানির জন্য প্রশ্নটি নির্বাচন কমিশনের নিকট পাঠানো হবে এবং সে ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।
শুধু তাই নয়, ৬৬(৫) অনুচ্ছেদে এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে ৬৬(৪) দফার বিধানাবলী যাতে পূর্ণ কার্যকারতা লাভ করতে পারে সে উদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতাদানের জন্য সংসদ যেমন প্রয়োজন মনে করবে, আইনের দ্বারা সেরূপ বিধান করতে পারবে।
অর্থাৎ সংবিধান অনুসারে পাপুলের সদস্যপদ থাকবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠলে তার চূড়ান্ত নিস্পত্তি করবে নির্বাচন কমিশন।
কোন কোনো সংবিধান বিশেষজ্ঞ অবশ্য বলেছেন, পাপুলের সদস্যপদ ৬৭(১)(খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ীই শূন্য হয়ে যায়। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কোন সদস্য সংসদের অনুমতি ছাড়া একাদিক্রমে ৯০ বৈঠক দিবস সংসদে অনুপস্থিত থাকলে তার সদস্যপদ শূন্য হয়ে যাবে। পাপুল কুয়েতে গ্রেফতার হয়েছেন গতবছরের ৬ জুন। অর্থাৎ গত ৮ মাস ধরে তিনি অনুপস্থিত। এর মধ্যে সংসদের কয়েকটি অধিবেশন হয়েছে। তিনি কোনো অধিবেশনে যোগ দেননি এবং তার বিষয়টি সংসদের স্পীকারকেও জানানো হয় নি বলে জানা গেছে।
তবে পাপুলের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কার্যকর হবে না, কারণ তিনি কোন দলের প্রার্থী নন। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করেছেন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন পাপলুর বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন ওঠতেই পারে। কারণ তখন সংবিধান প্রণেতারা হয়তো ভাবেন নি যে দেশে এমন ঘটনাও ঘটবে। একজন আইনপ্রণেতা এমন অপকর্ম করবেন তা ভাবনাতেই থাকার কথা না।
তবে সংবিধানের চলমান স্পিরিটেই সেই লোক সাংসদ থাকার কথা না। কারণ সংবিধানে উপযুক্ত আদালতের কথা বলা হয়েছে। কুয়েত সরকার বিষয়টি সরকারিভাবে যদি বাংলাদেশকে জানায়, তা হলে নির্বাচন কমিশন তার সদস্যপদ খারিজ করতে পারে।
আলোচিত সাংসদ শহীদ ইসলাম পাপুলকে কুয়েতের আদালত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দিলেও এখন পর্যন্ত কুয়েত সরকার বিষয়টি সরকারীভাবে বাংলাদেশ সরকারকে অবহিত করে নি। এমনকি পাপুলের গ্রেপ্তারের বিষয়টিও বাংলাদেশকে জানায় নি। কুয়েতের বাংলাদেশ হাইকমিশনও সরকারিভাবে বিষয়টি জানতে পারে নি। হাইকমিশনার জানিয়েছেন, তারা সংবাদমাধ্যম থেকে বিষয়টি জেনেছেন।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য কুয়েতে আটক আছেন, সে বিষয়টি সরকারিভাবে এখনও জানতে চাওয়া হয়নি কেনো? যদিও সংবাদ মাধ্যমের বদৌলতে বিষয়টি সবাই জানেন, কিন্তু সরকারিভাবে জানার একটি প্রক্রিয়া থেকেই যায়।
কুয়েতের কারাগারে আটক ও দণ্ডপ্রাপ্ত সাংসদ পাপুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম নারী কোটায় সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য। অবৈধ সম্পদ অর্জনের জন্য দুদকের মামলায় তিনিও আসামী। কিন্তু তার স্বামী যে বিদেশের কারাগারে আটক, বিষয়টি তিনিও সংসদকে জানান নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য পেলে তবেই তার সদস্যপদ খারিজের উদ্যোগ নেবে সংসদ সচিবালয়। আর পাপুলের সদস্য পদ খারিজে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন সিটিং এমপি দুর্নীতির কারণে বিদেশে দণ্ডিত হওয়া, কারাগারে আটক থাকা এক নজিরবিহীন ঘটনা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)