চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সাংবাদিক কার প্রতিপক্ষ?

ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০০৪ সালে ঢাকায় চলে আসি। তখন কাজ করি ঝালকাঠিতে। প্রথম আলোর প্রতিনিধি হিসেবে। স্থানীয় এক সাংবাদিকের ওপর তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী শাহজাহান ওমরের লোকেরা হামলা চালালে এর প্রতিবাদে জেলার সাংবাদিকরা রাস্তায় নামেন। তাতে যোগ দেন বরিশালসহ আশেপাশের জেলার সাংবাদিকরাও। একটি সম্মিলিত প্রতিবাদের আয়োজন করা হয়েছিল ২০০৩ সালের ৮ ডিসেম্বর। কিন্তু সেদিন ঝালকাঠি প্রেসক্লাবে নজিরবিহীন হামলা চালায় জেলা যুবদলের ক্যাডাররা। ওইদিনই তারা উল্টো ১০জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দেয়। সেই মামলার আমিও একজন আসামি। প্রাণনাশের হুমকি আসে। দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকার পরে পরিবারের চাপে ঝালকাঠি ছাড়তে বাধ্য হই এবং আরেকটি জাতীয় দৈনিকের ঢাকা অফিসে এসে কাজ শুরু করি। ক্ষমতাসীন দল কী করে সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ হয় বা প্রতিপক্ষ বানায়, তার একজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভিকটিম হিসেবে এই মন্তব্যটি লিখছি।

সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের সংবাদ কাভার করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক নির্মম মারধরের শিকার হয়েছেন। অনেকে এখনও হাসপাতালে। এদের মধ্যে রয়েছেন এপি’র (অ্যাসোসিয়েট প্রেস) ফটোসাংবাদিক এ এম আহাদ, প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আহমেদ দীপ্ত, পাঠশালার দুই শিক্ষার্থী রাহাত করীম ও এনামুল কবীর। আহত অন্য সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন দৈনিক বণিকবার্তার পলাশ শিকদার, অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিমর্নিংয়ের আবু সুফিয়ান জুয়েল, দৈনিক জনকণ্ঠের জাওয়াদ, প্রথম আলোর সিনিয়র ফটোগ্রাফার সাজিদ হোসেন, চ্যানেল আইয়ের সামিয়া রহমান, মারজুক হাসান, হাসান জুবায়ের ও এন কায়ের হাসিন।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, ৫ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায় হেলমেটপরা একদল লোক। তাদের কারো কারো পরিচয়ও এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সায়েন্স ল্যাব, সিটি কলেজ, ধানমন্ডি ২ নম্বর ও জিগাতলা এলাকায় সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়ে ক্যামেরা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়া হয়। কারো কারো ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়। তাদের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়া হয়। হুমকি-ধমকি দিয়ে দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়ার পাশাপাশি ছবি তুললে পেটানো হবে বলে শাসানো হয়।

তার মানে হলো, কোনো একটি পক্ষ যখন সাংবাদিকদের কারণে নিজেদের অন্যায় কাজটি অবাধে করতে পারে না বা করলেও সেটি সাংবাদিকের ক্যামেরায় ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে থাকে, তখনই তারা সাংবাদিককে প্রতিপক্ষ ভাবে। এখানে লড়াইটা তখন আর সাংবাদিক বনাম হামলাকারী নয়-বরং লড়াইটা যখন সাদা-কালোর, লড়াইটা তখন শুভ-অশুভর।

সাংবাদিকদের উপরে যে শুধু আন্দোলনবিরোধীরাই হামলা চালিয়েছে তা নয়; বরং সায়েন্স ল্যাব এলাকায় কয়েকটি টেলিভিশনের গাড়ি ভাঙচুর করে সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরাই। তারা গাড়ি ভাঙচুরের সময় আগের দিন অর্থাৎ ৪ আগস্ট ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ কার্যালয় এলাকায় সংঘর্ষের নিরপেক্ষ খবর প্রচার করেনি বলে অভিযোগ করে এবং সাংবাদিকদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। অথচ নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে শুরু থেকেই বেশ গুরুত্বসহকারে প্রকাশ ও প্রচার করে আসছিল মূলধারার গণমাধ্যমগুলো। অথচ সেই শিক্ষার্থীরাই একটা পর্যায়ে গিয়ে গণমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেললো। শুধু গাড়ি ভাঙচুরই নয়, আন্দোলনকারীদের হাতে আরও নানাভাবে হেনস্থার শিকার হয়েছেন আমাদের সহকর্মীরা। প্রশ্ন হলো, যারা গণমাধ্যমের গাড়ি ভাঙচুর করলো বা সাংবাদিকদের এভাবে হেনস্থা করলো তারা আসলেই শিক্ষার্থী কি না? নাকি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যে অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে বলে বলা হচ্ছে, এইসব হামলা তাদের কাজ? কোনোদিন কি এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হবে?

আবার শুধু আন্দোলনকারী বা আন্দোলনবিরোধীরাই নয়, এই আন্দোলন ইস্যুতে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশও চড়াও হয়েছে। সবশেষ ৬ আগস্ট রাজধানীর রামপুরার আফতাবনগরে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া এবং সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহের সময় হেনস্থার শিকার হয়েছেন প্রথম আলোর রিপোর্টার নাসরিন আকতার। এ সময় পুলিশের কয়েকজন নারী সদস্য নাসরিনকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন বলে খবরে প্রকাশিত হয়েছে।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, সাংবাদিকরা যুগে যুগেই ক্ষমতাসীন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশের প্রতিপক্ষ হিসেবে আক্রমণের শিকার হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একটা সময় পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক দল বিশেষ করে সর্বহারা পার্টির লোকদের বড় টার্গেট ছিলেন সাংবাদিকরা। সেই আতঙ্ক কেটে গেলেও এখন সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ ভাবে অন্যান্য ক্ষমতাবান গোষ্ঠী, যেমন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর শ্রমিকরা মাঝেমধ্যেই আন্দোলনে নামে। সাংবাদিকরা তাদের সেই আন্দোলনের খবর দেন। টেলিভিশনগুলো সরাসরি সম্প্রচার করে। পাটশ্রমিকদের প্রতি সাংবাদিকরা বরাবরই সংবেদনশীল। অথচ এই শ্রমিকরাই সাংবাদিকদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। শ্রমিকদের অভিযোগ, সাংবাদিকরা তাদের খবর যথাযথভাবে পরিবেশন করে না। একজন অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত শ্রমিক যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী সাংবাদিককে প্রকাশ্যে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে এবং আক্রমণে উদ্যত হয়, তখন তাদের সংবাদ না করা বা তাদের বিরুদ্ধে সংবাদ করাই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু সাংবাদিকরা এখানে পেশাদারীত্ব থেকে বিচ্যুৎ না হয়ে শ্রমিকদের আন্দোলনের খবর দেন এবং মূলধারার গণমাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে কখনো সংবাদ হয় না। বস্তুত সাংবাদিকরা শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। কিন্তু শ্রমিকরা এই সাংবাদিকদেরই প্রতিপক্ষ ভাবেন। পরিবহন শ্রমিকরাও মাঝেমধ্যে নানা দাবিতে রাস্তায় নামেন। সাংবাদিকরা নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে সেই খবর প্রকাশ ও প্রচার করলেও সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময়ে পরিবহন শ্রমিকদের হামলার শিকার হয়েছেন।

কারা সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ বা শত্রু ভাবে? উত্তর সহজ, যারা নিজেদের অন্যায় আড়াল করতে চায়, যারা অপরাধী- তারাই সাংবাদিককে ভয় পায় বা প্রতিপক্ষ ভাবে। কারণ একজন সরকারি কর্মকর্তা, একজন পুলিশ, একজন ঠিকাদার, একজন অন্য যেকোনো পেশার মানুষ যখন অন্যায় করেন, সেই অন্যায়টি একজন অন্য পেশার মানুষ দেখে ফেললে বা জেনে গেলে সেটি যত না ঝুঁকি তৈরি করে, একজন সৎ সাংবাদিক জেনে গেলে সেই ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায়। কারণ একজন সৎ সাংবাদিককে টাকা দিয়ে কেনা যায় না। ফলে তিনি অন্যায়টি প্রকাশ ও প্রচার করবেন। অপরাধীদের ভয় এখানেই।

এটা ওপেন সিক্রেট যে, পুলিশ বা অন্য যেকোনো পেশার অসৎ লোকেরা সাংবাদিক ছাড়া কাউকেই ভয় পায় না বা তোয়াজ করে না। ফলে সুযোগ পেলেই তারা সাংবাদিকের ওপর চড়াও হয়। ক্ষমতাবানরা জানে, তাদের অন্যায় কাজগুলো দেশের মানুষ শুধু এই সাংবাদিকদের কারণেই জানতে পারে। না হলে দেশ বহু আগেই লুটপাট করে খেয়ে ফেলতো তারা। কিন্তু যেহেতু তারা এই অবাধ লুটপাট করতে পারে না শুধুমাত্র গণমাধ্যমের ভয়ে, তাই গণমাধ্যমই তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ; শত্রু।

নির্মম বাস্তবতা হলো, একজন রাজনৈতিক নেতা যখন বিপদে পড়েন, তিনি প্রথম ফোনটা করেন তার ঘনিষ্ঠ কোনো সাংবাদিককে। একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী- প্রত্যেকেই বিপদে পড়লে প্রথম ফোনটা সাংবাদিককে করেন। তাদের ধারণা বা বিশ্বাস, সাংবাদিকরা তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে না পারলেও অন্তত উদ্ধারের পথ বাতলে দেবেন। অথচ এই লোকগুলোই সুযোগ পেলে সকালে সন্ধ্যায় সাংবাদিকের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করেন। কিন্তু সাংবাদিক যখন রাস্তায় মার খায়, সাংবাদিককে যখন রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররা পেটায়, সাংবাদিককে যখন পুলিশ পেটায়, সাংবাদিককে যখন আন্দোলনকারী এবং আন্দোলনবিরোধীরা পেটায়—তখন সাংবাদিক কাকে ফোন করবে? সাংবাদিক কার কাছে বিচার চাইবে?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)