সম্প্রতি দুটো ঘটনায় দুজন সাংবাদিকের হাতে পুলিশ হাতকড়া পরিয়েছে। ব্যাপারটি এমন নয় যে, ঐ দুজন সাংবাদিক ফৌজদারী অপরাধ করেছেন। তাই ওয়ারন্টে নিয়ে এসে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করেছে। ব্রিটিশ যুগে, পাকিস্তান আমলে, স্বাধীনতা পরবর্তী সামরিক কিংবা স্বৈরশাসনের আমলে অনেক বিখ্যাত সাংবাদিক জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে গেছেন। নির্যাতন সয়েছেন। ১৯৯১ সাল পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পর থেকে সাংবাদিকদের হাতে হাত কড়া পরানোর প্রবণতা অনেক কমেছে। সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও সাংবাদিক শুনলে পুলিশ সমীহ করতো। এক ধরণের সম্মান, শ্রদ্ধার চোখে দেখতো। কিন্তু সব যেনো কর্পূরের মতো উবে গেছে।
খুলনায় যে সাংবাদিকের হাতে হাতকড়া পড়েছে সেটি রীতিমতো তার পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময়। তিনি একটি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অনিয়মের উপর প্রতিবেদন করতে গিয়েছিলেন। তিনি যে অন-ডিউটিতে ছিলেন সেটি স্পষ্ট। তার সাথে ক্যামেরাম্যান ছিলো, ক্যামেরা ছিলো। প্রথম তাকে বাধা দেয় যারা ঐ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত এবং অনিয়মের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে। প্রথমে তারা বাধা দেয় এবং পরে পুলিশকে নিয়ে এসে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে হাতকড়া পড়ায়। ঐ সাংবাদিক যে বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলের হয়ে কাজ করেন সেই চ্যানেল সরকারপন্থি হিসেবে পরিচিত। তারপরও পুলিশ ঐ সাংবাদিকের হাতে হাতকড়া পরাতে এতটুকু কুন্ঠিত হয়নি।
একই দিন ঢাকায় একটি দৈনিক পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিককে কর্মরত অবস্থায় তার অফিস থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা। সাংবাদিকরা এবং সাংবাদিক নেতারা এমন ঘটনার বিচার চেয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন।
সাংবাদিককে হাতকড়া পরানোর সাহস
আমি যখন খুলনার সাংবাদিকের হাতে হাতকড়া পরা ছবি দেখছিলাম তখন মনে হচ্ছিল পুরো বাংলাদেশের সাংবাদিকের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে সেই পুলিশ। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এসব ঘটনার সাইকিটা বোঝা জরুরি। ব্যাপারটি এমন নয় যে সাংবাদিকরা কোনো অনিয়মের প্রতিবেদন করতে গিয়ে এই প্রথম হেনস্তার শিকার হয়েছেন। কিন্তু অনিয়মের প্রতিবেদন করতে গিয়ে অতীতে পুলিশের সহায়তায় পাওয়া গেছে। হয়তো এখনো কোনো কোনো পুলিশ সদস্য সেই কাজ করেন। কিন্তু বাহিনী হিসেবে পুলিশের সাইকিতে যে বড় ধরণের পরিবর্তন এসেছে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই এবং তারই ফেনা হিসেবে এসব ঘটনা দেখা যাচ্ছে।গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের থাকা না থাকা
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যমকে ফোর্থ এস্টেট বা চতুর্থ শক্তি বলা হয়। এই প্রপঞ্চের প্রবক্তা ফরাসী দার্শনিক জ্য জ্যাক রুশো। তিনি বলেছিলেন, জনগণের পক্ষে তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাদের অধিকার নিয়ে যারা কথা বলবেন তারা চতুর্থ শক্তি। জনগণের মুথপাত্র হিসেবে এই শক্তি কাজ করবে। সংবাদপত্র ও সাংবাদিক এই স্তরের অন্তর্গত। যাদের বলা হয় ম্যাস-মিডিয়া। বলা হয়- ভয়েস অব দ্য পিপল। রুশোর এই ভাষ্য থেকে সংবাদপত্রের নাম হয়েছে গণমাধ্যম। সাংবাদিকরা হয়েছেন জনমতের সংগঠন। নেপোলিয়ান বোনাপার্ট ফরাসি বিপ্লবের পর ধুলো থেকে তুলে রাজমুকুট তুলে নিয়ে রাজা বনে গেলেও রুশোর তত্ত্বকে অস্বীকার করেনি। সংবাদপত্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফোর্থ স্টেটে ভূষিত করেন তিনি। তিনি সাংবাদিকদের আখ্যায়িত করেন, জেন্টেলম্যান অব দ্য প্রেস হিসেবে। নেপোলিয়ানকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, আপনাকে যদি সংবাদপত্রবিহীন সরকার ও সরকারবিহীন সংবাদপত্রকে বেছে নিতে বলা হয় আপনি কোনটি বেছে নিবেন। নেপোলিয়ান পরেরটির কথা বলেছিলেন। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল সকালে উঠে সংবাদপত্রে তার সমালোচনা না দেখলে আতঙ্কিত হয়ে পড়তেন।
গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম দুটি শব্দের শুরু ‘গণ’ দিয়ে। গণ মানে জনগণ কারণ দুটি প্রপঞ্চের ম্যান্ডেট জনগণই দেন। গণমাধ্যমের ক্ষমতার উৎস একটি রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণ। কারণ ব্যক্তি মানুষের ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার ক্ষমতা সীমিত। যদি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র জনগণের হয় তবে জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার অধিকার জনগণের পক্ষ থেকে একটি পেশাকে দেয়া হয়েছে সেটি সাংবাদিকতা। ব্যক্তি মানুষ বলে, দেখো আমাদের পক্ষে ক্ষমতাবানকে চোখে চোখে রাখা সব সময় সম্ভব নয়। তোমরা আমাদের পক্ষে এই কাজটি করবে। তাই সাংবিধানিকভাবে গণমাধ্যমের কাজ হলো জনগণের পক্ষে ক্ষমতাবানকে প্রশ্ন করা। যে কারণে একমাত্র সাংবাদিকরা প্রধানমন্ত্রীকেও প্রশ্ন করতে পারে। প্রশ্ন করার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সুসংহত রাখে। ক্ষমতাকে নিরংকুশ হতে দেন না।কিন্তু সাংবাদিকরা যদি ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার পরিবর্তে প্রশংসা করেন তখন গণতন্ত্র আর থাকে না। জনগণও সাংবাদিকদের উপর আস্থা হারান।
সাংবাদিকরা কি দেশপ্রেমিক হবেন!
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ইতালির মুসোলিনি ও জার্মানির হিটলারের দল সাংবাদিকদের দেশপ্রেমিকে পরিণত করেছিলেন। ফলে দুটো দেশেই কায়েম হয়েছিলো ফ্যাসিজম ও নাজিজম। কি ভাষায় সাংবাদিকরা লিখবে এবং কিভাবে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবেন তার রূপরেখা ঠিক করে দিতের মুসোলিনি ও হিটলারের দল। ফলে দুটো দেশেই ২য় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে সব প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে পড়েছিলো। যে কারণে বলা হয়ে থাকে, একজন ডাক্তার ভুল করলে একজন রোগী মারা যায়, একজন উকিল ভুল করলে একটি মামলায় হার হয় কিন্তু একজন সাংবাদিক ভুল করলে একটি জনপদ তছনচ হয়ে যায়। সর্বোচ্চ সততার সাথে সাংবাদিকতা করায় একজন সাংবাদিকের দেশপ্রেম। সেখানে যখন সাংবাদিক বা সাংবাদিক সমাজ দেশপ্রেমিক হতে যান তখন সাংবাদিকতা পথভ্রষ্ট হয়, গণতন্ত্র ভুলুন্ঠিত হয়।
ইংরেজ দার্শনিক গ্লাডস্টোন বলেছিলেন, ‘পাওয়ার করাপ্ট, অ্যাবসলুট পাওয়ার করাপ্ট অ্যাবসলুটলি’। ক্ষমতার ধর্মই হলো নিরঙ্কুশ হওয়ার চেষ্টা। যে কারণে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমূহ ক্ষমতার ভারসাম্য নীতি অনুসরন করে। রাষ্ট্রের সব ধরণের ক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে রেখে একধরণের ভারসাম্য নীতিতে ভুমিকা রাখে গণমাধ্যম। কিন্তু সেই গণমাধ্যম যখন দেশপ্রেমিক হতে গিয়ে গণতন্ত্র, নির্বাচনকে ধ্বংস করার সারথী হয় তখন আখেরে সাংবাদিকদের হাতে হাতকড়া পড়ে।
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে কয়েকটি বেসরকারী চ্যানেল তাদের নিউজ চ্যানেল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। টেলিভিশনের নিউজ ব্যবস্থাপক, সিনিয়র সাংবাদিকরা নিজেদের রক্ষায় নতুন সংগঠনও করেছেন। কিন্তু তাদের একটি অংশ যে গণতন্ত্র রক্ষায় ভুমিকা না রেখে বুঝে হোক না বুঝে হোক গণতন্ত্র দুর্বল করতে ভুমিকা রেখেছেন সেটি জনগণের কাছে এতটায় পরিস্কার যে তাদের কষ্টে জনগণের এতটুকু খারাপ লাগছে না এখন। কারণ এদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে, তারা যাদের সত্য বলার, বস্তুনিষ্ট সংবাদ পরিবেশনের ম্যান্ডেট দিয়েছিলো সেই পবিত্র আমানত তারা রক্ষা করেনি। সুতরাং জনগণও তাদের উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর টেলিভিশন চ্যানেলের জন্মের পাপ তো আছেই।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বড় একটি অংশ গণতন্ত্র দুর্বল করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখায় আজ পুলিশ সাংবাদিকের হাতে হাতকড়া পরাতে সুযোগ পায়। কারণ একটু একটু করে এদেশ জনগণের রাষ্ট্র থেকে একটি ক্ষুদ্র ক্ষমতাবানের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র যখন জনগণের থাকে না তখন সেখানে সাংবাদিকতারও অস্তিত্ব থাকে না। কারণ গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম একটি অপরটির পরিপূরক। যেখানে গণতন্ত্র নেই সেখানে গণমাধ্যম অস্তিত্বহীন,যেখানে গণমাধ্যম পরাধীন সেখানে গণতন্ত্র অর্থহীন। সেখানে সাংবাদিকতা হাতকড়া পরে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)