চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

সাংবাদিকতায় সামাজিক মাধ্যম: সবার আগে দরকার তথ্যের সত্যতা

যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক মাধ্যমের ‘সাংবাদিকীয়’ ব্যবহারের ওপর পরিচালিত এক গবেষণার আলোকে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সাংবাদিকতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – সত্যতা যাচাইয়ের বিষয়টিকে বাংলাদেশে সবার আগে গুরুত্ব দেয়া দরকার।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে সাংবাদিকতা, অথবা সাংবাদিকতায় সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার – যেভাবেই বলা হোক না কেন, বর্তমান সময়ের সাংবাদিকতায় যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো খুব বেশিই সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছে, তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগই নেই। তবে নেতিবাচক ভাবে না দেখে একে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানোর পক্ষেই গবেষকরা।

বছর চারেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ওকলাহোমার গেইলর্ড কলেজ অফ জার্নালিজম অ্যান্ড ম্যাস কমিউনিকেশন-এর দুই শিক্ষক যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড এ ক্রেইগ এবং বাংলাদেশের ইউসুফ মোহাম্মদ সাংবাদিকতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের নানা দিক নিয়ে একটি গবেষণা করেন। সেখানে দেখা যায়, সামাজিক মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্যের সঠিকতা ও সত্যতা যাচাইয়ে সম্পাদকরা যথেষ্ট উৎকর্ষ দেখাচ্ছেন।

তবে সেই সময় গবেষণায় বেরিয়ে আসা তথ্য চার বছর পরও বদলায়নি। বরং বিশ্বজুড়ে এখন সাংবাদিকতায় সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব আরও অনেক বেশি বেড়েছে।

‘ইন্টারন্যাশনাল সিম্পোজিয়াম অন অনলাইন জার্নালিজম’-এর অধীনে প্রকাশিত গবেষণাটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে করা হলেও তার সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতির যথেষ্ট মিল রয়েছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে সামাজিক মাধ্যমের সাহায্য নেয়া হচ্ছে।

সামাজিক মাধ্যম-সাংবাদিকতা
ইউসুফ মোহাম্মদ

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ইউসুফ মোহাম্মদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয় সবখানেই সংবাদ সংগ্রহ, সংবাদ সূত্র এবং সংবাদ প্রচারসহ সাংবাদিকতার মূল জায়গাগুলোতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে সম্প্রচার এবং অনলাইন মাধ্যমগুলোতে ব্রেকিং নিউজ বা তাৎক্ষণিক বড় খবরগুলো খুব দ্রুত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে এবং সেটি এই সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে দ্রুত ছড়িয়েও দেয়া যায়। গবেষণায় বলা হয়, সামাজিক মাধ্যম থেকে কোনো ঘটনা বা বিষয় সংশ্লিষ্ট লোকজনের অভিজ্ঞতা ও মন্তব্য পাওয়াটা অনেক বেশি সহজ হয়।

ইউসুফ বলেন, ‘বিবিসি, সিএনএন, এপি, রয়টার্সসহ বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য সামাজিক মাধ্যমের দায়িত্বে থাকা সম্পাদকদের কাছে আমরা গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেছিলাম, অনলাইন সাংবাদিক হিসেবে যদি টুইটার বা ফেসবুকে হঠাৎ এমন কোনো তথ্য পান যা সত্যি হলে খুব বড় একটি বিষয় হয়ে দাঁড়াবে, এমন অবস্থায় আপনারা কী করেন? আপনার যথেষ্ট পরিচিত বা খুব কাছের কেউ এমন কোনো একটি তথ্য ফেসবুকে পোস্ট করলেই কি আপনি তা বিশ্বাস করে সংবাদ হিসেবে আপনার সাইটে পাবলিশ করে দেবেন?

এর জবাবে সেই সম্পাদকরা বলেন, এক্ষেত্রে সংবাদের সত্যতা এবং তথ্য সঠিক হওয়াটাই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি তথ্য যত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণই মনে হোক না কেন, তা পুরোপুরি যাচাই-বাছাই না করে তারা সেটি সংবাদ হিসেবে প্রকাশ করেন না।’

বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের অবস্থানটা কোথায়, এ বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্যের সত্যতা যাচাই করে ব্যবহার অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। কেননা এ জায়গাটায় বাংলাদেশের বর্তমান অবকাঠামো অনেকটা দুর্বল।

সামাজিক মাধ্যম-সাংবাদিকতা‘পশ্চিমা বিশ্বে এমন অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আছে যারা বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেন এবং সেটি নিয়ে গবেষণা করেন। যেমন: এখানে যে কোনো একটি সামাজিক ইস্যু নিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ টুইট দেখলে আপনি তা নানা সূত্র থেকে যাচাই করতে পারবেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে আরও তথ্য ও মন্তব্য সংগ্রহ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অনেক গবেষণা আপনি পাবেন, বিভিন্ন ডেটাবেজ খুঁজে দেখতে পারবেন।

কিন্তু বাংলাদেশের সমস্যা হলো, এখানে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে সেটা নিয়ে একজন উপযুক্ত গবেষক খুঁজে না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অনেক তথ্যই আপনি কার কাছে ভেরিফাই করবেন তা নিশ্চিত হতে পারবেন না। আর এ কারণেই বাংলাদেশে সংবাদ পরিসরে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহার হওয়ার সুযোগ বেশি থাকে,’ বলেন এই গবেষক।

ড. ইউসুফ স্বীকার করেন, যুক্তরাষ্ট্রেও সোশ্যাল মিডিয়ার কমবেশি অপব্যবহার হয়। তবে এক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অনেক বড় একটি বিষয়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমই কোনো না কোনোভাবে সরকার বা কোনো রাজনৈতিক দল অথবা ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ কারণে তাদের মধ্যে তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের ঘাটতি দেখা যায়।

সাংবাদিকতায় সামাজিক মাধ্যমকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করার জন্য সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্টদের আরও অনেক বেশি সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন ইউসুফ মোহাম্মদ। তিনি বলেন, এমন অনেক সফটওয়্যার আছে, যার সাহায্যে কোনো ভিডিও আসল না নকল বা সেখানে কোনো পরিবর্তন আনা হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে বের করা যায়। আবার গুগল ইমেজ বা গুগল আর্থ-এর সাহায্যে ছবির সঙ্গে টেম্পারিং করা হয়েছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।

সাংবাদিকতার কোন কাজে কোন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার হচ্ছে সে দিকেও নজর দেয়া দরকার বলে মনে করেন এই গবেষক। তিনি বলেন, সংবাদ সংগ্রহের সূত্র হিসেবে ফেসবুক খুব বেশি নির্ভরযোগ্য নয়। যদিও এটা সূত্র হিসেবে অনেক কাজেই লাগে। তবে এখান থেকে কোনো তথ্য সাংবাদিকতার কাজে ব্যবহারের আগে অন্যান্য কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে যাচাই করে নিতে হবে।সামাজিক মাধ্যম-সাংবাদিকতা

‘ফেসবুক দর্শক-শ্রোতা-পাঠককে কোনো একটি কন্টেন্টে এংগেজ করে রাখার জন্য খুব ভালো। তাই এর মাধ্যমে মূলত সংবাদ ছড়িয়ে দেয়ার কাজটা বেশি ভালো হয়,’ বলেন ইউসুফ।

অন্যদিকে টুইটারে পাওয়া যে কোনো তথ্য ক্রসচেক বা যাচাই করার তুলনামূলক অনেক বেশি সহজ। কেননা কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কে সবার আগে টুইট করেছিল সেটা খুঁজে বের করা সম্ভব। তখন মূল টুইটের সূত্র ধরে আশপাশ থেকে আরও অনেক বেশি তথ্য জোগাড় করা যায়।

এছাড়া ফেসবুক সব শ্রেণীর মানুষই ব্যবহার করে। কিন্তু টুইটার তুলনামূলক একটু জটিল এবং ভিন্নধারার হওয়ায় তুলনামূলক উচ্চশিক্ষিত ও সুপরিচিত লোকজন এই মাধ্যমটির দিকে ঝোঁকেন বেশি। তাই সাংবাদিকতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইতিবাচক ব্যবহারের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য সামাজিক মাধ্যমের প্রকৃতি বিবেচনায় রাখাসহ সবকিছুর মূল হিসেবে তথ্যের সত্যতা নিখুঁতভাবে যাচাইয়ের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ইউসুফ মোহাম্মদ।