ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নে এ বছর একঝাঁক নারী নেতৃত্বের জন্য লড়ছেন। অতি সুক্ষ্ম সংবেদনশীল হিসেবে নারী সাংবাদিকরা খবরের পেছনের খবরও তুলে আনেন নিপুণভাবে। রাজনীতি আর অর্থনীতির খবরই নয়, ধর্ষণের মতো খবরের ক্ষেত্রেও নারীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি থাকে। তাই বলতেই পারি, নারী সাংবাদিকদের নেতৃত্বে আসা দারুণ খবর। সেই বিবেচনায় নারী সাংবাদিক হিসেবে নারীদের নেতৃত্বে পথ চলার সুযোগ পাবো এটা বড় আনন্দের খবর। তাই আশা করছি, নেতৃত্বের কাতারে যোগ্য নেতা হিসেবে নারী সাংবাদিকরা আমাদের পথ প্রদর্শক হবেন। আলোর পথ দেখাবেন। শুধু তাই নয়, নারী সাংবাদিকরা তাদের প্রবল অনুভূতিসম্পন্ন গুণের কারণেই পাশে থাকবেন সহকর্মী আর বন্ধু প্রিয়জন হয়ে। এই প্রত্যাশায় নারী নেতৃত্বের জন্য আগাম অভিনন্দন!
নারীদের বিজয়ী ধরেই তাদের কাছে কিছু প্রত্যাশার কথা তুলে ধরতে চাই। পেশ করতে চাই কিছু আর্জিও। সেই সুবাদে তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, নারী সাংবাদিকরা পুরুষ সাংবাদিকদের সাথে লড়ে নির্বাচিত হবেন। এরপর কী? ওই বিজয়ী নারীরা সংগঠনের অলংঙ্কার হয়েই থাকবেন, নাকি সকল সাংবাদিক তথা নারী সাংবাদিকদের জন্য কিছু করবেন? ভোটের আগে ভোট চেয়ে দৌড়ঝাঁপ বন্ধ করে সভা সেমিনার আর প্রথম সারিতে তার পদচারণা সীমিত করবেন না আশা করি। গত তিন দশকে নারী সাংবাদিকদের সংখ্যা ডাবল ডিজিটে না পৌঁছানো, নারীদের পেশাগত উন্নয়ন দক্ষতা বা টিকে থাকার কৌশলে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে তারা পাশে থাকবেন এই আশা করতেই পারি। তাই যদি হয় নির্বাচনের দৌড়ে সাহস করে এগিয়ে আসা নারী সাংবাদিক তথা নারী নেতাদের কাছে সবিনয়ে জানাতে চাই, একজন নারী আরেক নারীর জন্য কতটা বন্ধুভাবাপন্ন হবেন তার একটা মাত্রা এখনই তারা নির্ধারণ করবেন। নারী সাংবাদিকদের প্রতি তাদের সহমর্মী একটি দৃষ্টিকোণই তারা ঠিক করে নেবেন আশা করি। ভোটের পরেও যেন সেই দৃষ্টিভঙ্গি তারা ধারণ করেন। আসছি পরের প্রসঙ্গে। এর আগে দেশে এবং বৈশ্বিক পেক্ষাপটে সাংবাদিকতায় নারীর অবস্থানগত পরিসংখ্যান কিছুৃ তুলে ধরতে চাই। এর আলোকেই বিশ্লেষণ করতে চাই গত তিন দশকে কেন নারী সাংবাদিকের পরিসংখ্যানটা সেভাবে বাড়েনি।
১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট-পিআইবি’র এক জরিপ বলছে, ঢাকায় ২৪১টি পত্রিকায় কর্মরত পুরুষ সাংবাদিক ছিলো নয়শ জন। এর বিপরীতে নারী সাংবাদিকের সংখ্যা ছিলো মাত্র ৩৪ জন। শতকরার হিসেবে ঢাকায় তখন নারী সাংবাদিকের হার ছিলো মাত্র ৪ শতাংশ। এর দশ বছর পর ১৯৯৭ সালে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম এন্ড কমিউনিকেশন-বিসিডিজেসি’র উদ্যোগে এক জরিপ বলছে, সারাদেশে পুরুষ সাংবাদিকের সংখ্যা পনেরশ জন। এর বিপরীতে নারী সাংবাদিক ছিলো মাত্র ৬০ জন। শতকরা হিসেবে নারী সাংবাদিকের হার তখনো ছিলো সেই চার শতাংশই।
২০১৫ সালে গণমাধ্যম পরিবীক্ষণ প্রকল্পের এক প্রতিবেদন বলছে, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিওতে কর্মরত পুরুষ সাংবাদিকদের হার ৮১ শতাংশ আর মাত্র ১৯ শতাংশ নারী। ওয়ার্ল্ড আ্যাসোসিয়েশন ফর ক্রিশ্চিয়ান কমিউনিকেশন’-ডব্লিউএসিসি’র গবেষণা ও অ্যাডভোকেসির অনন্য প্রয়াসে গ্লোবাল মিডিয়া মনিটরিং প্রজেক্টের গত নভেম্বরের রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ৮৪ শতাংশ পুরুষ আর মাত্র ১৬ শতাংশ নারী। এর মধ্যে সংবাদপত্রে ৮ শতাংশ। রেডিওতে ৩৩ শতাংশ এবং টেলিভিশনে ১৯ শতাংশ নারী। তবে রেডিওতে ৬৭ ও টেলিভিশনে ৬৬ শতাংশ নারী উপস্থাপনায় নিয়োজিত। মাঠে-ময়দানে কাজ করা নারী সাংবাদিকের সঠিক কোন পরিসংখ্যান অনেকেরই জানা নেই। ২০০০ সাল থেকে ২০১৫ গত ১৫ বছরে বিশ্বব্যাপীই নারী সাংবাদিকের হার বেড়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। আর এদেশীয় আপাত অনুমান বলছে, গত তিন দশকে মাঠে ময়দানে সংবাদ তৈরিতে কাজ করছেন এমন নারী সাংবাদিকের হার ৪ শতাংশে থেকে খানিকটা হয়তো বেড়েছে তবে ডাবল ডিজিটে পৌঁছেনি। যদিও ডিজিটাল যুগের ব্যাপক প্রসারের ফলে টেলিভিশনে উপস্থাপনায় নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ। নারীর উপস্থাপনা মানেই সাংবাদিকতায় নারীর আগমন বেড়েছে বলে নারী সাংবাদিকের পাল্লাটা ভারী করার চেষ্টা অযোক্তিক।
এখানে শিক্ষার হার বাড়ছে। কি গ্রামে কি শহরে পথে-রাজপথে নারীর চলাচলও উল্লেখ করার মতোই। তারপরও সাংবাদিকতার মতো চ্যালেঞ্জের পেশার নারীরা কেন এখনো ডাবল ডিজিটে পৌছাতে পারেনি? এর উত্তর খুঁজতে কিছু বাস্তব উপমা দিতে চাই। আমি তো লেখার শুরুতেই সবিনয়ে ক্ষমা চেয়ে নারী নেতৃত্বের কাছে কিছু বাস্তব ঘটনা অবহিত করতে চাই। যদি তারা তা আমলে নিয়ে কাজের কাজ কিছু করতে পারেন। নিজের কথা দিয়ে শুরু করি। পরে আসছি অন্যদের অভিজ্ঞতার বয়ান নিয়ে। আমার সংবাদপত্রে কর্মজীবনের প্রথম দিকের কথা। যখন নিউজপ্রিন্ট কাগজের স্লিপে নিউজ এডিটরদের সাথে একই টেবিলে সংবাদ লিখতাম। উপযুক্ত ইন্ট্রো আর সংবাদের গতি এগিয়ে নিতে ভাবনার অবকাশে আমার পুরুষ সহকর্মীদের মতো চাইলেই ধুমপানের অবকাশে চিন্তার সুযোগ থাকতো না আমাদের। বরং মিলান ফারাবি বা শহীদুল আজমের মতো নিউজ এডিটর বা কবি সাযযাদ কাদিরের মতো প্রবীন সাংবাদিকের পাশে বসেই সংবাদের সবটা যথার্থভাবে লিখে ডেডলাইন মতো নিউজ জমা দিতে হতো। ওই সময়ের একদিন সকাল সকাল অফিসে গিয়ে নিউজ এডিটরের আদেশ- আগের দিনের বহুল আলোচিত মিরপুরের ওয়ার্ড কমিশনার নিউটন হত্যার আজকের ফলোআপটা আপনিই করবেন। তার টেবিলে বসেই উনি আগের দিন কাভার করা সিনিয়র নারী সাংবাদিকের কাছ থেকে ফোনে নিউটনের বাসার ঠিকানা নিতে বললেন আমায়। কিন্তু পাইনি। পরে ওই ঘটনা কাভার করা ফটোগ্রাফারের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে কাজে নেমেছি।
এতো গেল একটি ঘটনা। নারী হয়ে নারী সাংবাদিকদের প্রতি এমন মিষ্টি মধুর হাজারো প্রতিবন্ধকতার উদাহরণ দেয়া যাবে। এবার আসি মাতৃত্বকালীন ছুটির প্রসঙ্গে। আমি তখন প্রথমবারের মতো মা হচ্ছি। আমার পুরুষ সহকর্মী বিশেষ করে প্রয়াত সন্তোষ মন্ডল, মাহবুব মতিন আরো অনেকে রীতিমতো উদযাপন করেছেন। মাহবুব ভাই তো বলতেন, আরে কেকু (আমায় আদর করে মাথায় টোকা দিয়ে কেকু ডাকতেন) তুই নিজে পিচ্চি আরেক পিচ্চি আসবে, দারুণ আনন্দের খবর। মন খারাপ করবি না আনন্দে থাকবি সবসময়। ঐ সময়ে আমার গর্ভাবস্থার শেষ দিক পর্যন্ত ন্যাশনাল ডেস্কে কাজ করেছি বেশ কিছুদিন। পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজও সবসময় নিজের কন্যার মতো খোঁজ রাখলেও যাদের কাছে বেশি প্রত্যাশা বেশি হওয়ার কথা তাদের কাছ থেকে সেটা পাইনি।
অপ্রিয় হলেও আজ সত্যটা বলতে চাই, লেজুরবৃত্তির সাংবাদিকতার ঝাঁকে চলা গ্রুপভুক্ত সাংবাদিকতার বলির ঘটনা গণমাধ্যমে নতুন নয়। তবে কষ্টটা এই যে, কোন পুরুষ সহকর্মী নয় বরং নারী সাংবাদিকরাই আমার পুরুষ সহকর্মীদের মিসগাইড করে নারী হিসেবে আর দশটা নারীর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। বিএনপি আমলে প্রতিষ্ঠিত একটি টেলিভিশনের নারী সাংবাদিক কিছুদিন আগে অনেক কষ্ট নিয়ে বলেছিলো, আপা অফিসে আমার কোন পুরুষ সহকর্মী নয়, সিনিয়র এক নারী সহকর্মী আমাকে খুবই পেইন দিচ্ছে। এমনিতেই এসিডিটি, সাথে বমিটিং আর না খাওয়ায় কষ্ট। তারপর যখন একটু খেতে যায় তখনই উনি বলেন এই মেয়ে এত খাও কেন। আমাদের সময় আমরা এসব করিনি। শরীর খারাপের কষ্টের সাথে মনের কষ্টে সেই নারী সাংবাদিক সহকর্মীর কাছ থেকে নিজে আড়ালে থাকার চেষ্টা করেছি পুরোটা সময়।
এমনও ঘটনা আছে, কোন সিনিয়র নারী সাংবাদিক অফিসে রাতের গাড়ি নিয়ে ঢাকা শহরের শেষ প্রান্তে তার নিজের বাড়িতে আগে নামবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে আর নীলক্ষেতের কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে থাকা অন্য নারী সাংবাদিকরা রাত নয়টার পর গেট বন্ধের প্রতিবন্ধকতা সেই সিনিয়র নারী সাংবাদিক থোরায় কেয়ার করেছেন। এই নিয়ে এক জুনিয়র নারী চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তারপরও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। ঐ ঘটনা চলেছে দিনের পর দিন। বাধ্য হয়েই হলে-হোস্টেলে থাকা নারীরা অফিসের গাড়ির তোয়াক্কা না করেই রাতের আধারে নিজ গন্তব্যে পথে নামতেন।
এর বাইরে নারী সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময়ে জোটভুক্ত হয়ে নারীদের উন্নয়ন কাজ করার নানান উদ্যোগ নিয়েছেন। যেমনটা ছিলো ঢাকায় বিভিন্ন সভা-সেমিনারে কোরাম পূরণ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যখনই কোন দেশে-বিদেশে ভ্রমণ বা ট্রেনিংয়ের সুযোগ তখন সেই নারী সাংবাদিকদের আর সব নারী সাংবাদিকদের কোন খোঁজ খবরই রাখেন না। কিন্তু পারডিয়াম দেবার ক্ষেত্রে স্পষ্টতই বলতে শুনেছি এই তোর বা তোমাদের কি দরকার। তোরা বা তোমরা তো বড়লোক তোমাদের এই এক দুই হাজার টাকায় কি হবে বলো? বরং পরে একদিন সবাই মিলে আনন্দ করে আরেকটা আয়োজন করবো ইত্যাদি ইত্যাদি।
এর বাইরে পেশাগত উন্নয়নে কী করা যায়, কে লেখায় ভালো, কার লেখা কতটা আলোচনায় এসব নিয়ে কোন আলোচনা কোন নারী সাংবাদিকদের করতে দেখিনি। বরং কে কতটা সুন্দর, কার কী হলো, কী হলো না, কে কাকে ছাপিয়ে যাবে এসব নিয়ে আলোচনা হয়। এমন মনস্তাত্ত্বিক স্থূলতার গণ্ডি থেকে আমরা নারী সাংবাদিকরা বের হলে অনায়াসে দারুণ সব কাজ করতে পারি। তার উদাহরণও আছে, নারী নেতৃত্বের উদ্যোগে গতবছর ব্রিটিশ কাউন্সিলের নারী সাংবাদিকদের জন্য ২ দিনের ইংরেজী শিক্ষার কোর্স করার সুযোগ পেয়েছি আমি নিজে। ওই সুযোগের কারণে পনের হাজার টাকার কোর্স আমরা প্রায় ৩০-৩৫ জন নারী সাংবাদিক বিনামূল্যে করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সুতরাং আমরা যদি স্থূলতার গন্ডি অতিক্রম করে আমাদের নিজের পায়ে চলি তাহলে এক এক জন নারী আরেক নারীর পথ মসৃণ করে সাংবাদিকতায় নারীর অবস্থান নিঃসন্দেহে আরো মজবুত করতে পারে। তবে এর জন্য আমাদের নারী সাংবাদিকদের আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তাহলে নারী সাংবাদিকদের যোগ্যতা আর মেধা মননের প্রতি অবিচার করার সুযোগ কেউ পাবে না।
সর্বশেষ শ্রদ্ধেয় মাহফুজ আনাম ভাইয়ের বলা সাম্প্রতিক একটা কথা তুলে ধরতে চাই। তিনি সেদিন বলেছিলেন, এখন সাংবাদিকতার জন্য প্রশিক্ষণ আর ট্রেনিংয়ের কোন বিকল্প নেই। কারণ বৈশ্বিক অবস্থানের কারণেই সাংবাদিকতার ধরণ-ধারণ এখন এতটায় বদলেছে যে এর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জন্য বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ আনার প্রয়োজন পড়েছে। সেদিন তিনি নিজেদের প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, এখন আমরা ইন হাউস এবং দেশের বাইরে সাংবাদিকদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করছি। আমিও ঠিক এখান থেকেই শুরু করে নেতৃত্ব প্রত্যাশী নারীদের উদ্দেশে বলতে চাই, নির্বাচনে শুধু নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে ভোটার হিসেবে আমাদের, নারী সাংবাদিকদের হাল-হাতিয়াত করবেন না। বরং সময়ের প্রয়োজন বুঝে নারী সাংবাদিকদের এই পেশায় ধরে রাখা, পেশাগত উন্নয়নে আর কী করা যায় তা নিয়েও কাজ করবেন। একজন পুরুষ ষাট বছর বা অধিক সময় এই পেশায় থাকতে পারলে কেন একজন নারী পারবেন না। নারীর সংবেদনশীলতা আর গভীর মননশীলতা সাংবাদিকতার মহত্ত্ব আরো মর্যাদাশীল করবে। নেতৃত্ব প্রত্যাশী নারী সাংবাদিকদের প্রতি শুভ কামনা। বিজয়ের পতাকায় তাদের জন্য সংগ্রামী অভিনন্দন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)